কয়েকদিন আগে আমাদের দেশের লেখাপড়ার জগৎটিতে একটা বড় ওলট-পালট হয়ে গেছে, আমার ধারণা দেশের বেশিরভাগ মানুষ সেটা লক্ষ্য করেনি। বিষয়টা বলার আগে সবাইকে একটু পুরানো দিনের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই।
লেখাপড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে পরীক্ষার ফলাফল। মুখে আমরা যতই বিদ্যা-শিক্ষা বা জ্ঞানার্জনের কথা বলি, দেশের ছেলেমেয়েরা খুব সংগত কারণেই লেখাপড়া করে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্য। এর মাঝে দোষের কিছু নেই, আসলে এই কারণে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর কাজটি খুব সহজ হয়ে যাওয়ার কথা। যেহেতু ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্য খুবই ব্যস্ত তাই পরীক্ষা পদ্ধতিটি যদি খুব ভালো হয় তাহলে তারা নিজে থেকেই নিজের গরজে ভালো লেখাপড়া করে ফেলে। আর পরীক্ষা পদ্ধতি যদি খারাপ হয় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যায়। এই জন্য যখন এই দেশে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে শুরু করেছিলো তখন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিলো।
পরীক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে পরীক্ষার ফলাফল, তাই ফলাফলটি কীভাবে প্রকাশ করা হয় সেটা নিয়ে সারা পৃথিবীর সব শিক্ষাবিদই অনেক মাথা ঘামিয়েছেন। আমাদের দেশে আগে পরীক্ষার ফলাফল তিনটা ভাগে ভাগ করা হতো। প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ এবং তৃতীয় বিভাগ। শতকরা পঁচাত্তর ভাগ থেকে বেশি মার্কস পেলে সেটাকে বলা হতো স্টার মার্ক। এক দুই বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে ফেল করার পর শুধুমাত্র সেই বিষয়ে পরে আলাদা পরীক্ষা দিয়ে পাশ করার উপায় ছিলো, যতোদূর মনে পড়ে সেটার নাম ছিলো রেফার্ড। কাজেই বলা যেতে পারে যারা পাশ করেছে তাদের পরীক্ষার ফলাফল পাঁচটা ভাগে ভাগ করা হতো, স্টার মার্ক, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং রেফার্ড। কেউ কোনো বিষয়ে শতকরা আশি মার্কস থেকে বেশি পেলে সেটাকে বলা হেতা লেটার মার্কস। যারা ফাটাফাটি ধরণের ভালো ছাত্র ছিলো তারা পাঁচ ছয় বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্কস পেতো। তাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিলো না এবং সবাই তাদেরকে সমীহ নিয়ে দেখতো!
ছাত্রছাত্রী যেহেতু তাদের সব বিষয়ের নম্বর জানতো তাই সারা বোর্ডে কে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে সেটা খুব হইচই করে জানানো হতো! যারা প্রথম বিশজনের মধ্যে থাকতো তাদেরকে বলা হতো ‘স্ট্যান্ড করেছে’। কোন স্কুল থেকে কতোজন স্ট্যান্ড করেছে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পরদিন সব খবরের কাগজে বোর্ডে কারা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছে তাদের ছবি ছাপা হতো। বাবা মায়ের সাথে তারা লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে থাকতো এবং তারা কীভাবে এই বিশাল কৃতিত্ব অর্জন করেছে সেটা নিয়ে সাংবাদিকেরা তাদের প্রশ্ন করতেন। (আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ রাজশাহী বোর্ডে দ্বিতীয় হয়েছিলন। সে কারণে রেডিওতে তার নাম বলেছিলো, নিজের কানে রেডিওতে নিজেদের একজনের নাম শুনে আমাদের প্রায় হার্ট অ্যাটাকের মতো অবস্থা হয়েছিলো!)
