সংস্কৃতির অনেকটা ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে গেছে এই ভুবনায়নের সময়ে মিথ্যার রূপায়নে। সংস্কৃতি উত্থিত হয় স্থানিক-লগ্নতায়, বিকশিত হয় মানুষের কর্ষণে-প্রকৃতির বর্ষণে; সংস্কৃতি প্রভাবিত হয়, জারিত হয়, সঞ্চালিত হয়; সংস্কৃতি না বাঁচলে সভ্যতা টিকে থাকে না।
এই আবহে একটি জরুরি গ্রন্থ আমাদের জন্য রচনা করেছেন মহসিন শস্ত্রপাণি। তাকে জানাই লাল গোলাপ শুভেচ্ছা। এই রকম একটি গ্রন্থের প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভবে ছিল।
নি:সন্দেহে গ্রন্থ ‘লাল পতাকার নিচে সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ আমাদের সাংস্কৃতিক দস্তাবেজের হাতিয়ার। আমাদের শোভিত করে শেঁকল ভাঙার ব্রতে উজ্জীবিত হতে অস্ত্রটির প্রস্তুত প্রণালী দাখিলের জন্য মহসিন শস্ত্রপানি ধন্যবাদ পাবেন এবং প্রকাশক পড়ুয়ার, কবির আহমেদ- প্রিয় কাজল সাধুবাদ গ্রহণ করবে অন্ত:স্থল হতে। গ্রন্থটি পড়ার পর মনে হলো- এই পাঠের জন্য অপেক্ষা করেছি দীর্ঘকাল। সময়ের দাবি মেটানো গ্রন্থটি শ্রমজীবী মানুষের নেতৃত্বে জনগণের সমাজ বদলের আকাঙ্ক্ষায় পরিচালিত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথে শক্তি যোগাবে নিশ্চিত।
ষাট দশক হতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মহসিন শস্ত্রপাণি একজন পুরোধা পুরুষ। লেখনী চালিয়ে এসেছেন আদর্শিকভাবে। অন্তর্নিহিত তাগিদে রয়েছে সামাজিক দায়বোধ। এই সাহিত্য আন্দোলনের যোদ্ধা মহসিন শস্ত্রপাণি গল্প-উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন এবং দায়িত্ব নিয়েছিলেন ‘ক্রান্তি’, ‘উন্মেষ’, ‘গণসংস্কৃতি ফ্রণ্টসহ’ অন্যান্য সংগঠনের। তিনি লেখক ও সংগঠক।
মৃত্যু পথযাত্রী আমাদের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে পুনর্গঠন, পুনরুজ্জীবন এবং বেগবান করার জন্য তাকে দিয়ে তার যোগ্য মনন ও কলম ক্রমাগত উজ্জ্বল অরপাতের মধ্য দিয়ে ‘প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন কি মরে যাচ্ছে?’ -এই প্রশ্নের উত্তর হানতে সময় যেন লিখিয়ে নিল আগামীর পাথেয় উঠুক এই সেই গ্রন্থ ‘লাল পতাকার নিচে সাংস্কৃতিক আন্দোলন’। আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, আমাদের তৃষ্ণার জল, আমাদের অবিরাম করতালি মুখর ঝাণ্ডা ওঠাবার সু-লগ্ন বয়ে আনবে এই গ্রন্থের অসীমায়িত তরঙ্গে। -ইনকিলাবি সত্তা ও স্মরণ নিয়ে এই গ্রন্থ আয়োজন পাঠকমাত্রকে করবে প্রাণিত।
সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন অশুভ শক্তির কাছে আতঙ্কজনক বলেই বেনিয়াতন্ত্রের ধারক-বাহক রাষ্ট্র ও সুবিধাভোগী শ্রেণী ফ্যাসিস্ট জমানা থেকে বর্তমান পর্যন্ত বন্দুক নিয়ে তাড়া করেছে। ‘When I hear the word Culture, I cock my revolver’। নাজী নাট্যকার Johst-এর উক্তিটি এ প্রসঙ্গে মনে পড়তে পারে।
