রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ও তাদের আশ্রয়দান কেবলই মানবিকতার নয়। মানবিকতার দোহাই দিয়ে দেশি-বিদেশী একটি কুচক্রি মহল বাংলাদেশকে ঠেলে দিচ্ছে এক গভীর সংকটে। একদিকে সাম্প্রদায়িক মুসলিম ইস্যুতে তাদের বাংলাদেশে আশ্রয়দানের দাবী তুলছে মুসলমান সম্প্রদায়। অন্যদিকে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য জাতিসংঘের পেশকৃত প্রস্তাবে চীনের ভেটোকে সমর্থন জানিয়েছে। নীরব ভূমিকায় রয়েছে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের স্ত্রী রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে এসে তাদের দুর্দশা দেখে চোখের জল ঝরিয়েছেন। আবার এই তুরস্কই নির্যাতিত সিরীয় মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত সিলগালা করে দিয়েছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মিয়ানমারের নেত্রী অংসান সূচীর সাথে সাক্ষাত করে তাকে সমর্থন ব্যক্ত করে। এখন আবার আরাকানী হিন্দুদের উপরও চলছে নির্যাতন। রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাশাপাশি সেখানকার হিন্দুরাও এখন নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দু রাষ্ট্র ভারত থাকতে তারা বাংলাদেশে আসছে কেন? এব্যাপারে ভারতীয় হিন্দু নেতাদের কী বক্তব্য? পালিয়ে আসা হিন্দু শরণার্থীরা বলছেন, কালো পোশাকধারী একশ্রেণীর সন্ত্রাসী তাদের উপর হামলা চালাচ্ছে, তারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসেছে। এই কালো পোশাকধারী কারা তারা জানেনা। নিপীড়িত মানুষের বন্ধু ও সমাজতান্ত্রিক গণচীন দাবীদার চীনও নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের পক্ষে না দাঁড়িয়ে নিপীড়ক মিয়ানমার সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
এ ব্যাপারে এ দেশীয় বামপন্থী দলগুলোর কী বক্তব্য? রোহিঙ্গা নির্যাতন ও তাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে আর এদেশীয় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সস্ত্রীক একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে মিয়ানমার গেছেন সেদেশ হতে চাউল আমদানী চুক্তি করতে! ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছেঃ মিয়ানমার সংবাদ মাধ্যমের দাবী /রাখাইনে সহিংসতার জন্য দায়ী পাকিস্তান ও আইএস! সংবাদটিতে লিখেছে, ‘প্রায় দুই সপ্তাহ যাবত রোহিঙ্গা ইস্যুতে উত্তাল মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের কূটনীতি অঙ্গন। এবার উত্তাপে নতুন ঢেউ যোগ করলো মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যম মিজিমা। তাদের দাবী, রাখাইনে সহিংসতার জন্য দেশটির সেনাবাহিনী দায়ী নয়। এ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড দমন- পীড়নের পেছনে হাত রয়েছে পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসী সংগঠন আইএসের।
ভারত ও বাংলাদেশের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে মঙ্গলবার এক বিশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মিজিমা।আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) সামরিক শাখার প্রধান হাফিজ তোহারের ফোনে আসা তিনটি কলের সূত্র ধরে ভারত ও বাংলাদেশের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানান বলে দাবী করে মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যমটি। ২৩ ও ২৪ আগস্ট দীর্ঘসময় ব্যাপী এসব ফোন কলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উপর হামলার বিষয়ে কথা বলা হয়েছে।গত ২৫ আগস্ট ২০টির বেশি তল্লাশী চৌকিতে হামলা চালানো হয়। তারই সূত্র ধরে রাখাইনে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী।
প্রতিবেদনটিতে আরও লিখেছে, হাফিজ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন পাকিস্তানের লস্কর -ই-তৈয়বা (এলইটি) এর কাছ থেকে। পরে তাকে নিয়োগ দেয় মংডুর কিয়ুক পিন শিয়েক গ্রামের হরকত উল জিহাদ আল ইসলামী আরাকান (হু জি আ) আব্দুল কদ্দুস বর্মি।হাফিজ নিজেও আকামুল মুজাহিদিন (এ এম এম) নামের একটি দল গড়েন। যেটি পরে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা)র সঙ্গে যুক্ত হয়। এতে আরও লেখা হয়, পাকিস্তানের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইনটেলিজেন্স (আইএসআই) কর্মকর্তা আশফাক রোহিঙ্গা ইস্যুতে কফি আনানের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পরপরই হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এতে আরও লেখা হয়, বিকেল ৬:০২ মিনিটে ইরাক থেকে তৃতীয় কলটি আসে। কল করা ব্যক্তি নিজেকে আল আদমী অব দায়েশ (আইএসের কর্মীরা দায়েশ নামে পরিচিত) বলে তোহারকে পরিচয় দেয়। ১৪ মিনিটের এই কলটিতে বলা হয়, আইএস জানে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) বার্মার উপনিবেশবাদী বৌদ্ধ ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে ভালভাবেই জেহাদ করবে।’
