২১ মে বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় ওয়ার্ল্ড ডে ফর কালচারাল ডাইভারসিটি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বৈচিত্র্যকে সম্মান, সুরক্ষা ও স্বীকৃতি প্রদান করা এবং বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তোলার জন্যই দিবসটি পালন করা হয়। আমাদের জন্য দিবসটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ দেশের প্রাকৃতিক ও মানবীয় বৈচিত্র্য বর্তমানে ভয়াবহ সংকটের মুখে। এই সংকট থেকে উদ্ধার পেতে হলে এ বিষয়ে সচেতনতা দরকার। দরকার বৈচিত্র্যকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও অঙ্গীকার।
প্রকৃতির বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্যে যে ভিন্নতা বা স্বাতন্ত্র্য তা-ই বৈচিত্র্য। তাপমাত্রা, জলবায়ু, বৃষ্টিপাত, জৈব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, মানবীয় বৈচিত্র্য, ভাষাগত বৈচিত্র্য, ধর্মীয় বৈচিত্র্য প্রভৃতি নানা বৈচিত্র্য নিয়েই বাংলাদেশ। ভাষা, ধর্ম, মানুষের জীবনযাত্রা ও রীতিনীতিতে নানান বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এক অতুলনীয় ঐক্যবোধ লক্ষ্য করেই ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ এ অঞ্চলের সভ্যতাকে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ (Unity in the midst of diversity) বলে অভিহিত করেছেন।
সবাই আমরা এই দেশের নাগরিক, সবাই দেশকে ভালোবাসি, একে-অপরের সমব্যথী ও শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে দেশের কল্যাণে সবাই কাজ করে যাই – এটাই আমাদের মূলগত ঐক্য। বিচিত্রকে ধারণ করে এগিয়ে চলাটাই বাংলাদেশের প্রধান শক্তি হওয়ার কথা ছিল। যদিও তা আমাদের সম্মিলিত অবিমৃষ্য ভূমিকার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে!
প্রকৃতি বৈচিত্র্যময় এবং এর বৈচিত্র্যের কোনো শেষ নেই। আমরা যদি কেবল মানুষের দিকে তাকাই, তাহলেও নানা রকম বৈচিত্র্য দেখতে পাব। কেউ নারী কেউ পুরুষ। ফর্সা-কালো, লম্বা-খাটো, শিশু-যুব-বৃদ্ধ। কারও মাথায় চুল নেই, কারও আবার বাবরী। কেউ গ্রামে বাস করে কেউ বা শহরে। মুসলিম-হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ। কেউ সমতলের বাসিন্দা কেউ বা পাহাড়ের। এভাবে ধনী-গরিব, আশরাফ-আতরাফ, আস্তিক-নাস্তিক, শিক্ষিত-নিরক্ষর, প্রতিবন্ধী, হিজড়া, সমকামী ইত্যাদি নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় মানুষ নিয়েই আমাদের সমাজ।
মানুষের চিন্তা-পছন্দের বৈচিত্র্য, বয়স, তাদের জীবনপ্রণালীর বৈচিত্র্য, গঠন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বৈচিত্র্য, আকার, অবয়ব এবং বেঁচে থাকার, সংগ্রাম করার বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি, সম্মান করার মাধ্যমেই সম্ভব বৈচিত্র্যকে বিকশিত করা। পৃথিবী তখনই সুন্দর হবে যখন আমরা বৈচিত্র্যকে তার আপন গতিতে চলতে দিতে পারব। সেটা প্রকৃতির বিভিন্ন প্রাণের বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি প্রযোজ্য মানুষের চিন্তার ভিন্নতা, পছন্দ, অবয়ব, জাতিগত, ভাষার, বয়স, সংস্কৃতির, সম্প্রদায়গত এবং সামাজিকতার বৈচিত্র্যের বেলায়ও।
খাদ্যের জন্য একটি প্রাণীর অস্তিত্ব যেমন আরও একটি প্রাণীর ওপর নির্ভর করে, পাশাপাশি প্রাণীর সুস্থ জীবন ও বিকাশের জন্য আরেকটি প্রাণী বা উদ্ভিদ পরিপূরক ভূমিকা পালন করে। উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। একটি বড় বটের ওপর আরও অনেক পরগাছা গুল্ম বা উদ্ভিদ জমে; আশ্রয় নেয়। একটি উদ্ভিদের সঙ্গে আরেকটি উদ্ভিদের ‘বন্ধন’ রয়েছে, যা হয়তো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না! উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যকার বন্ধন ও সম্পর্ক আরও নিবিড়, আরও অর্থপূর্ণ। অনেকগুলো প্রাণীর খাদ্য হচ্ছে এই উদ্ভিদ আবার অনেক উদ্ভিদের জন্মের (পরাগায়ন) পেছনে প্রাণীর অবদান রয়েছে। প্রকৃতিতে সব ধরনের সৃষ্টিগুলোই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ও নির্ভরশীল।
প্রকৃতিতে একজন থেকে অন্য জন শেখে। ছোট পিঁপড়েরা যখন দলবেঁধে কাঁধে বিশাল খাদ্যের বোঝা নিয়ে তাদের আবাসস্থলে খাদ্য মজুদ করে রাখে কিংবা মৌমাছি যখন বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে ‘চাকে’ জমা করে রাখে তখন মানুষও তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয় কীভাবে তাদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আকাশে উড়ন্ত পাখি দেখে মানুষের সাধ জাগে আকাশে ওড়ার; তারা আবিষ্কার করেন উড়োজাহাজ, সমুদ্রে মাছের বিচরণ দেখে মানুষের ইচ্ছা জাগে সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে সমুদ্রের রহস্য উন্মোচন করার; তারা আবিষ্কার করেন সাবমেরিন জাহাজ, সূর্যের আলো দেখেই অন্ধকারকে দূরীভূত করার জন্য মানুষ ‘কৃত্রিম আলো’ আবিষ্কার করেন। বিভিন্ন ধরনের পাখি, পোকামাকড়, জীবজন্তু ঘরনির্মাণের নকশা দেখে মানুষ নিত্যনতুন নকশার বাড়িঘর নির্মাণ করেন। এভাবে প্রতিটি উদ্ভাবনের বা আবিষ্কারের উৎসমূলই হচ্ছে এই বৈচিত্র্য!
