চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রেইনট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য স্ববিরোধী, অগ্রহণযোগ্য

রাজধানীর বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সোচ্চার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রেইনট্রি হোটেলে তদন্ত করতে যায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। অভিযান চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরও। এই দুই ঘটনার মধ্যেই সেই রাতে (ধর্ষণের রাতে) আপত্তিকর কোনো কিছু ঘটেনি বলে দাবি করে হোটেল কর্তৃপক্ষ। তবে তাদের বক্তব্যে স্ববিরোধী ও অসংলগ্ন কথাবার্তা লক্ষ্য করা গেছে।

তারা বলছে, ১. ঘটনার রাতে হোটেলের স্ক্যানার মেশিন অকার্যকর থাকায় কোনো ব্যক্তি মদ নিয়ে হোটেলে ঢুকেছিলো কি না তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

২. সেদিন (২৮ মার্চ) অস্ত্র ফ্রন্ট ডেস্কে জমা দিয়ে হোটেলে প্রবেশ করেছিল সাফাত, সাদমান ও নাঈমরা। ফলে ধর্ষণের শিকার দুই তরুণী অস্ত্রের মুখে ধর্ষণের যে অভিযোগ করেছেন, তা মিথ্যা।

৩. রেইনট্রি হোটেলের প্রতিটি রুম সাউন্ডপ্রুফ। রুমের মধ্যে যদি কেউ চিৎকার করলেও তো বাইরে থেকে শোনার উপায় নেই।

তাদের দেয়া বক্তব্যের প্রথম এবং দ্বিতীয় বক্তব্য যে স্ববিরোধী এবং সাংঘর্ষিক, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে তা সহজেই বোঝা যায়। কেননা ঘটনার রাতে হোটেলের স্ক্যানার মেশিন অকার্যকর থাকায় কেউ মদ নিয়ে ভেতরে ঢুকেছে কি না তা তারা বলতে পারেননি। এর মানে হচ্ছে স্ক্যানার মেশিন অকার্যকর থাকার পরেও নিয়মমাফিক তারা অভিযুক্তদের দেহ তল্লাশি করেননি। তাই যে হোটেল কর্তৃপক্ষ কেউ মদ নিয়ে ভেতরে ঢুকেছে কি না তা বলতে পারছে না, সেখানে অভিযুক্তরা সেখানে অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে পারেনি সেটি কীভাবে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে?

রেইনট্রি কর্তৃপক্ষ তাদের দেহ তল্লাশি করবেই বা কীভাবে? কেননা ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত প্রায় সবাই ওই হোটেলের একজন পরিচালকের বন্ধু বলে সংবাদমাধ্যম মারফত জানা যাচ্ছে। এছাড়া ওই হোটেলটি এই অপরাধীদের অপরাধ সংঘটনের নিয়মিত আখড়া হিসেবেই ব্যবহৃত হওয়ার খবরও এখন পাওয়া যাচ্ছে।

আর আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটি চার তারকা হোটেলের এমন দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা কখনোই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। তারা মূলত: নিজেদের সুনাম এবং মালিকপক্ষের অপরাধ লুকানোর জন্যই এসব কল্পকাহিনী হাজির করছে।

তাদের বক্তব্যের তৃতীয় পয়েন্টটি পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়, তারা মূলত: নিজেদের রক্ষার জন্যই এতদিন পর বিচারকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে এসব বক্তব্য দিচ্ছে। কেননা সাউন্ডপ্রুফ হওয়ায় ভেতরে কেউ চিৎকার করলেও যদি বাইরে থেকে কোনো শব্দ শোনা না যায়, তাহলে সেখানে ধর্ষণের ঘটনা না হওয়ার স্টেটমেন্ট তারা দিতে পারে না। তাদের বক্তব্য তখনই গ্রহণযোগ্য হতো, যখন ভেতরে কেউ চিৎকার করলে স্বাভাবিকভাবে সেই শব্দ বাইরে আসতো।

তাদের বক্তব্য রিজেক্ট হওয়ার আরেকটি কারণ হলো- এর আগে দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে গ্রেফতারকৃত আসামি সাফাত ও সাদমান সাকিফকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছিলেন ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (অপরাধ বিভাগ) কৃষ্ণ পদ রায়। পুলিশ যেখানে বলছে আসামিদের কাছ থেকে এ ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে, সেখানে ‘ওই রাতে আপত্তিকর কিছু ঘটেনি’ বলে তাদের দেয়া বক্তব্য মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়ার মতো দণ্ডনীয় অপরাধ।

কেন এসব ঘটনা ঘটছে
গ্রেফতাকৃত অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ বলছে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যে অপরাধ, তা জানে না বলে দাবি করেছে সাফাত আহমেদ। সে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, তারা ‘মেয়ে বন্ধুদের’ সঙ্গে প্রায়ই পার্টিতে ‘এমনটা’ করে থাকে। জন্মদিনের পার্টির এই ঘটনা যে এত বড় হতে পারে, তা তার ধারণাতেই ছিল না।

এতে বুঝা যায়, ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হিসেবে সাফাত উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করতো। অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে তার স্বাভাবিক বিষয় বলেই মনে হতো। সাফাত ও সাদমানরা এমন পরিবেশে বড় হয়েছে যে, তাদের কাছে ‘ধর্ষণ’ কোনও বড় বিষয় নয়। তাদের অনেক মেয়েবন্ধু রয়েছে এবং তাদের ভাষায় মাঝেমধ্যেই মেয়েবন্ধুদের সঙ্গে তারা  ‘আনন্দ-ফূর্তি’ করে।

