মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মুসলমান, যারা মূলত রোহিঙ্গা নামে পরিচিত–তারা যে ভাষায় কথা বলে, সেটির সঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার মিল রয়েছে। মিয়ানমার সরকারের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা মানুষেরা যে ভাষায় নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলেন, সেটি কক্সবাজার বা বান্দরবানের স্থানীয় লোকেরা বুঝতে পারেন। বস্তুত এ কারণেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলে দাবি করে এবং যেহেতু রাখাইন রাজ্য থেকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের শিকড় উপড়ে ফেলতে চায়, সে কারণে তাদের বলে ‘সন্ত্রাসী’।
এ দুটি শব্দ মিলিয়ে তারা রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে বৈধতা দিতে চায়। যদিও শত শত বছর ধরে পরিচিত‘আরাকান’ অঞ্চলের নাম বিলুপ্ত করে সেটিকে ‘রাখাইন স্টেট’ নামকরণের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা জাতিসত্ত্বা বিলুপ্ত করে রাখাইন জাতিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতাই স্পষ্ট।
ইতিহাস বলছে, সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে মিয়ানমারের আরাকানে মুসলিম বসতি স্থাপন শুরু হলেও ‘রোহিঙ্গা’শব্দের প্রয়োগ পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে। আরাকানের বিতাড়িত রাজা নরমিখলা ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহের সহায়তায় হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করে মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। এরপর তিনি লংগিয়েত থেকে আরাকানের রাজধানী স্থানান্তর করেন লেমব্রু নদীর তীরে ম্রোহং নামক স্থানে। এই ম্রোহং বা মোহং শব্দটি মুসলমানরা লিখতেন রোসাংগ। চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকেরা এই শব্দটির উচ্চারণ করতেন রোয়াং বা রোহাং। এটি বিকৃত হয়ে রোহিঙ্গা হয়। অর্থাৎ আরাকানের সবশেষ রাজধানী ম্রোহং-এর বিকৃত রূপই হচ্ছে রোহিঙ্গা—যে নামে ডাকা হতো ওই এলাকার মুসলমানদের। কোম্পানি ও ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে কাজের সন্ধানে সেখানে যাওয়া মুসলমানদেরও রোহিঙ্গা বলে ডাকা শুরু হয়।
রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ হাজার বছর, কেউ পাঁচ শতাধিক বছর বা কেউ কয়েকশো বছর আগে সেখানে গেছেন। ফলে মিয়ানমার সরকার যে দাবি করছে যে, রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়, এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। বরং ব্রিটিশ শাসিত বার্মাকে মুক্ত করার আন্দোলনে রোহিঙ্গারা স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা অং সানকে সমর্থন করে। অথচ তাদেরকেই মিয়ানমারের নাগরিক বলে অস্বীকার করা হচ্ছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে, মানুষ পুড়িয়ে, নারীদের ধর্ষণ করে রোহিঙ্গা জাতিসত্ত্বাকে বিলুপ্ত করা হচ্ছে। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সেখানে পরিকল্পিত গণহত্যা বা সিস্টেমেটিক জেনোসাইড চলছে।
রোহিঙ্গাদের মূল অপরাধ তাদের ধর্মীয় পরিচয়। তাদের মধ্যে ঠিক কতজন ধর্মকর্ম পালন করেন অথবা করেন না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও যেহেতু তাদের ধর্মীয় পরিচয় মুসলমান, ফলে এটিই তাদের নির্যাতিত হবার প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণ তাদের ভাষাটা বাংলার একটি আঞ্চলিক অথবা উপভাষার কাছাকাছি।
একই ভাষায় পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ কথা বলতে পারে। একই ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষ কথা বলে। ঐতিহাসিকভাবেই মিয়ানমারের ওই রাখাইন অর্থাৎ একসময় যেটি আরাকান নামে পরিচিত ছিল, ওই অঞ্চলের সাথে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। হাজার হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করত। বার্মি সরকারের নিপীড়ন শুরুর আগে থেকেও নিশ্চয়ই চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনেক আরাকানি মুসলমান ঘরবাড়ি তৈরি করেছেন। অর্থাৎ নাফ নদীর এপার-ওপারের মধ্যে একটা সেতুবন্ধ ছিলই এবং এ কারণে এই দুই রাষ্ট্রের দুই অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতিতে এবং যেহেতু দুটি অঞ্চলের মানুষের অধিকাংশের ধর্মপরিচয়ও অভিন্ন, তাই তাদের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক ও বিশ্বাসগত ঐক্যও স্থাপিত হয়। বস্তুত এসবের পেছনে ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য বা আরও পরিস্কার করে বললে, অর্থ।
