মিয়ানমারের রাখাইনে জাতিগত নিধনের শিকার হওয়ায় সেখান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্রমাগত আশ্রয় ও সহায়তা দেয়া অব্যাহত রাখায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়।
ওই বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র হেদার নোয়ার্ট বলেন, ‘২৫ আগস্ট রাখাইনে সহিংস হামলা এবং গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়াসহ বিভিন্নভাবে মানবাধিকার চরম লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে ঢুকেছে বলে জাতিসংঘের ঘোষণায় বলা হয়েছে। এই ঘোষণায় আমরা খুব বেশি উদ্বিগ্ন।’
তিনি জানান, ‘যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার, আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংগঠনসহ সব সহযোগীকে নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকে জরুরি সহায়তা দেয়ার বিষয়টি নিবিড়ভাবে সমন্বয় করছে।’
গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে ঘরহারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের মানবিক সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৬ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
‘এই মানবিক দুর্যোগে উদার মনে সাড়া দেয়ায় এবং বিপদগ্রস্ত জনগণের কাছে প্রয়োজনীয় সাহায্য পৌঁছানো নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ায় আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সাধুবাদ জানাই,’ বলেন হেদার।
তবে মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর রোহিঙ্গা নিধন বিষয়ে ইতোপূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ সংকট সমাধানের আশা জাগালেও এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের উপর অবরোধ দূরের কথা, বরং তাদের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে মার্কিন কংগ্রেসে এক বিল উত্থাপিত হতে যাচ্ছে বলে সংবাদ সংস্থা এপি’র এক প্রতিবেদনে জানানো হয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন সিনেটে প্রতিরক্ষা ব্যয় বিষয়ক একটি বিল উত্থাপিত হতে যাচ্ছে, যার ফলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পাবে। এই বিলের খসড়ায় সামুদ্রিক নিরাপত্তা, শান্তিরক্ষা এবং মানবপাচার রোধে দুই দেশের একত্রে কাজ করার কথা বলা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন সেখানকার ডানপন্থী থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের এশিয়া প্রোগ্রাম এডিটর ওয়াল্টার ল্যামেন। বিষয়টি ‘নির্মম বার্তা দিচ্ছে’ বলেও বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চি’র কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত ৪শ’র বেশি মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতেও বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।