এছাড়া এই ঘটনার শুরু থেকেই আপন জুয়েলার্সের মালিক নিজের ছেলের অপরাধকে সমর্থন করে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিচ্ছেন। এমনকি এসব ঘটনায় ‘জোয়ান ছেলে এমন কিছু করতেই পারে। আমিও তো প্রায় সময় এসব করে থাকি…’ বলে নির্লজ্জভাবে একটি পত্রিকার সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন। নৈতিকতা বিবর্জিত ধনাঢ্য এসব পিতা-মাতার কারণেই এসব ঘটনা অহরহ ঘটছে।

এর আগেও প্রথম আলো পত্রিকার ফটো সাংবাদিক জিয়া ইসলাম আহতের ঘটনায় সারাদেশে যখন মদ্যপ অভিনেতা কল্যাণ কোরাইয়ার পক্ষ নিয়ে সোহানা সাবা নামের আরেক মডেল বলেছিলেন, ‘এদেশে তো এমন আইনও নেই যে মদ খেয়ে গাড়ি, বাইক, ট্রাক, বাস চালানো যাবে না। তাহলে হয়ত রাতে ১০ ভাগ গাড়িই চলতো না।’

এর অর্থ হলো, তথাকথিত এই মডেলের চারপাশে থাকা বন্ধু কিংবা পরিচিত সার্কেলের প্রায় ৯০ ভাগই মদ খেয়ে গাড়ি চালায়। কেননা মানুষ তার চারপাশের পরিবেশ দিয়েই স্বাভাবিকভাবে সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে। কিন্তু এই পরিবেশের কারণে সে জানে না বাংলাদেশে অন্য মাদকদ্রব্যের মতো মদ্যপানও নিষিদ্ধ। তাই মদ খাওয়া প্রথম অপরাধ হলে মদ খেয়ে গাড়ি চালানো আরো একটি অপরাধ।

এ দু’টো ঘটনায় দেখা যাচ্ছে তথাকথিত আধুনিক সোসাইটিতে ছেলেমেয়েরা জানেই না মদপান, মদপান করে ড্রাইভিং কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনা একটি অপরাধ। এই না জানার মতো পরিবেশের কারণেই তাদের দ্বারা অহরহ ঘটনা ঘটে চলেছে। তাই নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত কোনো কিছু না জানা পরিবেশে বড় হওয়া এসব ছেলেমেয়েকে জঙ্গিগোষ্ঠী সহজেই টার্গেট করে মগজ ধোলাই করে এর চেয়েও বড় অপরাধ সংঘটিত করতে পারে। গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা ছাড়াও নিকট অতীতে আমরা এসব বিষয় দেখতে পেয়েছি।

তাই মানবিক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়তে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বখে যাওয়া রুখতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

সামাজিক যেসব সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে
বনানীর এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা গেছে। ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনতে মানুষ যখন ক্ষোভে ফেটে পড়েছে, তখনও একশ্রেণীর লোককে ধর্ষণকে জায়েয করার পক্ষে কথা বলতে দেখা গেছে। সংখ্যায় ছোট হলেও এই অংশটি মূলত: বলতে চেয়েছে, গভীর রাতে ওই মেয়েরা কেন জন্মদিনের পার্টিতে গেছে? পার্টিতে যাওয়ার কারণেই তাদের ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে।

আশার বিষয় হচ্ছে, এই অংশটি এবার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তেমন সরব হতে পারেনি। ফেসবুকেই তারা ‘ধর্ষকের মানসিক সহযোগি’ খেতাব পাওয়ার পাশাপাশি অনেক সমালোচনার শিকার হয়েছে।

এই প্রজন্মকে বুঝাতে হবে যে, মেয়েরা কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে তাদেরকে ধর্ষণ করা জায়েয হয়ে যায় না। তারা কর্মক্ষেত্রে আসার জন্য ঘরের বাইরে আসলেই তাদেরকে ধর্ষণ করা জায়েয হয়ে যায় না। তাদের পরনের পোষাকের কারণে কখনোই মেয়েদেরকে ধর্ষণ করা জায়েয হয়ে যায় না। এছাড়া শুধু নারীকে সংযত করা নয়, বরং পবিত্র কোরআন এবং হাদিসেও সুস্পষ্টভাবে পুরুষের চোখকে সংযত করার বিষয়ে বলা হয়েছে। আর পোষাক কিংবা অন্য কারণে নয়, বরং ধর্ষণের জন্য নৈতিকতাহীন পুরুষের বিকৃত মানসিকতাই যে দায়ী, সামাজিকভাবে এই বিষয়গুলোকে যতোদিন আমরা সামনে আনতে না পারবো, যতোদিন পর্যন্ত এই অপরাধীদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে না পারবো, আইনের আওতায় এনে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে না পারবো, যততোদিন পর্যন্ত ধর্ষণের মতো অপরাধ কোনোভাবেই শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে না।

নীতি, নৈতিকতা বিবর্জিত সমাজ ব্যবস্থাকে এভাবে প্রচণ্ড রকমের ধাক্কা দিতে না পারলে গাজিপুরের বাবা-মেয়ের আত্মহত্যা কিংবা বনানীর ঘটনার মতো ঘটনা আমাদেরকে নিয়মিত দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)