প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর! উদ্ভিদে উদ্ভিদে, প্রাণীতে প্রাণীতে এবং মানুষে মানুষের ভেতরে এই বৈচিত্র্যময়তা পৃথিবীকে অনন্য একটি রূপ দিয়েছে। শীতের সকালে কুয়াশার চাঁদর ভেদ করে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর সূর্যের আলো বিকিরণে যে সৌন্দর্যের ঝিলিক দেখা যায়, কিংবা শরতের কাঁশবন, শিউলি ফুল, বর্ষার জল ভরা মেঘ, পূর্ণিমার চাঁদ বা ফাগুনের কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য সত্যিই আমাদেরকে বিমোহিত করে তোলে; প্রচণ্ড এক ভালোলাগার অনুভুতি দেয়!
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানেও বৈচিত্র্যকে সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। সংবিধানের ধারা ২৮ (১) এ বলা হয়েছে- ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’। কিন্তু আমরা বাস্তবে সংবিধানের এই বক্তব্যের প্রতিফলন খুব একটা দেখি না। আমাদের দেশে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, হিজড়া, দলিত, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, ভিন্ন যৌনাচারী ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর মানুষ ভীষণভাবে অবহেলিত। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বৈষম্য ও অবহেলার শিকার। অথচ প্রকৃতির সন্তান হিসেবে সবারই অধিকার আছে মর্যাদা, সম্মান ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বাঁচার।
প্রকৃতির ভেতর বিদ্যমান প্রাণের বৈচিত্র্য এবং মানুষের সমাজে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আজ উভয়েই সংকটের মুখোমুখি। এদেশে এখন ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন গোত্রের, ভিন্ন বিশ্বাসের ভিন্ন জীবনাচরণের মানুষরা শুধু বৈষম্যেরই শিকার হচ্ছে না, অনেকে আক্রান্তও হচ্ছে। সবাইকে সব কিছুকে এক ছাঁচে ফেলার একটা অপপ্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ আমরা জানি বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা ছাড়া আমাদের প্রিয় পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব।
আসলে বৈচিত্র্যকে শুধু চোখ দিয়ে নয়, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হয়; আত্মা নিয়ে উপলদ্ধি করতে হয়। প্রত্যেকের স্বকীয়তা স্বীকার করা, তাকে মর্যাদা দেয়া, টিকে থাকা ও বিকাশের জন্য সহায়তা করাই যে সভ্য মানুষের আরাধ্য হওয়া উচিত – এই উপলব্ধির জায়গায় আমরা এখনো পৌঁছতে পারিনি। যে যার ধর্ম পালন করবে, নিজেদের উৎসব অনুষ্ঠান করবে, নিজেদের পছন্দ মতো পোশাক পরবে, নিজেদের মতো চিন্তা করবে, নিজেদের বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকবে, সবাই সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে – এটাই বৈচিত্র্য।
সবাইকে সব মানুষকে শ্রদ্ধা করা, প্রত্যেকের স্বকীয়তাকে স্বীকার ও সম্মান করার মাধ্যমেই সম্ভব একটি বৈচিত্র্যময় সমাজ ও দেশ গড়ে তোলা। সব সংকীর্ণতা ও সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের মনে রাখতে হবে: ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ অথবা ‘নানা বরণ গাভী রে ভাই একই বরণ দুধ, জগৎ ভ্রমিয়া দেখি একই মায়ের পুত।’ আমরা সবাই মানুষ – এটাই হোক আমাদের একমাত্র পরিচয়।
আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক: মানুষসহ অন্যান্য প্রাণ ও জীবনের যুক্ততা ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা এবং ভালোবাসার মাধ্যমে বৈচিত্র্যের মাঝে ‘জীবন’ জেগে উঠবে, বৈচিত্র্যের মাঝে ‘সৌন্দর্য্য’ বিকশিত হবে। শত ফুল ফুটুক। এই ফুল ফোটার সুযোগ করে দিতে হবে। সেই ফুল দিয়ে আমরা সুরভিত, সুশোভিত মালা গাঁথব। সব ‘ভিন্নতা’ দিয়েই আমরা বৈচিত্র্যের ঐক্য গড়ে তুলব।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)