কীভাবে বাঁচবেন, কী খাবেন, কী পরবেন- সেটা সম্পূর্ণই ব্যক্তির অধিকার। কিন্তু এত সবকিছুর পরও অনধিকার চর্চা অনেকের অভ্যাস। বাহ্যিক সৌন্দর্য্য নিয়ে কটাক্ষ নতুন নয়। হরহামেশায় অনেকেই অন্যের শরীর নিয়ে অসম্মানজনক মন্তব্য (বডি শেমিং) ছুড়ে দেন। সোশাল মিডিয়ার বদৌলতে এই বদঅভ্যাস দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষত শোবিজ অঙ্গনের মানুষেরা এমন কটাক্ষের শিকার হন বেশি।
এবার এ বিষয়টি নিয়ে মুখ খুললেন দেশের জনপ্রিয় হেভি মেটাল ব্যান্ড আর্টসেল এর ভোকালিস্ট লিংকন এর সহধর্মিনী মিমোসা লিমু হাওলাদার। জনপ্রিয় হলেও লিংকনকে প্রায় সময়ই বডি শেমিংয়ের শিকার হতে হয়। বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার লিমু।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিংকনের বডি শেমিংয়ের শিকার হওয়া নিয়ে দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাস দেন। যেখানে লিংকনের সাথে পরিচয়, ভাল লাগা এবং ভালোবাসার কথা আছে। জানিয়েছেন, শুরুর দিকে লিংকনের স্থুলতা নিয়ে নিজেও বান্ধবীদের সঙ্গে হাসাহাসি করেছেন। কিন্তু যখন তার কাছাকাছি আসতে শুরু করেন, তাকে বুঝতে শুরু করেন, তখন ভুল ভাঙে তার। অন্যভাবে লিংকনকে আবিষ্কার করেন লিমু।
সেই অভিজ্ঞতার কথা তিনি জানিয়েছেন এভাবে, ‘আমার আর লিংকনের বিয়েতে আমার পরিবার থেকে কারো সম্মতি ছিলো না, আমি কোর্ট ম্যারেজ করার আগে আমার বাড়িতে জানিয়েছিলাম আমি কাকে বিয়ে করতে চাই, রাজি না হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক একটা সাধারণ পরিবারের জন্য। আমি নিজেও প্রথমে রাজি হইনি যখন লিংকন প্রথম আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, এমনকি আমি আর আমার বান্ধবী হাসাহাসি করেছি এতো মোটা হয় কীভাবে মানুষ! ১২৩ কেজি ওজন! আবার আমার চেয়ে ১৫ বছরের বড়!’
লিমু বলেন, ‘কোনভাবেই রাজি ছিলাম না, কিন্তু মানুষটা আমার খুব কেয়ার করতো, আমি যে হোস্টেলে থাকতাম সেখানে খাবার একটু ভালো ছিলো না। সে বরাবরই চাইতো আমার জন্য রান্না করে পাঠাতে, আমি না করতাম। আমার এতো বেশি কেয়ার করতো যা আমার বাবা-মা ছাড়া কারো কাছে কোনদিনই পাইনি আমি, বেশিরভাগ জায়গায় আমি সবার কাছে অপ্রিয়, আত্মীয়স্বজনের কাছে ‘ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো’ আমি এটা বরাবরই বলি, এবং সব বুঝেও যথাসাধ্য চেষ্টা করি কেউ সাহায্য চাওয়া মাত্র সাহায্য করতে, কিন্তু তবুও কারো প্রিয় হতে পারিনি যতোটা কম সময়ে প্রিয় হয়েছি লিংকনের কাছে।’
