চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রিপাবলিকানদের ট্রাম্প কার্ড

দ্বি-দলীয় রাজনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে প্রধান প্রার্থী যথারীতি দুজন। একজন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড জে ট্রাম্প অন্যজন ডেমোক্রেটিক পার্টির হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন। এই দুজন ছাড়া আরও চার জন প্রার্থী এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেনঃ লিবার্টারিয়ান পার্টির গ্যারি জনসন, গ্রিন পার্টির জিল স্টেইন, কন্সটিটিউশন পার্টির ড্যারেল ক্যাসেল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ইভান ম্যাকমুলিন। ৩ নভেম্বরের জনমত জরিপ অনুযায়ী গ্যারি জনসনের জনসমর্থন রয়েছে ৩% এবং জিল স্টেইনের ২%। অন্য দুজনের পক্ষে জনমত কত রয়েছে তা কোন জরিপকারী জানাচ্ছে না বা জানানোর মত নয়।

এই লেখার সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের থেকে কয়েকটি জনমত জরিপে পিছিয়ে আছেন কয়েকটিতে এগিয়ে আছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যে সকল জরিপ নিয়ে আলোচনা করে (সিবিএস/নিউইয়র্ক টাইমস, এবিসি/ওয়াশিংটন পোস্ট, রয়টার/ইপসস) সেগুলোতে ট্রাম্প পিছিয়ে। লস এঞ্জেলেস টাইমস/ ইউএসসি এবং রাসমুসেন জরিপ অনুযায়ী তিনি এগিয়ে আছেন। আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা মুডি’স বলেছে, ইলেক্টোরাল কলেজের ৫৩৮ ভোটের মধ্যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি পাবেন ৩৩২ ভোট। রিপাবলিকানের ট্রাম্প পাবেন ২০৬ ইলেক্টোরাল ভোট। অর্থাৎ ১২৬ ভোট বেশী পেয়ে জিতবেন হিলারি ক্লিনটন। ১৯৮০ সাল থেকে বিভিন্ন অংক কসে মুডি’স এই পুর্বাভাস দিয়ে আসছে যার প্রতিটি সঠিক হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে হিলারির জেতার সম্ভাবনা ৮৫%; কয়েকদিন আগে রয়টার্স বলেছে ৯৫%।

candidates
গ্যারি জনসন, জিল স্টেইন, ড্যারেল ক্যাসেল ও ইভান ম্যাকমুলিন

এবারে খুবই ব্যাতিক্রমধর্মী নির্বাচন হতে যাচ্ছে। গালাগালি এবং নোংরামিতে ভরা নির্বাচনী প্রচারণায় বিরক্ত হয়েছেন সেখানকার সুস্থ বুদ্ধির মানুষেরা। প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক অসম্ভব রকমের ব্যাতিক্রম। এতকাল পর্যন্ত যত রকমের মানুষ আমেরিকায় প্রার্থী হয়েছেন তাদের কারোর সঙ্গে কোন রকমের মিল তাঁর নেই। রিয়েলিটি শো করে মানুষকে বিনোদন দেয়ার কারণে সাধারণের মধ্যে তাঁর পরিচিতি থাকলেও তাঁর নেই কোন রাজনীতির অভিজ্ঞতা। কোনদিন তিনি জনপ্রতিনিধি ছিলেন না এমনকি কখনো কোন নির্বাচন পর্যন্ত করেননি। ট্রাম্প নিজের সম্পদ নিয়ে খুব বড়াই করেন। বোঝাতে চান সম্পদ অর্জন করা একটা কঠিন কাজ এবং তিনি নিজে তা করে দেখিয়েছেন। অতএব তিনি যোগ্য। যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেয়া প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। তিনি নিজে যে খুব বেশী সম্পদ অর্জন করেছেন এমনও নয়। রিয়েল এস্টেট ব্যাবসায়ী ট্রাম্প বাপের আমল থেকে সম্পদশালী। তাঁর নীট সম্পদের পরিমাণ ৩.৭ বিলিয়ন ডলার বলে আলোচনা আছে। এই পরিমাণ নিয়ে অনেক বিতর্কও আছে। অনেকেই বলেছেন এটা বানানো তথ্য। তাঁর প্রকৃত সম্পদ আসলে আরও কম। তুলনা করার জন্য বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধনী বিল গেটস এর সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করা যায়। গেটস এর সম্পদ বর্তমানে ৮১.৩ বিলিয়ন ডলার। ট্রাম্প এখন পর্যন্ত নিজের ট্যাক্স ফাইল জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি। তাই তাঁর সম্পদের সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

বিগত ৪০ বছরের মার্কিন নির্বাচনের ইতিহাসে সকল প্রার্থী নির্বাচনের আগে নিজ নিজ ট্যাক্স ফাইল জনগণের কাছে প্রকাশ করেছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম হতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কেন তিনি তাঁর প্রকৃত সম্পদ, আয়-ব্যয় এবং কর দেয়ার পরিমাণ জনগণকে জানতে দিচ্ছেন না তার একটা ব্যাখ্যা তৈরী করেছে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী শিবির। হিলারি ক্যাম্প থেকে বলা হচ্ছে, ট্রাম্প বিশ বছর আগে নিজের কোম্পানির ক্ষতির পরিমাণ এত বেশী করে দেখিয়েছেন যে পরবর্তী সময়ের লাভের পরিমাণ এখনো তার সমান হয়নি। ফলে তাঁকে ২০ বছর ধরে কর দিতে হচ্ছে না। ধনীদের পক্ষে তৈরী করা মার্কিন কর আইনের অনেক ফাঁক-ফোঁকরের মধ্যে এটা একটা। এই ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্পের মত মার্কিন ধনীরা। হিলারি ক্লিনটন তাঁকে যখন বিতর্কের সময় একথা বলে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছে তখন তিনি যে জবাব দিয়েছেন তা মোটামোটি এরকম – তোমার ওয়াল স্ট্রীটের বন্ধুরাও একই ভাবে কর ফাঁকি দেয়। আর তুমি তাদের চাঁদার টাকায় এই নির্বাচন পরিচালনা করছ।

