মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর সহিংসতা-নির্যাতন ঠেকানোর ব্যাপারে আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের নিয়ে বিশেষ বৈঠকে বসার অনুরোধ জানিয়েছে ৭ সদস্য রাষ্ট্র।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেসের কাছে এ অনুরোধ জানায় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন, মিশর, কাজাখস্তান, সেনেগাল ও সুইডেন। নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি রাষ্ট্র ইথিওপিয়া জানিয়েছে, বৈঠক করার সম্ভাব্য সময় নিয়ে পরামর্শ চলছে।
এ বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে বুধবার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বলেন, সহিংসতা ঠেকাতে নিরাপত্তা পরিষদ যেন দৃঢ় এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেয় তা তিনিও চান।
আরব নিউজ জানায়, আগস্টে রোহিঙ্গা সঙ্কট ব্যাপক আকারে শুরু হওয়ার পর থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ পর্যন্ত দু’বার রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে। এছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতির তীব্র নিন্দা জানিয়ে চলমান সহিংসতা বন্ধ করতে গত সপ্তাহে মিয়ানমার সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়ে একটি অনানুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করে নিরাপত্তা পরিষদ।
সেনাবাহিনীর হামলা ও সহিংসতার মাত্রার ভয়াবহতার কারণে জাতিসংঘ একে ‘পাঠ্যবইয়ে যোগ করার মতো জাতিগত নিধনের উদাহরণ’ বলেও অভিহিত করেছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতেরা মনে করছেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে নিরাপত্তা পরিষদ একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি ইস্যু করার কথা ভাবতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নিরাপত্তা পরিষদ বড় ধরণের কোন ব্যবস্থা নিতে চাইলে এবং তার জন্য কোন নীতি প্রণয়ন করতে হলে মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্র এবং ভেটো দেয়ার ক্ষমতাধারী চীন ও রাশিয়া সেখানে সমর্থন নাও দিতে পারে। কেননা চলতি মাসের প্রথম দিকে মিয়ানমার জানিয়েছিল, দেশটি রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে তাদের ভেটো প্রয়োগের ব্যাপারে আলোচনা চালাচ্ছে যেন মিয়ানমার নিরাপত্তা পরিষদের সব ধরণের পদক্ষেপ থেকে নিরাপদ থাকে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের যেকোন নীতি প্রণয়নের জন্য ১৫ সদস্য রাষ্ট্রের কমপক্ষে ৯টির ভোট লাগবে এবং রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ভেটো থাকা যাবে না।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫শ মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতেও বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
সেনাবাহিনীর হামলা ও সহিংসতার মাত্রার ভয়াবহতার কারণে জাতিসংঘ একে ‘পাঠ্যবইয়ে যোগ করার মতো জাতিগত নিধনের উদাহরণ’ বলে অভিহিত করেছে।আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।
৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে সব ধরণের সহিংসতা-সংঘর্ষ বন্ধ রয়েছে এবং বর্তমানে রাখাইনে পরিস্থিতি যথেষ্ট শান্ত বলে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি বারবার দাবি করলেও রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে এখনো আগুন জ্বলছে বলে অভিযোগ করেছে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ২২ সেপ্টেম্বরেও সেখানকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ধোঁয়ার বিশাল কুণ্ডলী উঠতে দেখা গেছে- এরকম ভিডিও প্রমাণ থাকার কথাও জানিয়েছে তারা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।