মন্দমতিরা বলে থাকেন “সব সম্ভবের দেশ” বাংলাদেশ। কথাটি খুব যে মিছে, তাও নয়। নইলে দেশের গণতন্ত্র চর্চ্চার সূতিকাগার জাতীয় সংসদ ভবনের সীমানায় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের কবরের জায়গা হয় কি ভাবে? বন্দুকের নল আর গণতন্ত্র, তো পরস্পর সাংঘর্ষিক! আবার লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলার পার্লামেন্ট বিল্ডিং কমপ্লেক্সের মধ্যে আমরা দেখি রাজাকার শাহ আজিজ, সবুর খান, যাদু মিয়ারা সমাধিস্থ! ঘৃনিত রাজাকারদের জন্য এহেন অর্ঘ কেন? আসলে ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন পরবর্তী নোংরা রাজনীতির জঞ্জাল এগুলো।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবনটির নির্মাণ পরিকল্পনা হয়েছিলো পাকিস্তান আমলেই। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে প্রায় ৮০০ একর জমি নিয়ে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। সেই সময়ের খ্যাতিমান স্থপতি এস্তোনিয় বংশোদ্ভুত মর্কিন নাগরিক লুইস ইসডোর কান (লুই কান) এই সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের মূল নকশা প্রনয়ণ করেন।
আর্কিটেক্ট লুই কান বদ্বীপ সদৃশ বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান), এর বিস্তৃত ও প্রসারিত সমভুমি, নদীনালা, জল-কাদা মেশানো ভূ-প্রকৃতি এবং বাংলাদেশের মানুষের যাপিত জীবন অনুধাবন করে সংসদ ভবনের নকশা প্রনয়ণে প্রাণিত হয়েছিলেন। আর সে কারণেই বোধকরি তিনি লেকের জলের উপরেই ভবনটিকে দাঁড় করিয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে মূল ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে তা ১৯৮২ সালে শেষ হয়। ঐ বছরেরই ১৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে ভবনটিতে প্রথম জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসে।
তো লুই কান ভেবেছিলেন যে, জাতীয় সংসদ ভবনটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্র চর্চ্চা বিকশিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা তো সে কথা বলছে না। ভবনটি যেমন জৌলুশে ভরা, দেশের গণতন্ত্রতো তেমন জ্বলজ্বল করেনি কখনও। ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা পরবর্তী রাজনৈতিক পালা বদলে সামরিক এবং আধা সামরিক স্বৈরশাসকেরা সুকৌশলে দেশের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বিরোধিতা করেছে। ওরা চেষ্টা করেছে সামরিক শাসকদের গণতান্ত্রিক ও রাজনীতিবিদ সাজাতে, আর মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদের দেশপ্রেমী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে।
এমন অপচিন্তার অংশ হিসেবেই জাতীয় সংসদ ভবনের সীমানায় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে কবর দিয়ে তাকে “গণতান্ত্রিক” বানানোর চেষ্টা হয়েছে। আর দেশের মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতাকারী শাহ আজিজ, সবুর খান, মশিউর রহমান (জাদু মিয়া) প্রমুখকে সংসদ ভবন এলাকায় কবর দিয়ে, তাদের দেশপ্রেমীর মর্যাদা দেবার চেষ্টা হয়েছে। যে দেশে জিয়াউর রহমানকে গণতান্ত্রিক ভাবা হয়, শাহ আজিজদের দেশপ্রেমী বলার চেষ্টা হয়, -সে দেশ “সব সম্ভবের দেশ” নয় তো কি?
লুই কান তাঁর নকশায় তো জিয়ার কবরের জন্য বা অন্য রাজাকারগুলোর সমাধির জন্য জায়গা রাখেন নি? এরা একেকজন মারা গেলো আর তৎকালীন সরকার সারা দেশে কোথাও মাটি খুঁজে পেল না? এই অগণতন্ত্রী সামরিক-স্বৈরাচার ও স্বাধীনতা বিরোধীদের কবরের জায়গা হলো স্বাধীন বাংলার গণতন্ত্র চর্চ্চার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান “সংসদ ভবনের” চারপাশে! এমন রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক দুর্মতি কেবল মাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব!
