বহমান ক্ষমা-করুণার বার্তা নিয়ে এসেছে মাহে রমজান। আত্মিক পরিশুদ্ধির অপার সম্ভাবনা এ মহিমায়। প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে উত্তরণের অনন্য মাধ্যম হিসেবে মহান আল্লাহ বান্দার জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন রোজা পালনের। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন: ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)
‘রোজা’ ফার্সি ভাষার শব্দ। আরবি প্রতিশব্দ ‘সাওম’ বা ‘সিয়াম’। অভিধানগত অর্থ: বিরত থাকা, বেঁচে থাকা। আত্মিক পরিশুদ্ধি তথা কাম, ক্রোধ, লোভ ও রিপুসমূহকে দমন করার জন্য এ রোজা। শরিয়া দৃষ্টিকোণে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তাত্মায় যাবতীয় পানাহার এবং স্ত্রীগমন হতে বিরত থাকাই ‘রোজা’ হিসেবে সমাদৃত।
ইসলামে রোজার বিধান সর্বপ্রাচীন। মানবজাতির আদিপিতা, নবুওয়াতের প্রথম দায়িত্ববান হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে এর যাত্রা। তাঁর উপর ফরজ হয় ‘আইয়ামে বীয’ তথা প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা। হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের উপর ফরজ হয় বছরব্যাপী একদিন পর একদিনের রোজা পালন। হজরত মুসা আলাইহিস সালাম। বনি ইসরাইলের অন্যতম নবি। শরিয়তের আলোকে তিনি এবং তাঁর উম্মতের উপর ফরজ হয় ‘আশুরা’ ও ‘শনিবার’ রোজা পালন। আশুরা মানে মহরমের দশ তারিখ। এভাবে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এবং তাঁর উম্মতের উপর মাহে রমজানের রোজা ফরজ হয়; বনি ইসরাইল বিভিন্ন কারণেই রোজার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে করতে দুমাস তথা ৬০ দিনে রূপান্তরিত করে বসে। (তাফসীরে আজিজি, কৃত: শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভি রহ.)
খৃষ্টীয় ৬২২ সাল। আল্লাহর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাতৃভূমির জমাটবদ্ধ মায়া ত্যাগ করে হিজরত করেন মদিনায়। শান্তির নৈসর্গিক শহর মদিনা মনোয়ারা এসে প্রাথমিকভাবে মহররমের দশ তারিখের আশুরার রোজা পালন করেন। কারণ তখনও মহরমের দশ তারিখ রোজা পালন মুসলমানদের উপর ফরজ বলবৎ থাকে। (খুত্ববাতে রমজান, মুফতি সৈয়্যদ সাদাত আলী কাদেরি, পৃ. ২৮)।
রহমতের নবী প্রিয় রসুল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ফলক হিসেবে উম্মতে মুহাম্মদির উপর আরোপিত রমজানের রোজা পালন। মহীয়ান আল্লাহর কালাম, ‘অতএব তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস (মাহে রমজান) পাবে, তবে সে যেন তাতে সিয়ামসাধনা করে।’ (আল-কুরআন, সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৫)
ঐতিহাসিক ভাষ্যমতে, চূড়ান্তভাবে রমজানের রোজা ফরজ হয় দ্বিতীয় হিজরির দশ শাওয়াল, মদিনা মনোয়ারায়। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রমজানের এ ফরজ বিধান প্রলয় অবধি। পূর্ববর্তী নবী রসুলগণের ইন্তেকালের পর তাঁদের উম্মতের মধ্যকার বহুধা বিভক্তের জাঁতাকলে ঐশীলব্ধ বিধিবিধানে এনেছে বিশাল পরিবর্তন। এমনকি চ্যুতকর্মও; কিন্তু শেষ নবী রসুলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনন্য
আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় শরিয়তে মুহাম্মদি পরিবর্তন সাধিত হওয়ার নয়।
বিদায় হজের ভাষণে ঘোষিত হয়েছে, ‘আজ! আমি (আল্লাহ) তোমাদের ধর্ম ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ করলাম। আর পূর্ণ করলাম তোমাদের প্রতি আমার করুণারাজি। আর ধর্ম হিসেবে তোমাদের ইসলামের ব্যাপারে সন্তুষ্ট।’ (আল-কুরআন, সুরা মায়িদা, আয়াত-০৩)
মাহে রমজানে এক মাস রোজা পালন দালিলিক ভিত্তিতে মুসলমানদের উপর ফরজ প্রমাণিত। এছাড়াও শরিয়তে আরো বেশ কয়েক ধরনের রোজার বিধান রয়েছে। যেমন: (১) ওয়াজিব রোযা: মানতের রোজা। অর্থাৎ কোনো কারণে নিজেই রোজা রাখার সংকল্প করে নিয়ত করা। কাফফারার রোজা ওয়াজিব।
(২) সুন্নাত রোজা: যে রোজা রসুলে খোদা সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং পালন করেছেন এবং করতে বলেছেন, তা সুন্নাত রোজা। তা পালনে যথেষ্ট সাওয়াব রয়েছে, তবে বাধ্যতামূলক নয়। সুন্নাত রোজার
মধ্যে রয়েছে-১. আশুরার রোজা, ২. আরাফা দিবসের রোজা, ৩. আইয়্যামে বীয তথা প্রতি চান্দ্রমাসের ১২, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা।
(৩) নফল রোজা: ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাত ব্যতীত বাকী সব রোজা নফল। যেমন: শাওয়ালের ছয় রোজা, শুক্রবারের রোজা, শবে বরাতের রোজা।
(৪) মাকরূহ রোজা: স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ব্যতীত স্ত্রী নফল রোজা পালন করা। ইফতার-সেহরি ছাড়া রোজা রাখা।
(৫) চারাস রোজা: যেসব রোজা পালনের ব্যাপারে শরিয়ত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যেমন, বছরে ৫দিন রোজা রাখা হারাম। দিনগুলো হলো- দুই ঈদের দুই দিন এবং জিলহজ মাসের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখে রোজা পালন।