সংস্কৃতি সব সময় গণশত্রুদের কাছে হুমকি স্বরূপ, কারণ সমাজের রূপান্তরের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রভাবক ভূমিকা রাখতে সম। এমন কি হয়ে ওঠে অস্ত্র।
ধনবাদী ব্যবস্থায় দেশের আপামর গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষকে শৃঙ্খলিত করবার জন্য একদিকে গণতান্ত্রিক পরিসরকে ধূসরিত করা হচ্ছে অপরদিকে বিকৃত ও বিভ্রান্ত করে দেয়া চলেছে সভ্যতার উন্মেষ থেকে আজ পর্যন্ত প্রবহমান সংস্কৃতির অন্দর-বাহির।
পহেলা ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবিরের তৃতীয় সম্মেলনের গৃহীত ঘোষণাপত্রে যথার্থ বলা হয়েছিল যে, সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন গঠন করা অপরিহার্য। কারণ, ‘সমাজ পরিবর্তনের জন্য জনগণের এই সংগ্রাম মূলত: রাজনৈতিক হলেও এর একটি সাংস্কৃতিক দিকও আছে এবং সামগ্রিক সংগ্রামের ক্ষেত্রে এই সংগ্রামের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে রাজনৈতিক প্রচেষ্টার সমান্তরাল যদি কোনো সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা না থাকে তাহলে সে রাজনৈতিক সংগ্রাম কখনো পরিপক্কতা অর্জন করতে পারে না, তার দ্বারা কোনো চূড়ান্ত সাফল্য আসতে পারে না।’ এই গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য সংযোজন ‘পরিশিষ্ট’ পর্ব, যেখানে সন্নিবিশিত হয়েছে অগ্যঁ পতিয়ে বিরচিত অমর আন্তর্জাতিক- “জাগো জাগো জাগো সর্বহারা/ অনশন বন্দী ক্রীতদাস, শ্রমিক দিয়াছে আজি সাড়া/ উঠিয়াছে মুক্তির আশ্বাস।” (বাংলা: মোহিত ব্যানার্জী)।
এছাড়াও প্রগতিশীল লেখক সংঘ নিখিল ভারতের ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠিত লক্ষ্ণৌ সম্মেলনের মেনিফেস্টোসহ ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ১৯৪৩-এর প্রকাশিত বুলেটিন প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ, সৃজনী, উদীচী, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রণ্টের ঘোষণাপত্র, নীতিমালা ও কর্মসূচীর সংকলন। এখানে আমরা যে বার্তা শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারি, তা হলো, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জাতীয় জীবনে অনাচার ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ নৈরাজ্যকর, হতাশাজনক বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে আমাদের দেশে একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে পথ বাতলানো রয়েছে জনগণ মুক্তির জন্য। বুর্জোয়া নৈতিকতাকে হটিয়ে দিয়ে যেমন একটি সমাজতান্ত্রিক নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন জ্ঞানে, অনুশীলনে ও সংস্কৃতিতে বুর্জোয়াদের অর্জনকে অতিক্রম করে নতুন উচ্চতা অর্জন।
