রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তীব্র আপত্তির কারণে মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার আরেকটি প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। তবে এই উদ্যোগ যে ব্যর্থ হবে, তা আগেই অনুমান করা গিয়েছিল। যে অত্যাচার-নির্যাতন-জুলুমের কারণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ছেড়ে এসেছিল, সেই অবস্থা পরিবর্তনের বা রোহিঙ্গাদের মনে নিরাপত্তার ভরসা তৈরি করতে মিয়ানমার ব্যর্থ হয়েছে।
আসলে মিয়ানমার চাইছিল একটা রাজনৈতিক খেলা খেলতে। সেটা তারা খেলেছে। তারা আন্তর্জাতিক মহলকে বোঝাতে চেয়েছে, আমরা তো তাদের ফিরিয়ে নিতেই চাইছি, কিন্তু রোহিঙ্গারা ফিরে না গেলে আমরা কী করব?
বাংলাদেশের অব্যাহত কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কারণে প্রথমবারের মত চীন এবার এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সরাসরি সম্পৃক্ত থেকেছে। চীনও দেখেছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার শাসকদের উদ্যোগ পুরোটাই লোক-দেখানো। যেখানে আন্তরিকতার লেশ মাত্র নেই। নিরাপত্তা, জমিজায়গা ফিরিয়ে দেওয়া, নাগরিকত্ব ইত্যাদি বিষয়ে ফয়সালা না হলে রোহিঙ্গারা যে আবার সেখানে ফিরে যেতে চাইবে না, এটা সবাই জানে। মিয়ানমারের শাসকরাও জানে। তাই তারা এসব ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা ছাড়াই কয়েকশ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। অনিবার্য কারণেই সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
এখন চীনের ভূমিকার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। যদিও বিষয়টা মোটেও সহজ নয়। কারণ বর্তমান দুনিয়ায় সব রাষ্ট্রই নিজেদের স্বার্থ দেখে। মিয়ানমারে রয়েছে চীনের বিশাল অর্থনৈতিক স্বার্থ। এই স্বার্থ উপেক্ষা করে কেবল ‘মানবিক’ কারণে চীন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াবে-এমনটা কখনই সম্ভব নয়। চীন নিশ্চয়ই হিসাব করে দেখবে, বাংলাদেশের পক্ষে থাকলে তার কতটুকু লাভ, আর মিয়ানমারের পক্ষে থাকলে কতটুকু ক্ষতি। সে হিসেব কষেই চীন নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে পথ চলবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের ওপর খুব একটা ভরসা করা যায় না। আবার চীনের সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশের সামনে অন্য কোনো রাস্তাও খোলা নেই।
বাংলাদেশে চীনে অনেক বিনিয়োগ রয়েছে। চীনা পণ্যের বিশাল বাজারও রয়েছে। তবে অর্থনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত নিরাপত্তাসহ আরও নানা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর চীনের নির্ভরশীলতা বাংলাদেশের চেয়েও অনেক বেশি। গ্যাস এবং জ্বালানি তেল সরবরাহ নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের সম্পৃক্ততা চীনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের ভেতরে চীনের বহু দশকের বিনিয়োগ রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরের মলাক্কা প্রণালী দিয়ে চীনের ৮৫% তেল এবং জ্বালানি গ্যাস সরবরাহ হয়। সেই প্রণালীতে শত্রু ভাবাপন্ন দেশের নিয়ন্ত্রণ থাকায় চীনকে নানারকম সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। চীনের বড় আশঙ্কা হল এই প্রণালীকে তারা যদি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে না নিতে পারে, তাহলে যে কোন সময়, তাদের ব্যবসা বাণিজ্য বিশেষ করে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেজন্য তারা মিয়ানমার, পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশের মাধ্যমে তাদের জ্বালানি সরবরাহের বিকল্প একটি ব্যবস্থা করে রেখেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উপকূলে চাউথিউ নামের একটি বন্দরে চীন সম্প্রতি বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। চীন মূলত মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল এবং জ্বালানি গ্যাস আমদানি করে, যা কিনা এই বন্দরে নামানো হয়। এই তেল এবং জ্বালানি গ্যাস সরবরাহের জন্য চীনারা গত কয়েক বছর ধরে কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে ওই বন্দর দিয়ে দুটি পাইপলাইন বসিয়েছে এবং এজন্য মিয়ানমারকে তাদের অনেক অর্থ দিতে হয়েছে। ওই পাইপলাইন দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেল এবং জ্বালানি গ্যাস চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ে পাঠানো হয়।
পাইপলাইনের যেন কোনো ক্ষতি না হয় এবং জ্বালানি তেল/গ্যাসের সরবরাহ যেন নিরবচ্ছিন্ন থাকতে পারে, সেজন্য চীন সব সময়ই যত্নশীল। এই পাইপলাইন যেহেতু রাখাইন অঞ্চলের ভেতর দিয়ে যায়, তাই রাখাইন রাজ্য যেন মিয়ানমার সরকারের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেটা চীনের স্বার্থের মধ্যেও পড়ে।
ক’দিন আগেই মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেছেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান। সেসময় চীনা রাষ্ট্রদূত আবারও জোর দিয়ে বলেছেন যে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে যেকোনো আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দিতে চীন সবসময় মিয়ানমারের পাশে থাকবে। তার মানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে চীন আপাতত দ্বিমুখী নীতি নিয়ে পথ চলছে।
অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশের মিত্র দেশ হলেও রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারাও চীনের মতো নীতিমালা অনুসরণ করছে। মিয়ানমার যেন চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে না যায়, সে জন্য ভারতও নানা প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। সেখানে ভারতেরও বড় ধরনের বিনিয়োগ আছে। এই বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হোক, কিংবা মিয়ানমারের সঙ্গে বৈরিতা সৃষ্টি হোক, সেটা ভারতও চাইছে না।
তবে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের নিয়ে এই সংকটপূর্ণ অবস্থা চলতে থাকলে সন্ত্রাসবাদ জন্ম নিতে পারে এমন আশঙ্কাকে মিয়ানমার, চীন বা ভারত সবাইকেই আমলে নিতে হচ্ছে। কাজেই এই সমস্যা থেকে দীর্ঘদিন মুখ ফিরিয়ে রাখার বোকামি তারা করবে বলে মনে হয় না। দুই বছর পূর্তিতে কুতুপালংয়ে বিশাল রোহিঙ্গা সমাবেশ তাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা হুঁশিয়ারি। যদিও আপাতত এই দেশগুলো তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আপেক্ষিক স্বার্থের দিকগুলোকেই বেশি বিচার-বিবেচনা করছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের সামনে আসলে আঞ্চলিকভাবে খুব একটা করণীয় কিছু নেই।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এখানে মানবপাচারের আশঙ্কা রয়েছে। মেয়েদেরকে ধরে ধরে পতিতালয়ে পাঠানো কিংবা ছেলেদের দাস বানানোর ঘটনা এ অঞ্চলে বিরল নয়। ক্যাম্পে গরমের মৌসুম এলে মল ও কাদামাটি মিলে নানা রোগজীবাণু ছড়াতে শুরু করে। ভূমিধ্বস একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। উন্মত্ত হাতির কবলে পড়েও প্রাণ হারিয়েছে অনেক রোহিঙ্গা। এখানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার কারণ সামান্যই।
তবুও অনেকের কাছে মিয়ানমারের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ। তাদের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে, এটা দেশের সরকার অকপটে অস্বীকার করে যাচ্ছে। সে দেশে ফেরত যাবার মতো কোনো ভরসা তাদের নেই।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর মতে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে সেই ছাইভস্মের ওপর গড়ে তুলেছে সেনাবাহিনীর ঘাঁটি। রাখাইনকে বদলে দেবার জন্য সরকার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন শক্তিকেন্দ্র, সরকারী দালান-কোঠা। বিশেষভাবে বলতে গেলে, সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষীদের ঘাঁটিও গড়ে উঠছে এখানে। এমনকি রোহিঙ্গা মুসলমানদের ধর্মীয় স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে সেখানে প্যাগোডা নির্মাণ করা হচ্ছে। তারা এমনভাবে রাখাইনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছে যেন এখানে কখনও রোহিঙ্গা ছিলই না।
এদিকে বাংলাদেশেরও ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙছে। বাংলাদেশের মানুষ আর এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সহ্য করতে চাইছে না। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে জঙ্গি তৎপরতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা, স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধ ইত্যাদি নানা আশঙ্কায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আপদ ও সন্দেহভাজন গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।
ক্যাম্পের বাইরে পড়াশোনা কিংবা কাজ করবার কোনো আইনত অধিকার রোহিঙ্গাদের নেই। বিদ্রোহের মাঝেই মুক্তি মিলবে, রোহিঙ্গা যুবদের এমন এই আশ্বাস দেওয়ার মানুষও বিরল নয়। তবে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখানে একটা জিনিসেরই কোনো অভাব নেই। তা হচ্ছে হতাশা আর নিরাশা। এরা এমন এক হতভাগা জাতি যাদের কেউই চায় না, এমনকি তাদের মাতৃভূমিও নয়।
এ মুহূর্তে প্রয়োজন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ব্যাপারে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক উদ্যোগ। আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে শুরু হবে সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশন। আর ৯ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর জেনেভায় অনুষ্ঠিত হবে মানবাধিকার পরিষদের ৪২তম অধিবেশন। সেখানে মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন এবং মিয়ানমারে স্বাধীন তদন্ত কাঠামো বিষয়ে আলাদা একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে। পরে ওই প্রতিবেদনগুলোর ভিত্তিতে মিয়ানমার পরিস্থিতি, বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
এসব ফোরামে বাংলাদেশকে পরিকল্পিত ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের প্রতি অবরোধ কিংবা রোহিঙ্গা নিধনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা করতে হবে। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশ বিসটেক, (আশিয়ান) ও সার্কের সদস্য আছে, তাদের ভূমিকা পালনের জন্য পরিকল্পিত কূটনৈতিক উদ্যোগ চালাতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানে জাতিসংঘের ভূমিকা ও ধারাবাহিক কূটনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)