বুধবার লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ঢুকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ভাঙচুর করেছে যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতাকর্মীরা। এর অাগে এই হাইকমিশনে হামলা হয়েছিল ১৩ বছর অাগে। বুধবার শুধু ভাঙচুর করেই থামেনি তারা। জাতির জনক, যে মানুষটির হাত ধরে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, অামরা পেয়েছি একটা স্বাধীন দেশ– সেই নেতার ছবিটি হাইকমিশন ভবনের বাইরে এনে অপমান করেছে। ওই অসভ্য, অসুস্থ কর্মকাণ্ডের ভিডিও অার ছবি তুলে তারা অাপলোডও করেছে নিজেদের ফেসবুকে।
অামি বিস্মিত হই, যারা এ কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন তারা কেউ নিরক্ষর নন। তাদের অনেকে বিদেশে বহুবছর ধরে অাছেন, সভ্যতা, মানবতা মানবার শপথ নিয়ে নিয়েছেন ব্রিটিশ পাসপোর্ট। এদের কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। তারা বাস করেন ব্রিটেনের মতো একটি সভ্য রাষ্ট্রে। বেগম খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায়ের অাগের দিন ঘটানো হয় এ ঘটনা।
অামার খুব জানতে ইচ্ছে করে এ ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপির মতো একটি দল রাজনৈতিকভাবে কী অর্জন করলো? যারা জুতো মারার কীর্তিটি করলেন, তারা এ ঘটনার মধ্য দিয়ে কী বার্তা দিতে চাইলেন?
দুই.
বৃহস্পতিবার দুপুরবেলা অাগের দিনের বিএনপির কুকীর্তির প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকে যুক্তরাজ্য অাওয়ামী লীগ। স্থান সেই বাংলাদেশ হাইকমিশন চত্বরই। সভার অাগেই অাওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নিয়ে অাসেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বড় অাকৃতির কিছু ফটো। সভা চলাকালে মিডিয়ার সামনেই নেতাকর্মীরা মহানন্দে জুতোপেটা করতে থাকেন ছবিগুলোতে। সেসব উচিত শিক্ষা, অার জুতোর জবাবে জুতো দিয়ে দ্ব্যর্থহীন (!) প্রতিবাদের ছবি অাওয়ামী লীগের কিছু নেতাও অাপলোড করেন নিজেদের ফেসবুকে।
ভিডিওতে দেখলাম, ওই সভায় অাওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নিজেদের বক্তব্যে বলেছেন, ‘তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপি লন্ডন হাইকমিশনে হামলা চালিয়েছে।’ অামার ভেতরে প্রশ্ন জাগে, জুতো মারামারির প্রতিবাদের ধারায় তারা বঙ্গবন্ধু অার তারেক রহমানকে কোন কাতারে নামালেন বা উঠালেন?
তিন.
বাংলাদেশে অাওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে লন্ডনের বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রী লন্ডন সফরে এলে বিক্ষোভের নামে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরে ডিম ছুড়ে মারে। অাবার, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে একই কায়দায় কাজটি করতো অাওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এই কাজটিকে অাবার দু দলের নেতারাই বলেন, বিক্ষোভ প্রদর্শন অার প্রতিবাদ! অামি যুক্তরাজ্য অাওয়ামী লীগ অার বিএনপির কয়েক সিনিয়র নেতাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছি। তাদের উত্তর পরস্পরের প্রতি দোষাদোষীতেই সীমাবদ্ধ। অাওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, অামরা নই, বিএনপি যুক্তরাজ্যে জুতো অার ডিম ছোঁড়াছুড়ির রাজনীতি অাগে শুরু করেছে। বিএনপি নেতারা বলেন, না অাওয়ামী লীগই অাগে শুরু করেছে।
ইদানিং, নতুন এক ধরনের ভন্ডামিবাচক নিরপেক্ষতার কথা বলছেন ক্ষমতাসীনরা। সরকারের কোন অন্যায় কাজের সমালোচনা করলেই বলা হয়, বিএনপি তো ক্ষমতায় থাকতে এর চেয়েও খারাপ কাজ করেছে। এমন উত্তরে অামি ভেবে পাই না, কোন রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মী কী করে অতটা নীচতায় ভুলের জাষ্টিফিকেশন করেন।
চার.