অধ্যাপক আহমদ শরীফ ‘সংস্কৃতি’ নিয়ে যে আলাপ করেছেন তা থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, সংস্কৃতি মানুষের ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও সর্বোপরি মানসিক জীবনের একটি আবশ্যিক ও জরুরি বিষয়। সুতরাং সংস্কৃতি হচ্ছে মনুষ্যত্বেরই নির্যাস; মনুষ্যত্বের বা মানবতার প্রতীক, প্রতীম, প্রতিভূ বা প্রতিরূপ। সংস্কৃতির উৎস মানব মনীষা: ব্যক্তিক ভাব-চিন্তা-মন-মনন-মনীষার উদ্ভাবন ও আবিষ্কার। অমর আত্মাবাদীদের ইহজাগতিক ও পারত্রিক জীবন সম্বন্ধীয় শ্রেয় ও শ্রেয়-চেতনার সামষ্টিক রূপ ও রূপের বিভিন্ন বিচিত্র অভিব্যক্তি হচ্ছে সংস্কৃতি। ধারণা করা হয়, সংস্কৃতির ১৬৪টি সংজ্ঞা দুনিয়া জুড়ে চালু আছে। কোনও সংজ্ঞা বাতিল হয় নাই, কেউ গ্রাহ্য বা অগ্রাহ্য করে নাই; কোনও সংজ্ঞার সমর্থক বেশি, কোনও সংজ্ঞা সমর্থন আদায় করতে পেরেছে নগণ্যের। আহমদ শরীফ স্যার বিশদ আলোচনা করেছিলেন সংস্কৃতির।
মার্কসবাদীরা রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শের নিরিখে সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে শোষণ মুক্তির সন্ধান করেছেন। সমষ্টি ও ব্যক্তির আদর্শের মধ্যে রাজনৈতিক সাজুজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিয়েছেন। নয়া মার্কসবাদী তাত্ত্বিকগণ আদর্শ থেকে সংস্কৃতিকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ব্যক্তি সাংস্কৃতিক যে কোনও বিশ্লেষণকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। অবয়ববাদীরা ইতিহাস থেকে সংস্কৃতিকে মুক্তি দিয়েছেন এবং সমাজ-সংস্কৃতি ধারণার সূচনা করেছেন। তারা সমাজ ও প্রথাকে নিয়ামক হিসেবে মেনেছেন। উত্তর অবয়ববাদীরা ইতিহাস, প্রথা, পরম্পরা, সমাজ, গণতন্ত্র প্রভৃতি সব উপাদান হতে সংস্কৃতিকে মুক্তি দিয়েছেন। উত্তর আধুনিকতাবাদকে উত্তর অবয়ববাদ তত্ত্বের সাংস্কৃতিক প্রকাশ বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।
ব্রিটিশ সমাজ-তাত্ত্বিক রেমণ্ড উইলিয়ামস সংস্কৃতির সংজ্ঞা প্রণয়ন প্রসঙ্গে কয়েকটি ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন- (ক) মন বা মননের ব্যক্তিগত প্রয়াস (খ) সমগ্র সমাজের বৌদ্ধিক বিকাশের অবস্থা (গ) শিল্প এবং সবশেষ (ঘ) মানুষের সাময়িক জীবন ধারা।
অ্যানথনি স্মিথ সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন- সংস্কৃতি হল ঐতিহ্য-বিশ্বাস-সামাজিক মূল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব এবং নিজস্ব ভূমির এক অত্যাশ্চর্য মেল বন্ধন।
সব সংজ্ঞা বিশ্লেষণের ধারাক্রমে ইতো:মধ্যে সুবিবেচিত হয়েছে যে, সংস্কৃতি কথাটির সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার হয়েছে মানুষের মুক্তি বা স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
