গত কয়েকদিনে ছেলেধরা সন্দেহে রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি স্থানে গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বাস্তবে সন্দেহটি নেহায়েত গুজব প্রমাণিত হলেও সেটি পরিষ্কার হওয়ার আগেই প্রাণ হারাতে হয়েছে ভুল বোঝাবুঝির শিকার একাধিক মানুষকে।
সমাজে ছড়িয়ে পড়া এই নতুন গুজবের ভয়াবহতা নিয়ে সমালোচনা চলছে একাধারে বাস্তব জীবন, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সবাই চাচ্ছেন, নির্বিচারে শুধু সন্দেহের বশে এই হামলা ও হত্যাকাণ্ড বন্ধ হোক।
ছেলেধরা সন্দেহে নিরপরাধ মানুষের ওপর হামলার পেছনের করুণ পরিস্থিতি নিজের লেখনির মধ্য দিয়ে বর্ণনা করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সাহিত্যিক গুলজার হোসেন উজ্জ্বল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে এ নিয়ে কষ্টে ভরা একটি ছোটগল্প লিখেছেন তিনি।
‘লোকটা ছিল রবিবাবুর কাবুলিওয়ালা’ শিরোনামে ডা. গুলজারের লেখা গল্পটি এরকম:
‘‘লোকটা বোবা।
কানেও শোনেনা।
এদের আমরা বলি ‘বোবা-কালা।’
পুরুষ মানুষ তো। বোবাকালা হলেও বিয়ে হয়৷
লোকটাকে বিয়ে করেছিল অথবা লোকটা বিয়ে করেছিল অথবা লোকটার বিয়ে হয়েছিল কোন এক আবাগীর বেটির সাথে।
পুরুষ মানুষ তো।
বছর না ঘুরতে সে বাপও হয়েছিল।
মেয়ে হয়েছিল একটা।
কি সুন্দর ফুটফুটে পরীর মত মেয়ে!
এই বন্দরে বা শহরে কোথাও ছিল তাদের ডেরা।
বোবা কালা লোকটা কারখানায় কাজ করত। তাই দিয়ে চলত টানাটানির সংসার।
লোকটাকে বিয়ে করেছিল বা লোকটা বিয়ে করেছিল যে মেয়েটিকে বা যে নারীটাকে, যে কিনা তার সন্তানের মা হয়েছিল সে একদিন প্রেমে পড়ে গেল পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়ার।
আবাগীর বেটি কদিন আর কষ্ট করবে?
মেয়ে সহ একদিন নিরুদ্দেশ হলো পাশের বাড়ির লোকটার সাথে। উন্নত জীবনের সন্ধান পেয়েছিল কিনা সেই গল্প আমাদের আর জানা হয় না৷
বোবা কালা লোকটার তাহলে কী রইল? কিছুই রইল না।
লোকটা একসময় কারখানা থেকে ফিরে এলে মেয়েটি তাকে আধো বুলিতে ‘বাবা’ বলে ডাকতো।
লোকটা শুনতে পেত না কিন্তু ঠোঁটের নড়নে ঠিক বুঝতো মেয়েটি তাকে ডাকছে ‘বাবা’ বলে।
তার মানে সে বাবা। জন্ম অব্দি এই উচ্চারণের সাথে সে পরিচিত নয়। সে শোনেনি কখনো। বলতে তো পারেইনা। তবু তার অন্তরাত্মায় কোন সফেদ সাদা কাগজে লেখা থাকে লাল সূর্যের মত অক্ষরে একটি শব্দ- ‘বাবা’।
মেয়েটা বড় হয়।
লোকটা তার মেয়েকে একদিন হাত ধরে ইশকুলে নিয়ে যায়। তারপর প্রতিদিন সে ইশকুলে মেয়েকে দিয়ে কারখানায় যায়।
একদিন সেইদিন আসে। যেদিন তার বউটা মেয়েটাকে নিয়ে পালিয়ে যায়।
এই যে তার বউ পাশের বাড়ির সাথে প্রেম করে পালিয়ে যায় তার কন্যাটিসহ, বোবা-কালা লোকটি তখন কী করে?