এরকম ভাষিক, সাংস্কৃতিক বা বিশ্বাসগত ঐক্য পৃথিবীর বহু জাতির মধ্যেই রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সাথেও বাংলাদেশের মানুষের কথাবার্তা, খাদ্য ও পোশাক এমনকি সংস্কৃতিতেও বহু মিল রয়েছে। শত্রুভাবাপান্ন বিভিন্ন রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এরকম সাংস্কৃতিক মিল থাকতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে, শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের সাথে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের মিল রয়েছে বলেই কোনো একটি জাতিগোষ্ঠী ওই দেশের সরকারের শত্রুতে পরিণত হবে; যা হচ্ছে রাখাইন রাজ্যের মুসলমান রোহিঙ্গাদের বেলায়।
হাজার বছর ধরে পৃথিবীর মানুষ বৌদ্ধদের শান্তিপ্রিয় এবং জীবের প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল বলে জানলেও মিয়ানমারের বৌদ্ধদের কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণই তার বিপরীত। আইএস, আলকায়েদা, বাংলাদেশের জেএমবি বা আনসারুল্লা বাংলা টিমের মতো ইসলাম নামধারী সংগঠনের কর্মকাণ্ড দিয়ে যেমন ইসলামকে বিবেচনা করা যায় না, তেমনি মিয়ানমারের বৌদ্ধ সরকার, ধর্মীয় নেতা এমনকি তাদের অনুসারীদের কর্মকাণ্ড দেখেও শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধদের সম্পর্কে কোনো উপসংহারে পৌঁছানো যাবে না।
কোনো একটি জাতিগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে হলে আগে তাকে সন্ত্রাসী বা পৃথিবীর মানুষের জন্য ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত করতে হয়। যে কারণে রোহিঙ্গাদের শুরু থেকেই মিয়ানমারের নাগরিক বলে স্বীকার করে না সে দেশের সরকার। অথচ ঐতিহাসিকভাবেই এটি প্রমাণিত যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেরই নাগরিক এবং আইনত তারা সে দেশের সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে তারা কেবল নিজেদের ধর্মপরিচয়ের কারণে যেভাবে নিপীড়িত হচ্ছে, সমূলে উৎপাটিত হচ্ছে, যেভাবে তাদের প্রজন্ম মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে বেড়ে উঠছে এবং যেভাবে তারা একটি দেশহীন জাতিতে পরিণত হয়েছে, সেটি এই গ্রহের প্রতিটি মানুষের জন্যই লজ্জার।
আর এই লজ্জা নিবারণের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল, বছরের পর বছর তা ছিল অনুপস্থিত। যদিও সম্প্রতি রাখাইন সংকট নিরসনে খোদ মিয়ানমার সরকারের উদ্যোগে গঠিত জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে আনান কমিশনের রিপোর্ট পেশের পরদিনই রাখাইনে নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান যে সে দেশেরে সেনাবাহিনী চায় না, সেটি পরিস্কার।
তবে সাম্প্রতিক সহিংসতায় উসকানিদাতা হিসেবে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার বলে পরিচিত সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে (এআরএসএ) দায়ী করা হচ্ছে এবং তারা নিজেরাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার দায় স্বীকার করেছেন, ফলে আনান কমিশনের রিপোর্ট পেশের পরদিনেই এই সংঘাতের সূচনা হওয়ায় এ প্রশ্নও উঠছে যে, তাহলে কি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির মতো সংগঠনগুলো রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান চায় না? তারা কি এই সংকটি জিইয়ে রেখে নতুন কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়? তাদের সাথে কি অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যেমন আইএস-এর কোনো যোগসূত্র আছে যারা রোহিঙ্গা সংকট জিইয়ে রেখে ওই এলাকায় এবং এই অঞ্চলে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়?
ইরাক ও সিরিয়ায় পিছু হটতে বাধ্য হওয়ার পর আইএস এখন যে বিশ্বের নানা প্রান্তে নজর দিচ্ছে এবং তাদের সেই টার্গেটের মধ্যে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা অধ্যূসিত রাখাইন রাজ্য যে তাদের প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকবে, সে বিষয়ে সন্দেহ কম। ফলে আমরা যখন রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ব্যর্থ হতে দেখি, তখন এই আশঙ্কাগুলোও আমাদের বিবেচনা করা দরকার।
সেইসাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আদৌ এই সমাধান চায় কি না, বা রোহিঙ্গা সংকট জিইয়ে রেখে ওই অঞ্চলে কোটি টাকার ইয়াবা ও অন্যান্য মাদক ব্যবসা ও চোরাচালান অব্যাহত রাখতে চায় যে গোষ্ঠী, সেই গোষ্ঠীর সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কেউ জড়িত কি না এবং রোহিঙ্গা সংকট নিরসন হলে তাদের স্বার্থ হানি হবে কি না–এসব প্রশ্নও এখন সামনে আনা প্রয়োজন। কেননা, রাখাইন রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে এবং দশকের পর দশক ধরে নিপীড়নের শিকার একটি জনগোষ্ঠীর নুন্যতম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আনান কমিশনের রিপোর্ট পেশের পরদিনই সেখানে যেভাবে নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়েছে, তা এই সংকটের আশু সমাধান তো বটেই, দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পথও রুদ্ধ করেছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)