মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের স্বীকৃতিহীন অধিবাসী রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতিকথনের প্রতিযোগিতা চলছে। এ প্রতিযোগিতায় রয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বিএনপির মধ্যে রয়েছেন দলটি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জ্যেষ্ঠ মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী। প্রায় প্রতি অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা নিয়ে তাদের কোন না কোন মন্তব্য থাকেই, অথবা স্রেফ রোহিঙ্গা নিয়ে কথা বলার জন্যে তারা মিডিয়ার সামনে হাজির হন, অন্তত তাদের মিডিয়ায় উপস্থাপনে সেটাই মনে হয়।
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক নন, নন স্বজন পরিজন কিংবা সে সম্পর্কীয় কেউ। তাদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মানবিকতার পরিচয় ছাড়া আর কিছু নয়। তারা আমাদের এক প্রতিবেশি দেশের অধিবাসী। এই দূরের কারও জন্যে আমাদের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যকার এমন গুরুত্বারোপ এবং রাজনৈতিক বক্তব্যের নিয়মিত উপকরণ করে ফেলাটা স্বাভাবিক কিছু মনে হওয়ার চাইতে উন্মাদনাই মনে হয়। অবাক বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমানে সেটাই হচ্ছে।
তারা কেবল নিজেদের রাজনৈতিক বক্তৃতার বিষয়বস্তু হিসেবে লক্ষ্যস্থির করা ছাড়াও এটাকে পরস্পরের মধ্যকার কাদা ছোড়াছুড়ির একটা বিষয় হিসেবেও নির্ধারণ করে ফেলেছেন।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে এই মুহূর্তে সারাবিশ্বে আলোচনার অন্যতম বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের নিপীড়ন, এবং বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ। এখানে বাংলাদেশ মানবিকতার কারণে স্রেফ তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দেশে উপস্থাপন করেছে। রোহিঙ্গাদের তাদের জন্মভূমিতে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। এটা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, রাষ্ট্রের এ দায়িত্ব সরকারের জন্যে পালনীয় বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেটা হচ্ছেও, কিন্তু রাষ্ট্রীয় এ দায়িত্বের বাইরে বাংলাদেশের নাগরিক এবং বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের যেখানে রাষ্ট্রীয় কার্যে সহযোগিতা করা দরকার ছিল সেখানে উল্টো তারা বিষয়টিকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উপকরণ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রায় প্রতি বক্তৃতায় পাওয়া যায় রোহিঙ্গা কথন, থাকে এ নিয়ে বিএনপিকে দোষারোপ। কাদেরের অভিযোগ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া রোহিঙ্গাদের দেখতে যাননি, উল্টো দেশের বাইরে পড়ে রয়েছেন। জনাব ওবায়দুল কাদেরের কাছে তাহলে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে কেন খালেদা জিয়াকে রোহিঙ্গাদের দেখতে যেতে হবে। রোহিঙ্গাদের সাথে আমাদের জাতীয়তার কী কোন সম্পর্ক আছে, তারা কী আমাদের নাগরিক কোনো? এসবগুলোর উত্তর হচ্ছে রোহিঙ্গারা আমাদের কেউ নন, আর তাদের দেখতে না যাওয়াটা কারও রাজনৈতিক ভুলও নয়।
এটা যে কারও ইচ্ছে-স্বাধীনতা। দেশের বন্যাদুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো যেখানে ছিল যেকোনো রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব সেখানে ভিন দেশের অসহায় রোহিঙ্গাদের দেখতে যাওয়া কিংবা সাহায্য করাটা দেশের কোন ব্যক্তি কিংবা রাজনৈতিক দলের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। এটা সাধারণ বোধের বিষয়।
ওবায়দুল কাদেরের বাইরে আওয়ামী লীগের আর কেউ রোহিঙ্গাদের নিয়ে অতিরিক্ত রকমের আবেগ প্রকাশ করছে না তা না, অনেকেই করছে। অপরদিকে, বিএনপির মির্জা ফখরুল আর রুহুল কবীর রিজভীর মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে অতিরিক্ত রকমের উত্তেজনা কাজ করছে। এ নিয়ে ঢাকায় বসে এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল কান্নাকাটি পর্যন্ত করেছেন। আর রুহুল কবীর রিজভীর দিনকার মিডিয়া ব্রিফে রুটিনমাফিক আসছে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ। রিজভীর এমন বাক্যব্যয় দেখে মাঝে মধ্যে তাকে ‘রোহিঙ্গা নেতা’ বলেও ভুল করতে ইচ্ছে করে। অথচ তিনি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের এক শীর্ষ নেতা।
বাংলাদেশের মানুষের জন্যে রাজনীতি করছেন এমন দাবি করা এসব নেতাদের অতি রোহিঙ্গা প্রীতি কী রাজনৈতিক দীনতা ও অদূরদর্শিতার নির্ণায়ক নয়! স্মরণ করা যেতে পারে গত আগস্টের কথা যখন বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গা ঢল নেমেছিল তখন বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলই সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। এই দাবির মধ্যে ছিল রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয় প্রীতি।
রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই ধর্মের দিক থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে এটা বাংলাদেশের একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি হওয়ার যোগার হয়েছিল। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে প্রগতিশীল দাবিদার দলগুলোও একইভাবে দাবি জানিয়েছিল। প্রাথমিক অবস্থায় সরকার সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করলেও মানবিক কারণ এবং দেশিয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কারণে সীমান্ত খুলে দিয়েছিল। কিন্তু কে জানত রাখাইনের সকল রোহিঙ্গা এভাবে চলে আসবে বাংলাদেশে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হিসাব মতে মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বর্তমানে রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাস করছে মাত্র ১৬ শতাংশ। বাকি ৮৪ শতাংশ রোহিঙ্গাই নির্যাতনের শিকার হয়ে রাখাইন ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে শরণার্থী হয়েছেন। এদের বেশিরভাগই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এটা নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর প্রভাব বাংলাদেশ আস্তে আস্তে টের পাবে।
আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এত বিশাল সংখ্যক মানুষের বোঝা বহনের সামর্থ্যের দিক চিন্তা না করে এখনও রাজনীতিবিদদের মধ্যে মায়াকান্না ঝরছে। ঢাকায় বসে সীমান্তে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্যে একের পর এক দাবি জানানো হচ্ছে। প্রতিদিন রুটিন করে বিএনপির রুহুল কবীর রিজভী, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও অন্য কিছু দলের নেতারা অদ্ভুত সব দাবি দাওয়া পেশ করে যাচ্ছেন।
কল্পিত অভিযোগ উত্থাপনে জানাচ্ছেন রোহিঙ্গাদের নানাবিধ সুযোগ না পাওয়ার কথা। তাদের রাজনীতির এমন অবস্থা দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। তাদের সকলেই বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রতি অতিরিক্ত রকমের হাপিত্যেশ দেখে ভ্রম হয় আদতে তারা রোহিঙ্গা নেতা কীনা!
রোহিঙ্গা বিষয়ক সকল কিছু বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের কাছে স্রেফ রাজনীতির এক উপকরণ সে প্রমাণ পাওয়া যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের কথায়। রোববার রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে নিয়ে তিনি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢল নামার পেছনে সরকারের দোষ খুঁজে পেয়েছেন। বলেছেন, “যখন মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের পাঠানো শুরু করলো বাংলাদেশের ভেতরে, তখন যদি আমাদের সরকার একটা কঠিন অবস্থান নিত যে একজন রোহিঙ্গাও ভেতরে ঢুকতে পারবে না, একজন রোহিঙ্গার গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। যদি এই অবস্থান সরকার নিত, মিয়ানমার সরকারের সাধ্য ছিলো না তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠানোর”।
অথচ এ বিএনপিই সীমান্তে রোহিঙ্গা ঢল নামার পর সরকারের কাছে সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। প্রাথমিক অবস্থায় সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা দিলেও পরবর্তীতে সীমান্ত খুলে দেয়। যার পরিণতিতে পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার আশ্রয় বাংলাদেশে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গাদের ঢল নামা শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের এই সময়ে দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে যতখানি রোহিঙ্গা প্রেম দেখা গেল তা যদি দেশের মানুষদের প্রতি থাকত তাহলে দেশে এত এত ছিন্নমূল, অসহায়, ভিক্ষুক থাকত কিনা সন্দেহ! আমাদের স্বার্থপর মানবতা প্রচার চায় বলে নিজেদের অসহায়দের চাইতে অপর অসহায়েরা আমাদের প্রাত্যহিকতার অংশ হয়ে যায়।
মানবিক আহবানে সাড়া দিতে চান দিন, আপত্তি নাই। কিন্তু অতি-উৎসাহী রকমের মানবতাবাদিতার আড়ালে যখন রাজনৈতিক কূটকৌশল আর অভিলাষ খেলা করে তখন আপনাদের মানবতাবাদী রাজনীতি নিয়ে সন্দেহ হয়। মানবতার আড়ালে তখন আপনারা একেক জন স্রেফ ‘রোহিঙ্গা নেতা’।
দয়া করে ‘রোহিঙ্গা নেতা’ না হয়ে বাংলাদেশের নেতা থাকুন, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরুন!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)