জাতীয় সংসদ ভবনটি শুধুমাত্র বাংলাদেশেরই নয়, এটি পৃথিবীর অন্যতম একটি নান্দনিক স্থাপত্য নিদর্শন। এই অমর সৃষ্টিটি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। মূল নকশা এবং ভাবনা অনুযায়ী এর কৌলীন্য রক্ষা অপরিহার্য। বাংলাদেশের সামরিক সরকারগুলো এবং বিএনপি-জামাত জোট সরকার দফায় দফায় লুই কানের মূল নকশা ক্ষত-বিক্ষত করে সংসদ ভবন সীমানার মধ্যে সম্মেলন কেন্দ্র, মাজার, সমাধি, উচ্চ পদস্থদের বাস ভবন, ইত্যাদি নির্মাণ করেছে। এতে করে ভবনটির ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত হয়েছে এবং নান্দনিকতা বিঘ্নিত হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার লুই কানের মূল নকশা বহির্ভূত সকল স্থাপনা সরিয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের সৌন্দর্যকে জঞ্জালমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় কি? এতো অনেক বড় সুসংবাদ! কিন্তু হয়েছে কি, আবার সেই মন্দমতিরা সরকারি এই উদ্যোগের “সততা” নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছে! তারা ভাবছে যে জিয়ার কবরটি সরানোর জন্যই এত শত আয়োজন! ওটি গুড়িয়ে দেওয়া গেলে মূল নকশার বাকি বিচ্যুতি নিয়ে সরকারের বিশেষ মাথা ব্যথা থাকবে না। তো এমন একটি উদ্যোগের সূচনায় ঐ মন্দমতিরা (!) সন্দিহান কেন? কেন সরকারের উপর মানুষ ভরসা রাখে না? সরকারকেই তার কারণ খুঁজতে হবে।
১৯৮১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হবার পরে তাকে জাতীয় সংসদ ভবনের পার্শ্বে সমাহিত করার সিদ্ধান্তটি ছিলো তৎকালীন বিএনপি সরকারের একটি দুরভিসন্ধি। জাতীয় সংসদ ভবনের সীমানাতো গোরস্থান নয়! তাহলে সেখানে জিয়াকে কবর দেবার উদ্দেশ্য কি? আসলে তৎকালীন বিএনপি সরকার চেয়েছিলো যে, সংসদ ভবনের পার্শ্বে জিয়াকে কবর দিয়ে তাকে গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। তারা আরো ভেবেছিলো যে, জিয়ার সমাধিকে মাজার বানিয়ে, জিয়ারত কেন্দ্রিক রাজনীতি করে কোমলমতি দেশবাসীর চোখে ধুলো দেবে এবং রাজ ক্ষমতায় টিকে থাকবে। অবশ্য তাদের সে চেষ্টার সফলতাও কিন্তু কিছু কম নয়!
জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্সটিকে তার মূল আদলে ফিরিয়ে আনতে হবে, -এ নিয়ে কোন কুতর্ক নয়! সরকারের এ কাজের প্রতি দেশের মঙ্গলকামী ও সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষের সমর্থন থাকবেই। তবে সরকার যদি সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য রক্ষার মানসিকতায় এ সিদ্ধান্ত না নিয়ে থাকেন, যদি রাজনৈতিক কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য এমন সিদ্ধান্ত গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়, -তবে মঙ্গলকামী মানুষেরা বড়ই মর্মাহত হবেন। বর্তমান সরকারে এ ধরণের পূর্বাপর কর্মকান্ডের নজির থেকে এমন সন্দেহ করার সুযোগ রয়েছে বৈকি?