যাই হোক যারা লেখাপড়া করান তারা খুব ভালো করে জানেন যে একটা ছেলে বা মেয়ের পরীক্ষার খাতায় নম্বর হিসেবে একটা সুনির্দিষ্ট সংখ্যা দেওয়া সম্ভব না। সত্যি কথা বলতে কী একজন শিক্ষককে যদি একই খাতার বান্ডিল দুইবার দেখতে হয় তাহলে তারা দুইবার দুইরকম নম্বর দেবেন। দুবারই অবশ্য যারা ভালো করেছে তারা ভালো নম্বর পাবে এবং যারা খারাপ করেছে তারা খারাপ নম্বর পাবে। কিন্তু কোনোভাবেই হুবহু এক নম্বর পাবে না! (শুধুমাত্র বহুনির্বাচনী কিংবা গণিত বিজ্ঞানের কিছু জায়গায় সেটি সম্ভব, কিন্তু আমি সাধারণভাবে সাধারণ পরীক্ষার কথা বলছি।) শিক্ষাবিদেরা যেহেতু জানেন যে একটা পরীক্ষায় একেবারে সুনির্দিষ্ট নম্বর দেওয়া সম্ভব না তাই তারা নম্বর থেকে গ্রেডে সরে এসেছেন। এখন বলা যায় পৃথিবীর কোথাও পরীক্ষার নম্বর দেয়া হয় না, তার বদলে একটি গ্রেড দেয়া হয়। যদি নম্বর দেয়া হয় তাহলে আমাকে ধরে নিতেই হবে যে শিক্ষার্থী ৮১ পেয়েছে, সে যে শিক্ষার্থী ৮০ পেয়েছে তার থেকে নিশ্চয়ই ভালো। কিন্তু যদি গ্রেড দেয়া হয় তাহলে তারা দুজনে একই গ্রেড পাবে এবং আমরা ধরে নেবো দুজনেই একই রকম ভালো এবং সেটাই অনেক যুক্তিযুক্ত। কাজেই যখন আমাদের দেশে পরীক্ষা গ্রেডিংয়ে চলে এলো তখন আমরা খুব খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু শুরুতেই আমরা একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আগে থেকেই গ্রেডিং পদ্ধতি ছিলো। সারাদেশের সব গ্রেডিং পদ্ধতি একই ধরণের হবে সবাই আমরা সেটা আশা করেছিলাম। কিন্তু অবাক হয়ে আবিস্কার করলাম সেটা ঘটলো না। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের সাথে মিল রেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বোচ্চ গ্রেডিং ছিলো চার, আমরা দেখলাম এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি-তে সর্বোচ্চ গ্রেড হচ্ছে পাঁচ! একই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শুরুতেই গ্রেডিং ভিন্ন করে দেয়া হলো, কেনো এটি করা হলো সেটি আমার কাছে একটা রহস্য।
শুধু যে সর্বোচ্চ গ্রেড ভিন্ন তা নয়, আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে আবিস্কার করলাম প্রতি দশ মার্কসের গ্রেড পয়েন্ট কখনো এক কমেছে কখনো কমেছে অর্ধেক; অর্থাৎ ৮০ মার্কস পেলে গ্রেড পয়েন্ট হচ্ছে পাঁচ; দশ মার্কস কম ৭০ পেলে গ্রেড পয়েন্ট এক কমে চার, আরো দশ মার্কস কম পেলে গ্রেড পয়েন্ট আরও এক কমে তিন না হয়ে হঠাৎ করে সাড়ে তিন। অর্থাৎ গ্রেড পয়েন্ট আর পরীক্ষার মার্কসের সম্পর্ক সরল (linear) নয়, এটি জটিল! এর পিছনে যদি কোনো যুক্তি থাকে তাহলে খুব ভালো, কিন্তু আমি কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না।
তবে যে বিষয়টা সবার জন্যই একটা সমস্যা করেছে সেটা হচ্ছে গ্রেড পয়েন্টের বিভাজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেখানে ফেল গ্রেড ছাড়াও নয়টি ভিন্ন ধাপ আছে, এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি-তে ধাপ মাত্র ছয়টি (A+, A, A-, B, C এবং D)। শুধু তা-ই নয়, যখন ঢালাওভাবে মার্কস দেয়ার কালচার শুরু করা হলো তখন কোনো ছাত্রছাত্রীকে আর গ্রেডের ভিত্তিতে বিভাজন করা সম্ভব না! এ প্লাস পেয়েছে অনেক ছেলে মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় টিকে যাওয়া দূরে থাকুক পাশ মার্কসটিও তুলতে পারে না। বিষয়টা পুরোপুরি হয়ে গেলো আমাদের সময়ের মতো- অর্থাৎ গ্রেড পয়েন্ট হচ্ছে বিভাগ, জিপিএ ফাইভ হচ্ছে স্টার মার্ক, জিপিএ ফোর ফার্স্ট ডিভিশন ইত্যাদি ইত্যাদি!