রাজনীতি ছাড়া সংস্কৃতির গবেষণা অসম্ভব।পরবর্তীকালে সংস্কৃতি বলতে মার্কিনি পপুলার সংস্কৃতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; পপুলার সংস্কৃতি মার্কিনি জাতি-ভাবনা, জাতিসংস্কৃতি, লিঙ্গ ও সেকসুয়ালিটির সমন্বয়ে সমাজে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ সৃষ্টি করেছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে গণসংস্কৃতির উন্মেষ ও জনগণের সংস্কৃতি নয়া-ভোগবাদী বিশ্বায়ন পর্বে সম্পূর্ণ অর্থ বদলে পপুলার সংস্কৃতিতে পর্যবসিত হয়েছে। পপুলার সংস্কৃতির বদৌলতে গণসংস্কৃতির অর্থ বদলে গেছে। বর্তমানে গণসংস্কৃতি ও কর্পোরেট আধিপত্য আলোড়িত সংস্কৃতির মধ্যে তফাৎ করা যায় না।
গণমাধ্যম সম্প্রচারিত বাণিজ্যিকভাবে সফল মূল স্রোতের সংস্কৃতি যে কোনও উপায়ে আজ পপ্ সংস্কৃতি।
বর্তমান বিশ্বায়ন পর্বে গণমাধ্যম সম্প্রচারিত নয়া ভোগবাদী সংস্কৃতি ধনবাদী কাঠামোর সম্প্রসারিত রূপ। পণ্যের উৎপাদন হচ্ছে ধনবাদী কাঠামোর মূল ভিত্তি। ফলে বিশ্বে চলমান পণ্যায়নই নয়া-ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রধানতম উপজীব্য। এই নয়া ভোগবাদী সংস্কৃতি আবার জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে সরিয়ে পপ্ সংস্কৃতির আসন দখলের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক সংস্কৃতির বিবিধ শংকরায়ন সম্পন্ন করছে।
চরিত্রগত কারণে ভোগবাদী সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ধনবাদী বলেই বাজার কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ভোগবাদী সংস্কৃতিই প্রধান। ব্যক্তি মানুষের ভোগ করার প্রবণতা/আকুতি/অংশগ্রহণের ফলে ভোগবাদী সংস্কৃতির রমরমা। এই সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে বাজার অর্থনীতিতে ব্যক্তিসত্তার সংজ্ঞায়ন হয়েছে। তাই এই ভোগবাদ ভিত্তিক সংস্কৃতি মানুষের সামাজিক অস্তিত্বকে নস্যাৎ করেছে।
রাজনৈতিক অর্থনীতি, মার্কসবাদী এই বিশেষ জ্ঞানতত্ত্ব অনুযায়ী জ্ঞাত সত্য এই যে, সমাজ ও অর্থনীতিতে এলিট শ্রেণী তাদের প্রবল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক মতা ও প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে মিডিয়া বাহিত সংস্কৃতির উদ্যোগ কায়েম করেছে।
কর্পোরেট পরিচালিত এসব সংস্কৃতির কল্যাণে বিভিন্ন দেশের আঞ্চলিক সংস্কৃতি খর্বিত এবং শংকর সংস্কৃতির প্রবল বিষ্ফোরণে সংস্কৃতির সদা গতিময় তত্ত্বের আড়ালে স্থানিক মানুষের সামাজিক কর্ম প্রক্রিয়া ভু-লুণ্ঠিত হওয়ায় ঐতিহ্য-বিশ্বাস-মূল্যবোধ-ভূমির আনুগত্য, নিয়ম আচার অরার ফলে কোনও মানুষের ব্যক্তিক ও সামষ্টিক সত্তা, নিরাপত্তা অনিশ্চিত যাত্রায় হারিয়ে যায়, বিপন্ন হয়।
এই রকম সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতিতে- সংস্কৃতিক উপদ্রুত দশাকে মোকাবেলা করতে, বাংলায় ফিরে আসবার জন্য, ভোগবাদের সন্মোহনী শক্তি রুখতে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে যতটা লাভালাভ তার চেয়ে আত্মশক্তির উদ্বোধনে রয়েছে অজস্র সমতা, কার্যকারিতা; এই জন্য সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সফলতা রাজনৈতিক গণ-আন্দোলনের সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিল্পের সকল শাখায় সাম্রাজ্যবাদী, বুর্জোয়া ও পশ্চাৎপদ সামন্তবাদী সংস্কৃতির অশুভ প্রভাব উচ্ছেদে সচেতন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিকল্প থাকতে পারে না- এই সত্য যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধ হবে তত অনিবার্য হয়ে উঠবে মহসিন শাস্ত্রপানি’র ‘লাল পতাকার নিচে সাংস্কৃতিক আন্দোলন’। পুনরুক্তি হলেও অনস্বীকার্য যে, আমাদের আগামী দিনের গণ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য পাথেয় বলে বিবেচিত হয়ে ওঠার স্বচিহ্ন বাস্তবতা রয়েছে।
আমরা প্রত্যাশা করি না, বাংলার মাটি, বাংলার জল পণ্য হউক। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির স্বার্থ রক্ষা করাটা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে কোনও মানুষের আশু কর্তব্য। আত্মপরিচয় সম্পর্কে সচেতন হওয়া সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার প্রধান শর্ত। ভাষা ও সংস্কৃতিকে নষ্ট করে দেয়ার জন্য গণমাধ্যম এবং পরাক্রমশীল ইণ্টারনেট-এর জালিকা বিন্যাস আমাদের অস্তিত্বের রক্তবাহী শিরা-ধমনী বিন্যাসকে প্রতিস্থাপিত এবং নতুনভাবে সংরক্ত করছে।
এই দুস্তর পারাবার মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় রণকৌশল ও নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের জন্য বিপুল যে প্রস্তুতি আবশ্যক, তাতে অতীত সংগ্রামের নান্দীপাঠ যেমন অন্যতম উপকরণ এবং তাকে সাঁয় দিতেই গ্রন্থটি ভূমিকা রাখতে সক্ষম এই কারণে যে, ‘লাল পতাকার নিচে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের’ বর্ণিত রেখাচিত্র যদি ভবিষ্যতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীদের আরো অনুসন্ধান ও শিক্ষার্জনে এবং উদ্যম ও সাহসের সাথে সংগটিত হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে তাহলেই এটি আঁকার চেষ্টা সার্থক হবে। এই আঁকা রূপরেখার অংকন।
মহসিন শাস্ত্রপানি এই আশাবাদ রেখেছেন বলেই আমরা লাল পতাকার সংগ্রাম সাময়িক হটকিয়েছে জেনেও যারা বিগত সেই সব আলোর পথযাত্রীকে অনুসরণ এবং সূর্য ছিনতাইয়ের স্বপ্ন দেখেন তাদের জন্য এই গ্রন্থের মর্মবাণী উজ্জ্বল ও আনন্দময় ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করবে।
শ্রেণী বিভক্ত দেশ-কাল, সমাজে অনিবার্য রকম এই সংগ্রাম- অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্বয়যুক্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরাভূত হতে পারে না।
এই গ্রন্থ পাঠে আমাদের নাড়া দেয় উদ্ধৃত ও বিবৃত দ্রুত-রেখ কেস স্টাডি এবং পরিশিষ্টে বিন্যস্ত তদানীন্তন নানা প্রকার রূপকল্প। সেখানে পরিলিপ্ত আছে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজ বদলের পক্ষে সেই সব আন্দোলনের যন্ত্রণা ও মন্ত্রণা- যা কিনা হতাশাবাদীর জন্য একরূপ কিন্তু আশাবাদীদের জন্য নিরন্তর প্রণোদনা এই যে, প্রভাত পট্টনায়কের ভাষায় বলতে হয়-