স্মরণ করি, ঢাকার বর্তমান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরটি ১৯৮০ সালে “ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট” নামে যাত্রা শুরু করে। তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে ক্ষমতাসীন বিএনপি সেটির নাম করণ করে “জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট”। এই নামকরণ অসৎ উদ্দেশ্য প্রভাবিত এবং নোংরা রাজনীতি তাড়িত। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক এবং নজিরবিহীনভাবে তিনি একই সাথে দেশের সেনা প্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির পদও জবর দখলে রেখেছিলেন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য জিয়া সব থেকে ক্ষতিকর উপাদান। তার নামে দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নামকরণ হওয়াটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি সরকার সব বুঝেসুঝেই সেই অপকর্মটি করেছিলো।
একটি অপকর্মকে আরেকটি অপকর্ম দিয়ে প্রতিস্থাপন করা অনুচিত। দেশ ও সমাজের জন্য সেটা অকল্যাণকর। আসলে এতে করে দুটি অপকর্মের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। আমরা দেখলাম ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার রাতারাতি ঐ এয়ারপোর্টের নাম থেকে “জিয়া” মুছে দিয়ে “হজরত শাহজালাল” লিখে দিলো। নতুন নামকরণ হলো “হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর”। সাধক ও ইসলামের প্রচারক, সর্বজন সম্মানিত হজরত শাহজালাল (র:) অতি উঁচু মাপের ব্যক্তিত্ব। তাঁর নামে বাংলাদেশে একটি কেন, পাঁচটি এয়ারপোর্ট বা শত স্থাপনা হতেই পারে। কথা সেখানে নয়। কথা হলো, আওয়ামী লীগ সরকার এই নাম পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় হজরত শাহজালাল (রহ:) এর প্রতি কতখানি ভক্তিমার্গে উদ্বুদ্ধ ছিলেন? নাকি তারা রাজনৈতিক স্বার্থে সেদিন এই সুফি সাধকের নামটি ব্যবহার করেছিলেন?
দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের বৃহৎ অংশের মানুষ বিশ্বাস করে যে, জিয়াউর রহমানের নামটি মুছে ফেলতেই শাহজালাল (র:) নামকে সেদিন ব্যবহার করা হয়েছিলো। তো এ ক্ষেত্রে জিয়ার নামটি লেখা এবং মুছে ফেলা দুটোই বড় দুটি রাজনৈতিক দলের দুরভিসন্ধি থেকে উৎসারিত, এর কোনটিই কাম্য নয়। আওয়ামী সরকারের এটা পূর্ব-বিবেচনা ছিলো যে, জিয়ার নাম বাদ দিলে একশ্রেণীর দলকানা রাজনৈতিক লোকজনের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। আবার বিএনপিও এ নিয়ে দেশ জুড়ে হরতাল-হাঙ্গামা বাধিয়ে বসতে পারে। তাই সুকৌশলে সরকার শাহজালাল হুজুরের নামটি জুড়ে দিয়ে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পক্ষে রেখেছে এবং বিএনপিকে জব্দও করেছে। একেবারে এক ঢিলে চার পাখি মেরে দিয়েছে আওয়ামী লীগ! বুদ্ধির (!) তারিফ করতেই হয়!
লুই কানের মূল নকশা অনুযায়ী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন তার আসল আদলে ফিরে আসুক, এই কামনা সকল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের। আমরা দেশের এই নান্দনিক স্থাপনাটির নন্দনশৈলীর দ্যুতি দেখতে চাই। তবে এই প্রক্রিয়ায় আবার যেন সেই রাজনৈতিক সংকির্ণ প্রতিহিংসা আমাদের দেখতে না হয়। সরকারের সৌন্দর্য়প্রিয়তা এবং সদিচ্ছা প্রমাণের এটি একটি সুযোগও বটে! কামনা করি, সোচ্চারে এবং অবচেতনে সর্ব মহলের সুমতি হোক!
(নিবন্ধের কিছু তথ্য অনলাইন আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)