সে পাগল প্রায় হয়ে যায়। কারণ সে মানুষ। সে বাবা। সে ঠোটের আন্দোলনে উচ্চারিত শব্দের ছবি খুঁজতে থাকে – “বাবা”।
পাগল প্রায় লোকটা রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে, ইশকুলে ইশকুলে ঘোরে তার আদরের মুনিয়ার খোঁজে। তার কলিজার টুকরার খোঁজে।
বোবা কালা লোকটা বাৎসল্যে প্রেমে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে শতগুণ।
লোকটা একটা ইশকুলের দেখা পায়৷ একটা ছোট্টমেয়ে তার মুনিয়ার সমান। মুনিয়ারই মতো দেখতে। ছোট্ট দুই বেনী। ফোলা ফোলা গাল। এরকমই তো। বোবাকালা, বুদ্ধিতে খাট লোকটা মেয়েটার হাত ধরে। তার মুনিয়ার হাত ধরে৷ একদিন দুইদিন তিনদিন সে দেখেই যায়। তার মুনিয়ারই মত। এও কি মুনিয়ার মত ঠোট গুলি নাড়িয়ে বলবে ‘বাবা’!
লোকটা নেশায় পড়ে যায়। ইশকুলের সামনে আবার সে দাঁড়িয়ে থাকে। মুনিয়াকে দেখে দূর থেকে আসছে। এগিয়ে গিয়ে মুনিয়ার হাত ধরে। হাত ধরে ইশকুলে নিয়ে যাবে।
লোকটা যেন কাবুলিওয়ালা। স্কুলে আসা মুনিয়া যেন রবিবাবুর সেই ‘মিনি’। এইখানে সে খুঁজে পায় হারানো কন্যার মুখ। অবিকল। ভালবাসায় চোখ মুছে তার ঝুলে পড়া আস্তিনে। আঙ্গুর আখরোটের মত এক থোকা ভালবাসা তুলে দেয় মুনিয়ার হাতে৷
মুনিয়াও জানে এই লোকটা তাকে ভালবাসে। এও তার আরেক বাবা। মুনিয়ারা এগুলো ভালই বোঝে।
বোঝে না কেবল একদল সুস্থ মানুষ।
লোকটাকে তাদের সন্দেহ। ছেলে ধরা?
“এই এইহানে আইচ ক্যালা?”
লোকটা কথা বলে না, আঁ আঁ করে।
“ঢং ধরচে দেহি।
হালায় বহুত বড় ঘাঘু চিজ।”
আঁ আঁ আঁ।
অভ্যাগত সুধীজনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তারা সমাজের সুস্থ সমর্থ গণ্যমান্য। সমাজে অনাচার রুখতে এসেছে তারা।
সমবেত উৎসুক জনতা ‘ছেলেধরা ছেলেধরা’ বলে বোবা কালা লোকটাকে মারতে থাকে।
মার খেতে থাকে লোকটা।
ক্রোধে উন্মত্ত এক পাল লোকের লাঠির একেকটা আঘাত তাকে নিস্তেজ করে দিতে থাকে।
লাথি মারে কয়েকটা ছেলে।
লোকটার চোখ ফুলে গেছে। রক্ত জমাট বেঁধেছে চোখের এক কোণে। ফোলা চোখে অস্পষ্ট দৃষ্টিতে লোকটা খুঁজতে থাকে মুনিয়া কে।
মুনিয়া কি স্কুলে ঢুকে গেছে?
নাকি দূরে দাড়িয়ে দেখছে
তার বাবার মত বোবা লোকটা অজস্র লাথি ঘা খেয়ে নেতিয়ে পড়েছে রাস্তা নামের মঞ্চে।
“ছেলে ধরা ছেলে ধরা”
লোকটা মরে যাচ্ছে। চেতন অবচেতনের মাঝামাঝি সময়টায় তার চোখের পাতায় ভাসে একটা মেয়ের মুখ। ‘মুনিয়া’।’’