বাংলাদেশ হাইকমিশন এদেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে, অাওয়ামী লীগ বা বিএনপির নয়। মানি, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে দেশে, এখানকার সে দলের নেতাদের কথা হাইকমিশনের কর্তাদের শুনতে হয়। বাংলাদেশেও তো সব সেক্টরে একই বাস্তবতা। ক্ষমতা দল পাল্টায়, বাস্তবতা ঘুরে-ফিরে একই থাকে।
লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসে কিন্তু এবারই প্রথম হামলা নয়। প্রায় তেরো বছর অাগে সাবিহ উদ্দীন অাহমেদ যখন লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তখন হাইকমিশনে হামলা চালিয়েছিল তখনকার বাংলাদেশের বিরোধীদল অাওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
অামি একজন পরবাসী বাংলাদেশী। দেশ ছেড়ে যতদুরে যাই বাংলাদেশকে ঠিক ততখানি হৃদয়ের মমতায় লালন করি অন্তরে। একজন বাংলাদেশি হিসেবে এখানকার বিএনপি জামাত, অাওয়ামী লীগের রাজনীতি অামাকে লজ্জিত করে। রাজনীতির নাম ভাঙ্গিয়ে প্রবাসের বুকে মিডিয়া কাভারেজ পাবার নামে এখানকার বিবিসির প্রধান কার্যালয় তারা ঘেরাও করেন। উদ্দেশ্য, যদি বিবিসির খবরে একটুখানি তাদের ছবি অার নামটা ছাপে। কিন্ত, হায়। বিবিসি কর্তৃপক্ষ উল্টো পুলিশ ডেকে অাপদ তাড়ায়। এখানকার বাংলাদেশি রাজনীতিবিদেরা সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেন যে তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অার্ন্তজাতিক অাদালতে মামলা করেছেন। এ বিরল কৃতিত্ব (!) দেখিয়ে তারা নিজ দলের নেতার কাছে ক্রেডিট নেন, বাহবা কুড়ান, মিডিয়ায় কাভারেজ পান। সংবাদ সম্মেলনে পরিচয় করিয়ে দেন মামলার সংশ্লিষ্ট ব্যারিষ্টারকেও।
পরে খোজঁ নিয়ে দেখা যায়, মামলা তো দুূরের কথা, কোন অভিযোগই নেই হেগে অবস্থিত অান্তর্জাতিক অাদালতে এ নামে। জেনেভার অার্ন্তজাতিক অাদালতের ওয়েবসাইটে যোগাযোগের জন্য দেয়া ই-মেইলে একটি বারো লাইনের টাইপ করা চিঠি পাঠিয়েই তারা দাবি করেছেন মামলা করার! অার অার্ন্তজাতিক অাদালতের প্যানেলভুক্ত অাইনজীবী ছাড়া কেউ সে অাদালতে মামলা পরিচালনাও করতে পারেন না।
এখানকার বাংলাদেশী রাজনৈতিক দলের এক শ্রেনীর নেতারা নিয়মিতই পত্রিকা অার টিভি চ্যানেলের অফিসে হাজির হন। ‘ভাই, নিউজ করে দিতে হবে।’, ‘অমুক…ইস্যুতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়ে অাসলাম’। পরে খোজঁ নিয়ে দেখা যায়, তারা টেন ডাউনিং ষ্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বাইরে নিরাপত্তার দায়িত্বে কর্মরত পুলিশ কনষ্টেবলের সাথে হাসিমুখে করমর্দন করে দিয়ে এসেছেন স্মারকলিপি। যে কনষ্টেবলের দায়িত্ব অাসলে গেটম্যানের।
এদেশে বিএনপি অাওয়ামী লীগের কমপক্ষে একডজন সিনিয়ার নেতাকে চিনি, যারা এদেশে নিজেদের নাম পাল্টেছেন একাধিকবার। ব্যাংক থেকে নিজেদের কোম্পানির নামে লোন নিয়ে কোম্পানি গায়েব করে নিজেদের নামেরও এক দুইটা অক্ষর বা টাইটেল এদিক সেদিক করে বনে গেছেন অন্য ব্যক্তি! অনেকের পাসপোর্টের নাম এক, এদেশে রাজনীতি করেন ভিন্ন নামে। অনেকের ভিন্ন ভিন্ন নামে রয়েছে বাংলাদেশি, ব্রিটিশ ও ইউরোপিয়ান পাসপোর্ট। ইন্স্যুরেন্স, সার্টিফিকেট, জালিয়াতির বহু ঘটনায় এদেশে জেল খেটেছেন এখনো খাটছেন বাংলাদেশি রাজনীতির বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক (!) পরিচয় দেয়া এসব নেতারা।
থাক, লজ্জার কথা অার না বলি। লজ্জার জবাবে লজ্জা দিয়ে, ঘৃণার জবাবে ঘৃণা দিয়ে কোনদিন সুস্থ রাজনীতির দিন অাসবে না। বিকৃতির ধারায় কখনো উন্মেষ হবে না সুদিনের স্বরূপ। কিন্তু, মুশকিল হলো, অামাদের রাজনীতিবিদদের সেটা কে বোঝাবে? রাজনীতির নামে তারা প্রবাসের বুকে অার কত লজ্জিত করবেন অামাদের? অার কতটা কালিমা লেপন করবেন বাংলাদেশি পরিচয়ে?
উত্তর কার কাছে চাইব?
বাংলাদেশের একজন সন্তান হিসেবে অামি লজ্জিত অাজ খুব প্রিয় জন্মভূমি, তোমার কাছে। বিদেশের বুকে বাংলাদেশ, তোমার নামটাকে বারে বারে অপমানিত হতে দেখতে হচ্ছে বলে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)