‘যাই হোক কথা বলতে বলতে তার জীবনের দুঃখের কাহিনীগুলো জানলাম, বিয়ে করার কথা জিজ্ঞেস করলে বললো আমি তো মোটা, কে বিয়ে করবে। তুমি নিজেও তো রাজি হওনি! কষ্ট চেপে রাখতে ড্রিংক করতো প্রতিদিন রাতে, আপনাদের এই সদা হাস্যোজ্বল, যেখানে যায় সবাইকে হাসায়, স্টেজে গেয়ে কত আনন্দ দেয় সবাইকে তার মনে কতোটা কষ্ট ছিলো কে তার খোঁজ জানে! মোটা হওয়াটা কেউ ইচ্ছে করে হয় না, কেউ খুশিতে বা খেয়েই শুধু মোটা হয় না, ওবেসিটি নামে একটা রোগ আছে যে কারণে মানুষ মোটা হয়। আমার মনে খুব নাড়া দেয় মানুষটার কষ্টের কথাগুলো আর আমার প্রতি তার ভালোবাসা, যত্ন। আর যে কষ্টের কারণে একটা মানুষ প্রতিটা দিন ড্রিংক করে নিজের জীবনটা শেষ করে দিচ্ছিলো তা ছিলো একাকিত্ব।’- লিংকনকে নিয়ে বলছিলেন লিমু।
লিংকনকে বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা লিমু বললেন এভাবে, ‘আমি ঠিক করলাম আমি এই মানুষটার জীবন এভাবে শেষ হয়ে যেতে দিবো না, আমার সঙ্গ যদি তাকে স্বাভাবিক জীবন দিতে পারে তাহলে তাই হোক, আর এতোটা ভালো আমাকে কেউ বাসবে না। সত্যি বলতে আমি নিজেও কখন মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলেছি বা তার প্রতি আমার একটা অন্যরকম ভালোবাসা তৈরি হয়েছে বুঝতে পারিনি। আমার পরিবারকে তার কথা জানালাম, কেউ মানবেনা জেনেও। অতঃপর সিদ্ধান্ত নিলাম কোর্ট ম্যারেজের, কারণ এছাড়া কোন উপায় ছিলো না আমাদের হাতে। হ্যাঁ, মোটা জেনেই আমি তাকে ভালোবেসেছি, কারণ এই মোটা মানুষটাই আমাকে আগলে রেখেছে।’
বডি শেমিং নিয়ে সোচ্চার লিমু বলেন, ‘আপনারা অনেকেই যখন আমাকে বলেন ভাবী/বৌদি লিংকন ভাইকে কম খেতে বলেন, কন্ট্রোল করতে বলেন, ভোটকা, ডায়েট করতে বলেন, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হতে বলেন, এসব আসলে আপনাদের লিংকনের প্রতি কেয়ার না এগুলো এক প্রকার বডি শেমিং। বডি শেমিংয়ের মতো জঘন্য কাজ আপনারা করেন, যেটা আমি নিজেও না বুঝে করতাম। এখন লিংকনের সাথে মেশার পর বুঝি একটা মানুষ ইচ্ছা করে মোটা বা চিকন, ফর্সা বা কালো, বেটে বা লম্বা হয়না, আমরা কেন তাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করবো?
ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে লিমু বলেন, ‘আপনারাই বলেন লিংকন আপনাদের লিজেন্ড, আবার নিজেরাই ওর মোটা হওয়া নিয়ে হাসাহাসি করেন।’
যারা মানুষকে নিয়ে অযাচিত মন্তব্য করে, তাদের উদ্দেশে লিমু বলেন, ‘শুধু লিংকন নয় আমার এই পোস্টের পর আশাকরি কেউ আর মোটা, চিকন, বেটে, লম্বা, ফর্সা, কালো মানুষগুলোকে হাসি বা উপদেশ দেওয়ার মাধ্যমে ছোট করবেন না। কারণ তারা নিজেরাই জানে তাদের কী করা উচিত, সবাই এক সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট তাই আমরা সবাইকে সম্মান করতে শিখি প্লিজ। আর প্রতিটা মানুষই কারো না কারো ভালোবাসার মানুষ, আর ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে কেউ যখন হাসাহাসি করে তখন সেটা ভালো লাগে না।’