আনিসুল হক। একজন মেয়র ছিলেন বিভক্ত ঢাকার। অনেক মেয়রই ছিলেন এই ঢাকায়, কিন্তু অল্প কিছুদিন থেকেও কেন এত দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন এই মানুষটি? সেটা সবাই কমবেশি জানেন এ ঢাকার মানুষ। নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।
যারাই এখন মেয়র হতে চান, তার নাম এবং তার কাজের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তিনি কেমন স্বপ্ন দেখতেন এই ঢাকাকে নিয়ে সেই প্রসঙ্গই ঘুরেফিরে চলে আসে আলাপ আলোচনায়। তিনি স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য যারপর নাই চেষ্টা করতেন – এটাই তার বড় সার্থকতা, আর কিছু না। তার চারপাশের মানুষগুলোকে ভালোভাবে চিনতেন। কে কী মতলব নিয়ে ঘোরাফেরা করছে, কে তাকে তাল দিয়ে যাচ্ছে নিজের স্বার্থের জন্যে, সেটা তিনি বুঝতে পারতেন বলেই অন্যদের চেয়ে আলাদা হতে পেরেছেন। আর কিছু না। খুব সিম্পল হিসেব এটা।
এই বুঝতে পারার বিষয়টি তার স্ত্রী, বিজিএমইএ’র বর্তমান সভাপতি রুবানা হক ২১ জানুয়ারি রাজধানীর রাওয়া কনভেনশন হলে ‘শহর নিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক সভায় ঢাকা উত্তরের মেয়রপ্রার্থী আতিকুল ইসলামকে বোঝাতে চেয়েছেন। তিনি ঢাকার কিছু সমস্যা উল্লেখ করে ১০টি পরামর্শ দিয়েছেন মেয়রপ্রার্থী আতিক সাহেবকে।
রুবানা হক বারবার বলেছেন, তোষামোদকারীদের আনিসুল হকের কাছে ভিড়তে দেননি তিনি এবং তার ছেলেমেয়েরা। তিনি বলেছেন, ‘আতিক ভাই আমাদের খুব শ্রদ্ধার মানুষ, তাকে যেন আমরা কেউ নষ্ট না করি। আমরা অহেতুক তোষামোদ করি। বড় নেতার পাশে সমানে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে পথভ্রষ্ট করি। এই জায়গায় আতিক ভাইয়ের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনি কাউকে নষ্ট করতে দিয়েন না।’
এরপর রুবানা হক ঢাকার কয়েকটি সমস্যার কথা তুলে ধরেন। ঢাকাকে ঢেলে সাজাতে স্বপ্ন দেখার পরামর্শ দেন আতিকুল ইসলামকে।
রুবানা হকের এই প্রত্যাশা ঢাকা শহরের উন্নয়নের জন্যে খুবই আশাব্যঞ্জক, সন্দেহ নেই। তবে তোষামোদকারীরা আতিকুল ইসলামের সঙ্গে যেভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তা টেলিভিশনের কল্যাণে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে আমাদের। তাতে করে রুবানা হকের প্রত্যাশা প্রত্যাশার জায়গায়ই থাকবে – এমন আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
ঢাকা শহরের বহু জায়গায় যারা চাঁদাবাজি করে, ঠিকাদারি কাজ করে, ফুটপাত দখল করে দোকানপাট বসিয়ে, এবং মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করে গত ১০/১১ বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে তাদের কারো কারো চেহারা প্রচার-প্রচারণায় আতিকুল ইসলামের পাশে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে – বোধকরি রুবানা হক তাদের চেনেন ভালোভাবেই, আর সেজন্যই ওই ‘তোষামোদকারী’ শব্দটা বারবার উচ্চারণ করেছেন তার বক্তৃতায়।
ঢাকা শহরকে সাজাতে বা ঢাকার অনেক বাসস্ট্যান্ড দখলদারদের এবং সরকারের খুব কাছের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকা দুষ্টচক্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে যে ধরনের মনোবল আর সদিচ্ছা, সৎসাহস লাগে সে জায়গায় কতটুকু পারবেন মেয়রপ্রার্থী আতিক, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
কারণ ঢাকাতে সাজাতে সরকারের ভেতরের মানুষের সহযোগিতা লাগবে। কারণ সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নষ্ট করে থাকে ঢাকার সৌন্দর্য – ফুটপাত দখল থেকে শুরু করে বাসস্ট্যান্ড না থাকার পরেও যত্রতত্র যানবাহন রেখে চাঁদাবাজি করে মাসে কোটি কোটি টাকা কামানোর সাহস অন্য কারোর থাকার কথা না। ক্ষমতার খুব কাছের লোকদের মৌন সমর্থন নিয়েই এটা চলে – আনিসুল হক এটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই ট্রাক স্ট্যান্ড দখলমুক্ত করার মতো একটা সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পেরেছিলেন। আর সেটার জন্য হিম্মত লাগে, তাগদ লাগে। সেই জায়গায় আতিক সাহেব বিজয়ী হলে কতটুকু পারবেন সেটাই দেখার বিষয়। কারণ তার চারপাশে এখন যারা নিয়মিত টেলিভিশনে নিজেদের চেহারা দেখিয়ে সরকারের হবু ক্ষমতাবানদের সঙ্গে থাকার সার্টিফিকেটটি নিচ্ছে তারাই আগামীতে মেয়রের গলার কাঁটা হবে না এমনটা বলা খুবই মুশকিল।
আনিসুল হক স্বপ্নবান পুরুষ। স্বপ্ন দেখাতে এবং স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করতেন। তার স্ত্রী রুবানা হকও তেমনি একজন। আমরা আশায় বুক বাঁধতে চাই। আনিসুল হকের স্বপ্নের ঢাকায় বসবাস করে যানজটমুক্ত থাকতে চাই। অহেতুক মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের সামনের বাস দাঁড় করিয়ে রেখে যানজট সৃষ্টি হবে না, সরকারি দলের পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের লোকজনের অত্যাচার থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য দুই ঢাকায় তেমন দুজন মেয়র চাই। তারা যে দলেরই হোক না কেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)