যতদিন যাচ্ছে রোহিঙ্গা সঙ্কট জটিল থেকে আরও জটিল হয়ে উঠছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের অনেক দেশ রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানালেও তাতে কর্ণপাত করছে না শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি’র মিয়ানমার। বরং প্রতিমুহূর্তে আরও তীব্রভাবে রোহিঙ্গা নিধনে মাঠে নেমেছে তারা। বিশ্বমিডিয়া মিয়ানমারের এই আচরণকে একটি জাতি নিধনের মিশন বলেই আখ্যায়িত করছে। সে দেশটির সেনাবাহিনী কর্তৃক এ পর্যন্ত সহস্রাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে ঘর-বাড়ি। প্রাণ ভয়ে ভিটে-মাটি ফেলে পাহাড়-পর্বত-জঙ্গল আর নদী পাড়ি দিয়ে কোনো রকমে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি।
জাতিসংঘের সর্বশেষ হিসেব মতে, চলমান সহিংসতায় বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে ৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মুখপাত্র ভিভিয়ান ট্যান এ খবর নিশ্চিত করেন। এছাড়াও বানের জলের মতো প্রতিদিনই রাখাইন থেকে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গা। এর মধ্যে আহত অবস্থায় অনেকেই ভর্তি আছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ আশপাশের অনেক হাসপাতালে। সেখানে আহতদের চিকিৎসা চলছে। এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে ২ রোহিঙ্গা। মানবিক দিক বিবেচনা করে আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ।
মিয়ানমার যখন একটি জাতিকে নিধন করতে উন্মত্ত তখন মানবিকতার মাথা খেয়ে তাদের পাশে ভারত, চীন আর পাকিস্তানের সমর্থন দেয়াকে বিশ্ববাসীকে অবাকই করেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও কূটনীতিকভাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের আকণ্ঠ সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। মানবিক দিক বিবেচনা করে রাখাইন থেকে ছুটে আসা রোহিঙ্গাদেরও পুশব্যাক করতে পারছে না। আশ্রয় দিতেও বাধ্য হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের এই মানবিক দিকটি বিশ্বমহলে বেশ প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির এই চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে।
এদিকে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে প্রচার করা হচ্ছে, তারা বাঙালি জঙ্গি! এরা এখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। তাই তারা সন্ত্রাস দমন অভিযান চালাচ্ছে! মিয়ানমারের স্থানীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী কর্নেল টিন্ট ফোনে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির জঙ্গিরা মাইন পেতেছে এবং তিনটি সেতু উড়িয়ে দিয়েছে।’ তার দাবি, আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মিরা রোহিঙ্গা গ্রামগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। তারাই গ্রামের লোকদের চাপ দিয়েছে যাতে করে প্রতি বাড়ি থেকে একজন করে যোদ্ধা দেয়া হয়। যারা এ কথা মানছে না তাদের বাড়ি-ঘরই পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করতে এ মুহূর্তেই অন্তত ৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার দরকার বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো। ত্রাণ সংস্থাগুলোর বৈঠকে অংশ নেয়া জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এই তথ্য নিশ্চিত করে। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া ও তুরুস্ক। এছাড়াও ইরানও ত্রাণ পাঠাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান ঠিক কীভাবে হবে এ নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায় এখনও কিছু চূড়ান্ত করছে না। মিয়ানমারের প্রতি তারা জোরালোভাবে চাপও প্রয়োগ করছে না। অথচ বিশ্ব সম্প্রদায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই একমাত্র সম্ভব এই সঙ্কট উত্তরণের।
সাম্প্রতিক বন্যায় আমাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে আমরা যখন প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি, তখনই রোহিঙ্গা সমস্যা আমাদেরকে ভোগাচ্ছে। তারপরও মানবিক দিক বিবেচনায় তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছি। কিন্তু এতেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিহিত নয়। সেই ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু এই সমস্যার। আর সব দায়ভার এসে আমাদের ওপরই পড়ছে। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এই সমস্যা সমাধানের জন্য নানা চেষ্টা তদবির করে আসছে বাংলাদেশ। কিন্তু মিয়ানমার এই সমস্যা সমাধানে এক টেবিলে বসে কোনো আলোচনাই করছে না। আবার বিশ্ব সম্প্রদায়ও এ নিয়ে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করছে না। তবে সর্বোপরি কথা হচ্ছে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করতে যতটা কূটনীতিক তৎপরতার দরকার তা করতে হয়তো আমরাই ব্যর্থ হচ্ছি।
তবে এবারের সহিংসতার পর সম্প্রতি শক্ত অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। ৮ সেপ্টেম্বর মার্কিন সিনেটের এক যৌথ প্রস্তাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত দলকে মিয়ানমার যাওয়ার অনুমতি দিতে এবং আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। একইসাথে মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এড রয়েস অং সান সু চিকে একটি চিঠিও পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি রাখাইনে সহিংসতার জন্য অভিযুক্তরা সরকার বা সেনাবাহিনী যার সঙ্গেই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের বিচার করতে বলেছেন।
এদিকে একটু দেরিতে হলেও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র যে ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে এতে করে বাংলাদেশের জন্য ব্যাপারটি ইতিবাচক বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। তারা মনে করছেন, এর ফলে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গতিশীল যোগাযোগের মাধ্যমে সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। এছাড়াও চলমান সহিংসতার প্রতিবাদে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধের দাবি উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায়। এক্ষেত্রে এ সঙ্কট নিরসনে রাশিয়া, ফ্রান্সসহ আরও কিছু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গোষ্ঠির এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য বাংলাদেশকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে কূটনীতিক তৎপরতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা মানবতার স্বার্থে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছি। তাই বলে বিগত দিনগুলোর মতো এই ভার আমাদের বহন করা সম্ভব নয়। জীবন বাঁচাতে এ দেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারকে ফিরিয়ে নিতে হবে। কেননা, এরা মিয়ানমারেরই আদি বাসিন্দা। আনান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সে দেশেই তাদের সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন। আর রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের জোর সমর্থন আদায়ে বিশ্ব নেতার ভূমিকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই পালন করতে হবে। আমরা আশা করছি শেখ হাসিনার জোরালো প্রচেষ্টায় বিশ্বের সকল শান্তিকামী রাষ্ট্রই এই সঙ্কট নিরসনে এগিয়ে আসবে। জেগে ওঠবে বিশ্ববিবেক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)