চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

রোজা পালনের উপকারিতা

সিয়াম বা রোজা পালনের মাস মাহে রমজান। পবিত্র এই মাসে প্রায় দীর্ঘ ত্রিশ দিনেই সূর্যোদয়ের সময় হতে তা অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত পানাহার ও নির্দিষ্ট কতিপয় কার্যাবলী থেকে বিরত থাকেন পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলমান। সাধনার এই উপোসকে বলা হয় রোজা।

দীর্ঘ এই সময়ে উপবাস থেকে রোজা রাখাকে শরীরের জন্য অযথা ক্ষতিকর মনে করেন কেউ কেউ, অল্প একটু অসুস্থ হলেই ক্ষতির সন্দেহ দানা বাঁধে অনেকের মনে। কিন্তু তা প্রচলিত ভুল ধারণা কেবল, যা আড়াআড়িভাবেই চিকিৎসা-বিজ্ঞান ও বাস্তবতার বিপরীত। সাওম পালনে অনীহা তৈরির উদ্দেশ্যে ইসলাম-বিদ্বেষীদের লেলিয়ে দেয়া এটি ভিত্তিহীন অভিযোগের হাতিয়ার ব্যতীত আর কিছুই নয়।

অথচ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বলে অন্য কথা। রোজা পালনের ধর্মীয় উপকারিতা তো আছেই; তদুপরি শারীরিক বহু উপযোগিতাও নিহিত রয়েছে এতে। এটিকে আমরা দু’ভাগে বিভক্ত করতে পারি। প্রথমত ধর্মীয় বা পারলৌকিক এবং দ্বিতীয়ত শারীরিক ইহলৌকিক উপকারিতা। উভয়ের বর্ণনা নিম্নরূপ:

১. ধর্মীয় উপকারিতা
ক. তাকওয়া অর্জন: রোজা পালনের মূল উদ্দেশ্যেই তাকওয়া অর্জন। রমজান মাসে রোজা রাখার মধ্য দিয়ে সহজেই তাকওয়া অর্জনের রুদ্ধদ্বার সবার জন্য উন্মোচিত হয়। তাই রোজা পালন অতীব জরুরি। আল্লাহকে খুশি করতে ইবাদতের মধ্যে রোজা পালনের বিকল্প নেই। এইজন্য রোজা রাখা অত্যাবশ্যক। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে। যেমনভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ ছিলো। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো’। (সুরা: বাকারা, আয়াত: ১৮৩)।

খ. কুপ্রবৃত্তি দমন: সকল প্রকার অবৈধ কার্যাবলী থেকে মুক্ত থাকতেই সাওম বা সিয়াম সাধনা। সিয়ামের মৌলিক শিক্ষা হলো, সারাবছরের কৃত পাপ চর্চার কু-অভ্যাস বর্জন করে ইবাদত চর্চার অভ্যাস গড়ে তোলা। এই কারণে অভিশপ্ত শয়তানের জন্য এ মাসটি শুধুই কান্নার, আর ঈমানদারের জন্য তা আনন্দের; যদি সে নিষিদ্ধ কাজ থেকে নিজেকে গুঁটিয়ে নেয়। হারাম থেকে সে নিজেকে এমনভাবে দূরে রাখবে, যেন আচার-আচরণে অযথা কথা-বার্তা থেকেও সে বিরত থাকে। হাদিস শরীফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি মন্দকথা ও মন্দকাজ পরিহার করবে না, তার জন্য পানাহার ছেড়ে দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই’। (সহীহ বুখারী)।

গ. ধৈর্যের অনুশীলন: রোজা পালন ঈমানদারের অন্তরে ধৈর্যের প্রাচীর তৈরি করে। তা এক আল্লাহর ওপরেই ভরসা রাখার সাহস জোগায় বালা-মুসিবতে। এছাড়া রমজান অতিক্রম করলেও ধৈর্যের কারণে অন্য সকল মাসে যাবতীয় ইবাদত পালন অধিকতর সহজ হয়ে যায়। এজন্যই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: ‘রোজা ধৈর্যের অর্ধেক’। (সুনানে ইবনে মাজাহ)। তাই এই মাসটিকে দুঃখ-কষ্টে, বালা-মুসিবতে ধৈর্যধারণের ‘প্রাক্টিস সেশন’ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে প্রত্যেক রোজাদারকে।