এমনই একটি কুটিল, জটিল ও উত্তপ্ত মুহুর্তে ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দুইদিনের সরকারি সফরে মিয়ানমারে গিয়ে বলেছেন, যখন দেশটি একটি শান্তি প্রক্রিয়ায় আসছে অথবা সমস্যা সমাধানের পথে আছে তখন আমরা চাই মিয়ানমারের ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের জন্য সব পক্ষ একসঙ্গে কাজ করবে। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? উগ্র জাতীয়তাবাদী ও নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের বসত বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। লুটতরাজ করছে। পথে-প্রান্তরে, নদীতে পাওয়া যাচ্ছে মানুষের লাশ। জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশু। আর মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সূচি বলছেন, রাখাইন প্রদেশে যে সংকট চলছে তা তার ভাষায় ভুল তথ্যের মাধ্যমে বিকৃত করা হচ্ছে। আরও খবর বেরিয়েছে, বাংলাদেশের সাথে সীমান্তের একাংশ জুড়ে ভূমি মাইন পেতে রাখছে মিয়ানমার, যাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আর ফিরতে না পারে।বিহারী শরণার্থীদের কি পাকিস্তান নিয়েছে অথবা নেবে কোনোদিন? রোহিঙ্গাদেরকে যে মায়ানমার আর কোনোদিন নেবেনা এটা প্রায় নিশ্চিত।৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে,৩ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক, অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার/এসব কিসের আলামত?
এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কিভাবে নিয়ন্ত্রন করবে বাংলাদেশ? তুরস্কের ফার্স্ট লেডি বাংলাদেশে এলেন আর তাকে অভিনন্দন দেয়াও শুরু হয়ে গেল।তারা এতো মানবিক সিরীয় মুসলিম শরনার্থীদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তুরস্ক সেদিন তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল কেন? আর তাদের এই ত্রানে কয়দিন চলবে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা? ইতোমধ্যে রোহিঙ্গারা পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন শুরু করে দিয়েছে। একদিন যে তারা ইজরাইলের মতো আরও একটি আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠার ডাক দেবেনা ও আন্তর্জাতিক সহায়তা পাবেনা এর কী নিশ্চয়তা রয়েছে? আমরা প্রায়ই দেখি গৃহহীন পথশিশুদের সামান্য টাকা দিয়ে বোমারু হিসেবে ব্যবহার করতে। কবি সুকান্তের একটি কবিতার লাইন রয়েছেঃক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় /পূর্নিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। সুতরাং যারা পূর্ণিমার চাঁদকে রুটি বানিয়ে খেতে পারে তারা একটি দেশকে কী করতে পারে তা কি সহজেই অনুমেয় নয়? পত্রিকায় বাংলাদেশী কর্তৃক রোহিঙ্গা যুবতী ধর্ষণের খবরও বেরোচ্ছে। এগুলো ফলাও করে প্রচার করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টের পাঁয়তারা হতে পারে নাকি? ১৭৮৪ সনে আরাকান স্বাধীনতা হারায় বর্মীদের হাতে। তখন হতেই সরবে নিরবে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছিল।
সেই যুদ্ধে সহযোগিতার নামে ১৮২৬ সালে আরাকানে ব্রিটিশ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা পায় বলে জানা যায়। ১৮২৭ সালে ব্রিটিশের এই বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন আরাকানের যুবরাজ শিউই বান ও তার সহযোদ্ধা অং স জা।ব্রিটিশরা একসময় শিউই বানকে আটক করে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল। ১৮৩৪ সালে ঢাকা কারাগারে অনশন করতে করতে মারা যান যুবরাজ বান। মারা যাওয়ার আগে তিনি নিজের রক্ত দিয়ে জেলের দেয়ালে স্বাধীনতা অর্জনের আহবানের কথা লিখে যান।যুবরাজ বানের সেই আহবান আবার নতুন মোড়কে ঢেকে বিস্ফোরণের পায়তারা চলছেনা তো? যদি তাই হয় এ যুদ্ধের চারণ ভূমি বাংলাদেশ হতে যাবে কেন? রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে বসত গেড়ে যদি এই ভূমিসহ আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহবান জানায় তখন কী করবে বাংলাদেশ?