তখন এই দেশে একটা খুব বড় অন্যায় কাজ করা শুরু হলো, বিষয়টা এতোটা অবিশ্বাস্য যে আমাকে সেটা বিশ্বাস করতেই অনেক সময় লেগেছে। এই দেশের ছেলে মেয়েদের যদিও বলা হয়েছে তাদের পরীক্ষার ফলাফল দেয়া হচ্ছে গ্রেড পয়েন্টে কিন্তু নানা কাজে তাদের পরীক্ষার প্রকৃত নম্বরগুলো ব্যবহার শুরু হলো।
ছেলে মেয়েদের কখনোই তাদের প্রকৃত নম্বর জানানো হয়নি, রাষ্ট্র তাদের কথা দিয়েছে পরীক্ষায় পাওয়া নম্বর নয়, ছয়টি গ্রেডে পয়েন্ট হচ্ছে তাদের পরীক্ষার ফলাফল। কিন্তু সেই নম্বরগুলো ব্যবহার করে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ হতে লাগল। দেখা গেলো দুজন একই গ্রেড পয়েন্ট পেয়েছে কিন্তু একজন বৃত্তি পেয়েছে অন্যজন পাচ্ছে না। কেন অন্যজন পাচ্ছে না সেটা সে কোনোদিন জানতেও পারবে না- কার কাছে এটা নিয়ে নালিশ করবে তারা জানে না। আমি লেখাপড়ার বিষয় নিয়ে পত্রপত্রিকার ওপর ভরসা করা সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিয়েছি। এই দেশে গাইড বই সম্পূর্ণভাবে বেআইনি হবার পরও পত্রপত্রিকাগুলো নিয়মিত ভাবে প্রতিদিন তাদের নিজস্ব গাইড বই ছাপিয়ে যাচ্ছে- এই সংবাদপত্রের ওপর কোন আশায় আমরা ভরসা করবো?
ছাত্রছাত্রীদের অজানা পরীক্ষার নম্বর দিয়ে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপটি আমরা কিছুদিন হলো দেখছি, যখন তাদেরকে বিভিন্ন কলেজে ভর্তি করানো শুরু হলো। আমাদের শিক্ষা সচিবের ব্যক্তিগত অ্যাডভেঞ্চারের ফলে পুরো বিষয়টি একেবারে লেজেগোবরে হয়ে গিয়েছিলো আমরা সেটা সবাই জানি, আমার সেটি নিয়ে বাড়তি কোনো অভিযোগ নেই। একটি ছেলে বা মেয়ে কোন কলেজে ভর্তি হতে পারবে তার সেই সৌভাগ্য (কিংবা দুর্ভাগ্য) নির্ধারণ করা হয়েছে তার পরীক্ষার নম্বরটি দিয়ে যেটি সে জানে না। সেই নম্বর দিয়ে তার গ্রেড পয়েন্ট নির্ধারণ করা ছাড়া আর কিছু করার কথা ছিলো না। একটা রাষ্ট্র তার ছেলে মেয়েদের ওপর এত বড় অবিচার করতে পারে আমি নিজের চোখে দেখেও তা বিশ্বাস করতে পারি না।
আমার মতো আরো একজন নিশ্চয়ই বিষয়টা বিশ্বাস করতে পারেননি এবং তিনি আমার মতো পত্রিকায় কাঁদুনি না গেয়ে হাইকোর্টে রিট করে দিয়েছেন। হাইকোর্ট রায় দিয়েছে যে কোনো ছাত্রছাত্রী বোর্ডের কাছে চাইলেই বোর্ড তাকে তার মার্কশিট দিতে বাধ্য থাকবে। অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীরা তার প্রকৃত নম্বর জানতে পারবে। কেউ যখন তার প্রকৃত নম্বরটি জানতে পারে তখন গ্রেড পয়েন্টটির আর কোনো মূল্য থাকে না! আমার ধারণা এখন এই দেশের সব ছেলে মেয়েই বোর্ডের কাছে প্রকৃত নম্বর চাইতে থাকবে এবং সবাই সেটা জানতে থাকবে। সাংবাদিকরা তাদের পত্রিকায় গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে একটা কথাও লেখেন না, কিন্তু বোর্ড অফিসে ঘোরাঘুরি করে নিশ্চয়ই কোন ছেলে বা মেয়েটি সবচেয়ে বেশি মার্কস পেয়েছে সেটা বের করে ফেলবেন এবং আমরা আবার গর্বিত বাবা মায়ের পাশে লাজুক মুখে দাঁড়ানো সর্বোচ্চ মার্কস পেয়ে ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া ছেলে মেয়েদের দেখতে থাকবো।
খুবই সোজা কথায় বলা যায় আমরা সামনের দিকে এগিয়ে না গিয়ে এক লাফে বিশ বছর পিছন দিকে চলে গেলাম! গ্রেড পয়েন্ট ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমরা পরীক্ষার নম্বরে ফিরে গেলাম!
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি, আর কেউ কি আমার সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন? (চলবে)…