এটা তো জানা কথা, কেউ সুখী নয়। সুখী হওয়া কি এতই সহজ? তবুও কেন যে তা বুঝতে পারতাম না। নিজেকে অসুখী মনে করে একাকী কষ্ট পেতাম। তার গান শোনার পর মনে হলো কেন আমি অকারণে কষ্ট পাই? তার গান যখন শুনি, বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সুখের মতো টুকরো টুকরো অনুরণন। তাতে কি লেগে থাকে বিষাদও। মনটা যেন কেমন কেমন করে। মনের কষ্ট আর গানের কষ্ট মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
মাইনাসে মাইনাসে কি প্লাস হয়ে যায়? এমনটি কী কারণে মনে হয়, আমি ঠিক জানি না। তবে তার গান শুনলে সুখী হতে না পারার কষ্টটা বেশ কিছু সময়ের জন্য আর থাকে না। তিনি তো গেয়েছেন, ‘সুখেরই পৃথিবী, সুখেরই অভিনয়, যত আড়ালে রাখো, আসলে কেউ সুখী নয়। নিজ ভুবনে চিরদুঃখী, আসলে কেউ সুখী নয়।’ চিরদুঃখী আমি তখন বুঝতে পারি, পৃথিবীতে দুঃখীর সংখ্যাই বোধকরি বেশি। তখন আর নিজেকে খুব একটা একলা মনে হয় না। তার গানগুলো আমার সঙ্গী হয়ে যায়। আমাকে কাঁদায়। আমায় হাসায়। আমাকে ভালোবাসায়।
আমরা যে সময়ে বেড়ে ওঠেছি, সেই সময়ের যা কিছু আমাদের আনন্দিত করতো, আপ্লুত করতো, আবেগে ভাসিয়ে দিত, তার রূপালী গিটারটা তার অন্যতম। এই গিটারটা যে কীভাবে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো, তা বোঝানো যাবে না। তার ইন্দ্রজালিক সুরমাধুর্য স্পর্শ করতো হৃদয়তন্ত্রীতে। তার গায়নশৈলী অদ্ভুত এক মাদকতায় ভরিয়ে দিত। দোলায়িত হতাম সুরের মায়াবী এক জগতে। বুকের ভিতর জমে থাকা কষ্টগুলো গলে গলে যেত। আবার মন খারাপ থাকলে তিনি হতেন পরম এক বন্ধু। তার গান দিয়ে তিনি টেনে নিতেন তার বুকে। তার গাওয়া গানগুলো কী যে আবেশ ছড়িয়ে দেয়। মনের কষ্টগুলোও অনেকটা লাঘব হয়ে যায়। তারা ভরা রাতে মনের মানুষ যখন মনের ব্যথা বুঝতে চায় না, তার চেয়ে বেদনার আর কী আছে? কে আর এমন সাবলীলভাবে গাইতে পারে, ‘সেই তারা ভরা রাতে, আমি পারি নি বোঝাতে, তোমাকে আমার মনের ব্যথা। তুমি তো বলেছো শুধু, তোমার সুখের কথা।’ হায়! এই জীবনে কেউ চিনলো না। বুঝলোও না। সেক্ষেত্রে তার গানই হয়ে ওঠে হৃদয়ের কথকতা। ‘বোঝে না কেউ তো চিনলো না, বোঝে না আমার কী ব্যথা, চেনার মতো কেউ চিনলো না, এই আমাকে।’
জীবনের হিসেব কখনও মেলাতে পারি নি। প্রিয় মানুষের সঙ্গেও তো মেলে নি। তাই কান্না আর বিচ্ছেদ হয়ে যায় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘কখনো ভাবি নি আমি, ব্যথা দিয়ে তুমি চলে যাবে, কি জানি কী ভুল ছিল আমার, আমাকে কেন গেলে কাঁদিয়ে, তাই আমি ফিরে আসি বারেবার।’ এ কারণে কত আশা নিয়ে কত কত দিন ছুটে গিয়েছি প্রিয় সেই মানুষের কাছে। ফিরতে হয়েছে নিরাশ হয়ে। তখন বুকের ভিতর বেজেছে, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি, তাই তোমার কাছে ছুটে আসি’। কষ্ট পেতে পেতে কত না কেঁদেছিও। চেয়েছি কত কিছুই করতে। তবে আকাশে উড়াল দেওয়ার কথা কখনও ভাবি নি। সেটা তিনি ভাবিয়েছেন, ‘আর কত এভাবে আমাকে কাঁদাবে, আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে, এই বুকে যন্ত্রণা বেশি সইতে পারি
না, আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে।’ আকাশে উড়াল দিতে না পারলেও তা দিয়েছে সান্ত্বনার প্রলেপ।
যত কষ্টের, যত দুঃখের, যতই বেদনার গান তিনি গান গেয়ে থাকেন না কেন, তার বুকভর্তি ছিল অপরিসীম ভালোবাসা। এই ভালোবাসা দেখা যায় তার সুরে, তার সংগীতে, তার জীবনে। তার প্রকাশ ঘটেছে এভাবে ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে, সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম, কেমন করে এত অচেনা হলে তুমি…তুমি কেন বোঝো না তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়, আমার সবটুকু ভালোবাসা তোমায় ঘিরে…কত রাত আমি কেঁদেছি, বুকের গভীরে কষ্ট নিয়ে, শূন্যতায় ডুবে গেছি আমি, আমাকে তুমি ফিরিয়ে নাও।…যতবার ভেবেছি ভুলে যাবো, তারও বেশি মনে পড়ে যায়, ফেলে আসা সেই সব দিনগুলো, ভুলে যেতে আমি পারি না।’
সবাইকে একদিন চলে যেতে হয়। যেতেই তো হবেই। এটাকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। এ কারণে তিনি তো গেয়েছেন, ‘এই রূপালী গিটার ফেলে, একদিন চলে যাবো অনেক দূরে, বহুদূরে’। তার গানের কথা অনুযায়ী, তার রূপালী গিটারটা আছে। তিনি চলে গেলেন। তিনি এবি। আইয়ুব বাচ্চু। কিন্তু এভাবে তো তার চলে যাওয়ার কথা ছিল না।
এমনভাবে হতভম্ব করে দিয়ে চলে যাবেন! এমনটি কেমন করে হয়! কত রাত কত দিন তিনি ক্লান্তিহীনভাবে আমাদের গান শুনিয়েছেন। এখনও হয়তো তার গান শুনবো। কিন্তু নতুন কোনও গান আর শোনা হবে না। তিনি গেয়েছেন ‘ভাঙা মন নিয়ে তুমি আর কেঁদো না’। বললেই কি সব কথা মানা যায়? দু’ চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বেদনার অশ্রু।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)