বিএনপি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দানের দাবী তুলে মাঠ গরম করছে। এটা কি কেবলই দেশপ্রেম বর্জিত ইস্যুবাজী নয়? তাদের ভূমিকা সেই শেয়ালের আকাঙ্ক্ষার কথাই মনে করিয়ে দেয়। একটি শেয়াল বলেছিলো, যদি ঘরের চালে পানি উঠতো তাহলে কাক কোথায় থাকে দেখতাম! কিন্তু বুদ্ধিমান দাবী করা নির্বোধ শেয়ালটি একবারও ভাবলোনা যে সে কোথায় থাকবে? ঘরের চালে পানি উঠলে যে সবার আগে তার জঙ্গলটিই ডুববে এই বোধটা তার জাগলো না। বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এ যুদ্ধ কার পক্ষে? নিশ্চয়ই রোহিঙ্গাদের। যুদ্ধ করে তিনি কি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠাতে চান না রোহিঙ্গাদের জন্য পৃথক স্বাধীন রাষ্ট গঠন করতে চান? এব্যাপারে কবির সুস্পষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন আবশ্যক।
মিয়ানমারের ৬ লক্ষ ৭৬ হাজার বর্গমাইল ও লোকসংখ্যা ৭ কোটি আর বাংলাদেশের আয়তন ১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গমাইল ও লোকসংখ্যা ১৬ কোটি। আর রোহিঙ্গারা বসতি স্থাপন করছে বাংলাদেশে। মিয়ানমার গোপনে গোপনে তার সামরিক শক্তিও বাড়াচ্ছে। মিয়ানমারের একটিভ সেনা সদস্য ৪ লক্ষ ৯২ হাজার ও বাংলাদেশের ৪ লক্ষ ১০ হাজার।মিয়ানমারের বাটল ট্যাংক ৮০০ টি বাংলাদেশের ৬০০ টি। মিয়ানমারের যুদ্ধ বিমান ১২৮ টি, বাংলাদেশের ৮০ টি। মিয়ানমারের এটাক হেলিকপ্টার ১০০ টি ও বাংলাদেশের মাত্র ২৯ টি। মিয়ানমারের যুদ্ধাস্ত্রের সংখ্যা ৭,৪৬,০০০ আর বাংলাদেশের ৫,৪৭,০০০। মিয়ানমারের পক্ষে প্রকাশ্য ভূমিকায় রয়েছে কিছু দেশ। বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াবে কোন দেশ?
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত মিত্রশক্তি হিসেবে আবির্ভূত না হতো নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কি বাংলাদেশ স্বাধীন হতো? রোহিঙ্গারা এখনই টুকটাক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড শুরু করে দিয়েছে। বাংলাদেশের হয়েছে উভয় সংকট।তাড়ানোও যাচ্ছেনা আবার আশ্রয় দেয়াও চরম ঝুঁকিপূর্ণ। নেপথ্যে দাঁত কিচিয়ে হাসছে কুটিল ষড়যন্ত্রীর দল। সম্প্রতি ৮ সেপ্টেম্বরের বি,বি,সি বাংলায় শিরোনাম হয়েছে: রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের হুমকি দিচ্ছে জিহাদী গোষ্ঠীগুলো। ‘এই প্রতিবেদনটিতে আরও লিখেছে: সিরিয়া ভিত্তিক জেহাদী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল শামস টেলিগ্রামের একটি চ্যানেলে দাবী করেছে, বার্মার মুজাহিদিনরা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ঢুকে সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যার মাধ্যমে নিরস্ত্র মুসলিমদের হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে।’
এসব কোন পরিণতিকে আমন্ত্রন জানাচ্ছে? আন্তর্জাতিক জেহাদী গোষ্ঠী এখানে উগ্রবাদীদের দিয়ে মিয়ানমারে হামলা চালাবে আর এই ইস্যুতে আক্রান্ত হবে বাংলাদেশ। বিনষ্ট হবে শান্তিময় বসবাস। অশান্তির আগুনে দগ্ধ হবে সর্বত্র। এমন একটি অশুভ ক্ষণ কি অপেক্ষমান নয়?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)