ঘ. জাহান্নাম থেকে মুক্তি: সিয়াম সাধনায় রয়েছে নাজাতের সুসংবাদ। যুদ্ধ ময়দানে শত্রুর আক্রমণ থামাতে যেই ঢাল ব্যবহৃত হয়, পরকালে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পেতে আমাদের জন্য রোজার ভূমিকা সেই ঢালের মতো। হাদিস শরীফে আছে, ‘সিয়াম হলো ঢালস্বরূপ, যা বান্দাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রাখে’।(মুসনাদে আহমদ)।

২. শারীরিক উপকারিতা
ক. দূষিত পদার্থ নিঃসারণ: সারা বছর ফাস্টফুড, সাদারুটি, পিৎজা, বার্গার ইত্যাদি রকমারি খাবার খেয়ে আমাদের সারা শরীর ‘টক্সিন’ বা দূষিত পদার্থের ডাস্টবিনে রূপান্তরিত হয়। এমতাবস্থায় প্রচুর পরিমাণে উপোস করার প্রয়োজন পড়ে; এই ডায়েটিংয়ের বিকল্প হতে পারে সিয়াম সাধনা। এ সম্পর্কে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: ‘প্রত্যেক বস্তুর যাকাত আছে। আর শরীরের যাকাত হলো রোজা’।(সুনানে ইবনে মাজাহ)।

খ. এলার্জি এবং চর্মরোগ নিরাময়ক: এলার্জি, রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস, সোরিয়াসিস নামক চর্মরোগ নিরাময়ে সিয়াম পালনের সহায়ক ভূমিকা রয়েছে বলে ধারণা অনেক চিকিৎসাবিজ্ঞানীর।

গ. ডায়বেটিস প্রতিরোধ: সারাদিন উপবাস করলে ‘গ্লুকোজ’ বা শর্করা জাতীয় খাদ্যের দ্রুত ক্ষয় শুরু হয় এবং তা দেহের প্রয়োজনীয় শক্তি বৃদ্ধি করে। ফলে ‘গ্লাইকোসেন’ তৈরি হওয়ার পাশাপাশি শরীরের ‘ব্লাডসুগার’ অনেকটাই কমে যায়। যা ডায়বেটিস প্রতিরোধে সহায়ক হয়ে থাকে।

ঘ. ওজন হ্রাস: সাধারণত আমাদের চারিদিক নানান আয়োজনের কারণে প্রতিনিয়ত খাবারের হিড়িক পড়ে যায় বলে শরীরের ওজন দ্রুত বেড়ে যায়। তাই ডায়েট করার চিন্তাই আমাদের মাথায় আসে না। কিন্তু সিয়াম পালনকালে রোজাদার ব্যক্তি যেহেতু বাধ্য হয়েই উপোস করে, সেহেতু জমে থাকা শরীরের চর্বিসর্বস্ব ততক্ষণে বিগলিত হতে থাকে। ফলে ওজনও নেমে আসে প্রয়োজনমত। যা ডায়েটের বিকল্প চালিকাশক্তির কাজ করে।

ঙ. নেশাজাতীয় দ্রব্য থেকে দূরত্ব: নেশাজাতীয় দ্রব্যকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। কারণ এতে উপকারের চেয়ে অপকারের মাত্রাই বেশি। নিষিদ্ধ কোন খাদ্য বা পানীয় তো দূরের, রোজাবস্থায় যেকোন বৈধ খাদ্য গ্রহণ করাও নিষেধ। তাই সিয়াম সাধনার দরুন কেউ চাইলেও ধুমপান করতে পারে না। তা করলে যে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। সবধরণের মাদকতাকে ‘না’ বলতে হয় এই মাসেই।

চ. রক্তচাপ হ্রাসে সহায়ক: আমেরিকায় সিয়াম পালনের উপকারিতা সম্পর্কে পরিচালিত এক গবেষণায় জানা যায়, ‘রোজা রাখলে তা রক্তচাপ কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে’। টানা কয়েক ঘণ্টা না খেয়ে থাকলে ‘স্ট্রেস হরমোন’ খুবই নিচে নেমে আসে। এতে রক্তচাপ হ্রাস পায়। এছাড়া কোলেস্টরলের পরিমাণও কিছুটা অবনমিত হয়; ফলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমে আসে।

এইভাবে আরো অসংখ্য উপকারিতা রয়েছে সিয়াম বা রোজা পালনের। এতে আমাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং ফিট থাকার মত শক্তি সঞ্চিত হয়। আমাদের উচিত এই মাসের খাবারে তেল ও ‘জাঙ্ক ফুডস’ একটু কম পরিমাণে গ্রহণ করা। তাহলে ইফতারি ও সাহরির খাবার স্বাস্থ্যসম্মত, মুখরোচক হয়ে সকলের শরীর ও মন উভয়েই প্রশান্তি বয়ে আনবে।