সুচির বক্তব্যের জন্য যেমন মুখিয়ে ছিলো বিশ্ব, তেমনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও আলোচনায় ছিলেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রায় ২শটি মত দেশ অংশ নিলেও সবার চোখই ছিলো রোহিঙ্গাদের নিয়ে কি বক্তব্য দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যারা অঢেল সম্পদ নিয়েও অন্য কোন বিতাড়িত ভাগ্যহত জাতির দায়িত্ব নেওয়ার সাহস পায়না। সেখানে হাজারো সমস্যায় আক্রান্ত বাংলাদেশ প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার দায়িত্ব নিতে চলেছে, বিষয়টি আসলেই তখন বিশ্ব মোড়লদের কাছে বিশ্বয়েরই ছিলো। প্রধানমন্ত্রীও তার বক্তৃতায় রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানেরই প্রস্তাব তুলে ধরলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের রক্ষা ও তাদের ফেরত নিতে জাতিসংঘে ৫ দফা প্রস্তাব পেশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘসহ বিশ্বনেতাদের কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দিয়ে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে তাদের (বিশ্বনেতা) জোরালো সমর্থন চান। এ ছাড়া মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা, জুলুম ও নির্যাতনের চিত্র বিশ্বদরবারে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে ভাষণে তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্প ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, তার হৃদয় দুঃখ ভারাক্রান্ত। মুসলিম রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে ‘সেইফ জোন’ গঠনের প্রস্তাব বিশ্ব সংস্থায় তুলে তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবকে একটি অনুসন্ধানী দল পাঠাতে বলেন। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার পাশাপাশি সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থানের কথাও বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে স্পষ্ট করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি চাই, মানব ধ্বংস নয়, মানবকল্যাণ চাই।” বরাবরের মতো এবারও বাংলায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেয় বাংলাদেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বিশ্বদরবারে বাংলায় বক্তৃতা করে নজির স্থাপন করেছিলেন। এরপর থেকে শেখ হাসিনা সেই ধারাটিকে রেওয়াজে পরিণত করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের তিন মেয়াদে ১২ বার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে প্রতিবারই বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের রক্ষা ও তাদের ফেরত নিতে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ৫ দফা প্রস্তাব হল-
১. অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা
২. অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা
৩. জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা
৪. রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা
৫.কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বিশ্বব্যাপী অভিবাসন ও শরণার্থী সমস্যার সমাধানে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মানবিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর এ ভাষণ বিশ্ব নেতাদের কাছে প্রশংসিত হয়।
১৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীকে সুষমার ফোন:
ভৌগোলিকভাবে তখন রাজনীতির শিকার বাংলাদেশ। ভারত বরাবরই বাংলাদেশের বড় বন্ধু। তবে মিয়ানমার ইস্যুতে যেন অনেকটাই বিমাতাসুলভ আচরণ দেখা গেলো। এখানে বন্ধু থেকে স্বার্থটাই যেন বড়। ভৌগোলিক দিক দিয়েতো বটেই, বাণিজ্যের দিক দিয়েও ভারতের কাছে মিয়ানমারের গুরুত্বই যে বেশি তা বোঝাতেই যেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফরের গিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচিকে ভারতের সমর্থন দিয়ে আসেন। যদিও ধরি মাছ না ছুই পানিতে বিশ্বাসী ভারত। এটা বোঝা গেল বেশ কিছুদিন পর।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন দিয়ে রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। সে সময় রোহিঙ্গা ইস্যুতে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর সমর্থন জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের পাশে থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। ১৪ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে ফোন কলের মাধ্যমে এ সমর্থন জানানো হয় বলে নিশ্চিত করে প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেস সচিব নজরুল ইসলাম। এর আগে চলমান রোহিঙ্গা ইস্যুতে তড়িঘড়ি করে মিয়ানমার সফরের মাধ্যমে দেশটির প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে এবং দেশের বাইরে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাকে।
ফোনালাপকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের ফেরত নেয়ার পাশাপাশি রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন বন্ধে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে ভারত। রোহিঙ্গা সমস্যা এখন অঞ্চল ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ কেবলমাত্র মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। মিয়ানমারকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, রোহিঙ্গা তাদের নাগরিক। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে অস্থায়ী ব্যবস্থা করার জন্য জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের দীর্ঘ মেয়াদে অবস্থান বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করবে।’ (চলবে)