রোহিঙ্গা সংকটে বিশ্ব জনমত গঠনে বা বিশ্বকে পাশে পেতে বাংলাদেশের কূটনীতিক তৎপরতা তেমন দৃশ্যমান নয়। এখন পর্যন্ত ব্রিটেন, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তা স্বতঃপ্রণোদিত। বাংলাদেশের জোরদার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা থাকা দরকার, এমনটাই অভিমত যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজের।
কিছু কিছু দেশের বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন এবং সামগ্রিকভাবে পাবলিক অপনিয়নের বিষয়টিকে ইতিবাচক বললেও রোহিঙ্গা সঙ্কটের দ্রুত সমাধান হবে মনে করছেন না তিনি।
বিবিসি বাংলার প্রভাতী অনুষ্ঠানে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এমনটি বলেছেন আলী রিয়াজ। এসময় তিনি জাতিসংঘ সাধারন পরিষদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া প্রস্তাব, বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিষয়ে কথা বলেন।
২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনী নতুন করে অভিযান শুরু করে। এর ফলে এখন পর্যন্ত পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
জাতিসংঘের ৭২তম সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের নিয়ে চলমান সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী ৫ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন। এবিষয়ে আলী রিয়াজ বলেন, “বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে পাঁচটি প্রস্তাব দিয়েছেন।
“তাঁর প্রথম প্রস্তাব হচ্ছে অবিলম্বে এবং স্থায়ীভাবে মিয়ানমারের সহিংসতা এবং ‘জাতিগত নিধন’ বলে যাকে তিনি বর্ণনা করেছেন সেটা নি:শর্তে বন্ধ করার কথা বলেছেন।
তিনি দ্বিতীয় যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেখানে তিনি বলেছেন অবিলম্বে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটা অনুসন্ধানী দল পাঠানো হয়।
তৃতীয়ত তিনি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ‘সুরক্ষা বলয়’ গড়ে তোলার কথা বলেছেন । যাতে করে সব ধরনের নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা যায় এবং সেক্ষেত্রে তিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তার কথা বলেছেন। এবং সেফ জোন মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গড়ে তোলার কথা বলেছেন।
চতুর্থত তিনি যেটা বলেছেন রাখাইন রাজ্য থেকে যারা জোর করে বিতাড়িত হয়েছেন তাদের সবাইকে যেন নিজ নিজ ঘরবাড়িতে পাঠানো হয়; এবং পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হয়। সে প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন।
এবং সর্বশেষ প্রস্তাব তিনি যেটা দিয়েছেন সেটা হচ্ছে কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো, তার ভাষায় নিঃশর্তভাবে এবং পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করা।”
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বে মেরুকরণে শেখ হাসিনার এইসব প্রস্তাব কতোটা সাড়া পাবে?, এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রিয়াজ বলেন, প্রথম বিষয় যেটা, সেটা হচ্ছে এই প্রস্তাবগুলোর ইতিবাচক দিকগুলো হচ্ছে এই প্রস্তাবগুলো সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট; এবং একইভাবে এগুলো এচিভেবল এই অর্থে যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এগুলো করা যেতে পারে এবং করার দাবি করেছেন। সেই অর্থে এগুলো সুস্পষ্ট কিন্তু এগুলো অবশ্যই নির্ভর করবে বৈশ্বিক রাজনীতির উপর।
“দুটো প্রস্তাব যেটা আছে যেমন ধরুন তার দ্বিতীয় প্রস্তাব একটা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠানো সেই চেষ্টা কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে। মার্চ মাসে হিউম্যান রাইটস কমিশনের এর পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন নিয়োগ করা হয়েছে কিন্তু মিয়ানমার তাদেরকে যেতে দেয়নি কখনও এবং সর্ব সাম্প্রতিককালে এমনকি অং সাং সুচির বক্তব্যের পরেও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কোন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় নি। আর সর্বশেষ তিনি যেটা বলেছেন কফি আনান কমিশনের নিঃশর্ত এবং দ্রুত বাস্তবায়ন। সেই বিষয়ে ঐকমত্য আছে ফলে দুটো বিষয়ে ঐকমত্য আছে এগুলো নিয়ে হয়ত বাংলাদেশ চাপ দিতে পারে।”
“বাকি যে প্রশ্নগুলো আছে সেগুলো নির্ভর করছে স্হায়ীভাবে সমাধানের জন্য অন্যদের উদ্যোগ। সেই উদ্যোগের ক্ষেতে আপনি বলেছেন ইতিমধ্যে একধরনের পোলারাইজেশন হয়েছে।”
প্রস্তাবের বাইরে বিশ্ব জনমত গঠনে করতে বা বিশ্বকে পাশে পেতে বাংলাদেশের কূটনীতিক তৎপরতা কতোটা চোখে পড়ছে?, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত খুব একটা চোখে পড়ছেন না। চোখে পড়ছে না এই কারণ ইতিমধ্যেই যে সমস্ত প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি সে প্রতিক্রিয়াগুলো কিন্তু স্বতঃপ্রণোদিত; যেমন ধরুন বিট্রেনের পক্ষ থেকে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এর পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব করা হয়েছে কিংবা ধরুন যারাই সামালোচনা করেছে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্রুত ব্যবস্থার কথা বলেছেন বলে যে তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেছেন এগুলো কিন্তু স্বতঃপ্রনোদিত বলে মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোরদার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা থাকা উচিত মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, আমি আশা করছিলাম যে অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানরাও এ প্রসঙ্গগুলো তুলবেন। এখন পর্যন্ত তার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর বক্তব্যের পর আমি খানিকটা হতাশ হয়েছি সত্যি কথা। আমি আশা করছিলাম যেহেতু কানাডা ইতোমধ্যেই তার অবস্থান ব্যক্ত করেছে, অন্ততপক্ষে প্রাইম মিনিস্টার ট্রুডো কিছুটা হলেও উল্লেখ করবেন বলে আশা ছিলো।
জাতিসংঘে সাধারন পরিষদে বক্তৃতা সূচনা মাত্র উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে কিছুই নির্ধারিত হয় না। জাতিসংঘে সাধারন পরিষদে বক্তৃতা সূচনা মাত্র। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে সেটা অর্জন করা যাবে। একটা ইতিবাচক দিক হলো কিছু কিছু দেশ সমর্থন করছে বাংলাদেশের অবস্থানকে; আর দ্বিতীয় যেটা সেটা হচ্ছে সামগ্রিকভাবে পাবলিক অপনিয়ন যেটাকে বলি আমরা।
“মিডিয়ার কারণে বৈশ্বিকভাবে এটা এখন অনেক বেশি আলোচিত হচ্ছে। ফলে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে দ্রুত সমাধান হবে এমনটা আশা করার মতো কোন কারণ আমি এখন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না।”