“প্রকৃত বিষয় এই নয় যে, আজ বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে বিরোধিতা থাকবে কিনা। বিষয়টি হলো, বিরোধিতাটা কী রূপ নেবে। সৃষ্টিমূলক, না ধ্বংসাত্মক। বিশ্বায়নের বর্তমান প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সৃষ্টিমূলক বিরোধিতার দায়িত্ব মার্কসবাদী প্রগতিশীল নেতৃত্বকেই নিতে হবে।”
মহসিন শস্ত্রপানি, এই গ্রন্থে অনেক প্রয়োজনীয় কথা এবং জটিল পরিস্থিতি সহজভাবে সকলের বোধ্যস্তরে পৌঁছে দেয়ার কুশলতা দেখিয়েছেন।
আমরা আবিস্কার করব ইউজিন পতিয়েকে- কি আশ্চর্য, লিখেছিলেন, শ্রমজীবী মানুষের জন্য আন্তর্জাতিক।
রুশ ও চীন দেশের সাংস্কৃতিক-শিল্প-সাহিত্য পরিক্রমায় উঠে এসেছে নানা আবর্তন-নিবর্তন ও প্রবর্তন। রুশ দেশের বিপ্লবের উদ্দীপনা সঞ্চারিত হয়েছিল চীনে। সেখানে হয়েছিল, সর্বহারার সাংস্কৃতিক মহাবিপ্লব- তাও আমাদের চেতনায় পলেস্তারা খসিয়ে দেয়। আদি ইটের রক্তের দাগ দেখি। জাগি।
ভারত উপমহাদেশে- দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে কাজী নজরুল নামের বাঙালি কবি গেয়ে উঠলেন সাম্যের গান। তিনিই তো ছিলেন সর্বহারা শ্রেণীর নিপীড়িত জনগণের কবি। প্রগতি লেখক সংঘ উত্তর থেকে পূর্বে কীভাবে বাংলায় অত:পর শোণিত চঞ্চল করেছিল প্রিয় পূর্ব পুরুষদের- তা আমাদের জন্য ইঙ্গিতবহ এবং ছক কষে নেয়ার পূর্ব সমীক্ষা।
ঢাকায় প্রগতিশীল লেখক সংঘের ফ্যাসিস্ট বিরোধী সাংস্কৃতিক উদ্যোগ ও সোমেন চন্দের আত্মহুতির মধ্য দিয়ে তিনি যেমন ছিলেন ঢাকায় প্রথম শহীদ লেখক, তেমনি তাকে পাঠ করে অর্জন হবে আবার নতুন স্বপ্নবীজ, রক্তবীজ। গণনাট্য সংঘে ছিলেন খাজা আহমদ আব্বাস। বিজন ভট্টাচার্য এখনও নবান্ন হয়ে আছেন। সিলেটে পার্টির নির্দেশে হেমাঙ্গ বিশ্বাস কালচারাল স্কোয়ার্ড গঠন করেছিলেন- মাটির গান ক্রমে জারিত হয়েছিল গণমানুষের সঙ্গীতে। কোথাও অলক্ষ্যে যে ঐক্য ছিল তা সমূলে বিরাজিত হয়েছিল সেই সময়ে।
পাকিস্তানের পূর্ব বাংলা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত নানা সংঘ ও সংগঠনের যথোচিত প্রযোজনায় লাল পতাকা ঢাকায় ও দেশের প্রায় সকল স্থানে সমাজ বদলের আকাক্ষায় এই যে, আজও বহিবার শক্তি ও স্বপ্ন দেখাবার বাতিঘর হয়ে আছে তাকে উজ্জীবিত ও সম্মিলিত করবার উদ্দেশ্যে উজ্জ্বল সূর্যের নিচে খোঁজ- খনন ও ফলনের আস্থা খুঁজে পাবার সত্তা ও স্মরণের ভিতর সম্ভাবনা হয়ে আছে। খালি প্রয়োজন চোখ মেলে দেখবার। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখতে এই গ্রন্থে আছে রূপরেখা। জঙ্গিত্ব ও সহিংসতাকে অপনোদনের অস্ত্র ও কৌশল নীতি নির্মাণের সূত্র প্রণয়নকে ত্বরান্বিত করেছে এই গ্রন্থটি।
লাল পতাকার নিচে সাংস্কৃতিক আন্দোলন
লেখক: মহসিন শস্ত্রপাণি
প্রকাশক: পড়ুয়া
মূল্য: ২৫০ টাকা
সৌজন্যে: বইনিউজ