এ পর্যন্ত তিনবার বিয়ের পিড়িতে বসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সর্বশেষ বিয়েটি করেছেন ২০০৫ সালে। এই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন এবং তাঁর স্ত্রী বর্তমানে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটন। তাঁর বর্তমান এবং প্রাক্তন স্ত্রীদের সকলেই কোন না কোন ভাবে আলোচিত ছিলেন। প্রথম স্ত্রী অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী, দ্বিতীয়জন গণবিনোদিনী এবং তৃতীয় জন মডেল। তৃতীয় জন অর্থাৎ বর্তমান স্ত্রী মেলিনা প্লেবয় ম্যাগাজিনের পর্ণ তারকা হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট ২০০৫ সালের একটা ভিডিও প্রকাশ করার পর তাঁর নারী সংসর্গের খবরা-খবর ব্যাপকভাবে মিডিয়ায় চলে আসে। ভিডিওটিতে ট্রাম্প একজন নারী সাংবাদিকের (যিনি প্রাক্তন রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ পরিবারের সদস্য) সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারীতায় নারীদের নিয়ে অশ্রাব্য কথাবার্তা বলেছেন। এ পর্যন্ত ১১/১২ জন নারী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে যৌন হয়রানীর অভিযোগ করেছেন। ভিডিও প্রকাশের পর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিতর্কে ট্রাম্প হিলারি ক্লিনটনের স্বামী বিল ক্লিনটনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানীর অভিযোগকারী চার নারীকে নিয়ে বিতর্ক স্থলে উপস্থিত হন।
PALM BEACH, FL: Newlyweds Donald Trump Sr. and Melania Trump with Hillary Rodham Clinton and Bill Clinton at their reception held at The Mar-a-Lago Club in January 22, 2005 in Palm Beach, Florida. (Photo by Maring Photography/Getty Images/Contour by Getty Images)

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, এবং অর্থনীতি সে দেশের চলমান ন্যায়-নীতিগুলো থেকে একেবারে ১৮০ ডিগ্রী বিপরীত। তিনি হিস্পানিক, মুসলিম, কালো, অভিবাসী এবং নারীদের সম্পর্কে তাঁর নির্বাচনী প্রচারাভিযানের বিভিন্ন পর্যায়ে কটূক্তি করেছেন। তিনি নির্বাচিত হলে মেক্সিকোর সীমান্তে মেক্সিকোর খরচে দেয়াল তুলে দেবেন, কোন মুসলিমকে আমেরিকায় ঢুকতে দেবেন না, সকল অবৈধ অভিবাসীকে দেশ থেকে বের করে দেবেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সকল রকম বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিল করবেন, যেসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে তা পূরণের জন্য শুল্ক হার বাড়িয়ে দেবেন, ন্যাটো সদস্যদের নিরাপত্তা দানের জন্য বাড়তি ফি আদায় করবেন ইত্যাদি। তিনি নির্বাচিত হলে রিপাবলিকান নীতি বিরুদ্ধ খরচ করবেন বয়স্কদের জন্য, অবকাঠামোতে, প্রাক্তনযোদ্ধাদের জন্য,  শিক্ষায় এবং শিশুদের জন্য। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে ধাপ্পাবাজি বলেছেন এবং নির্বাচিত হলে এই খাতে সকল বরাদ্দ বাতিল করবেন। ট্রাম্প ‘৮৯ সালে চীনের তিয়ানানমেন স্কয়ারের প্রতিবাদ দমনকে এবং রাশিয়ার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য  প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রশংসা করেছেন। এ সকল বক্তব্যের প্রতিটি এতকাল ধরে আমেরিকার প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো যে সকল নীতি মেনে চলেছে তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছেন মোট ১৭ জন। তাদের মধ্যে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের পুত্র এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের ভাই, গভর্নর জেব বুশও ছিলেন। মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলেন চার জনঃ সিনেটর টেড ক্রুজ, সিনেটর মার্কো রুবিও, গভর্নর জন কাসিখ এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প। দলীয় কর্মী-সমর্থকদের সরাসরি ভোটে রাজনীতিতে অভিজ্ঞ দুইজন সিনেটর এবং একজন গভর্নরকে হারিয়ে মহীয়ান পুরাতন দল, রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন ছিনিয়ে নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এত বৈপরীত্য এবং চারিত্রিক দূর্বলতা নিয়ে একজন মানুষ কিভাবে আমেরিকার মহীয়ান পুরাতন দলের মনোনীত প্রার্থী হলেন – এটাই একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাঁর শক্তির উৎস কোথায়? তাঁর শক্তির উৎস সস্তা জনপ্রিয়তায় এবং মহীয়ান পুরাতন দলের ধনীদের স্বার্থ রক্ষাকারী নীতিমালায়। ট্রাম্প যখন পার্টির মনোনয়ন পাওয়ার নির্বাচনের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন তখন দলের নেতারা চাইলে তাঁকে থামাতে পারতেন। ট্রাম্পকে ঠেকানোর জন্য বেশ কয়েক বার টেড ক্রুজের পক্ষে অন্য সকল প্রার্থীর সমর্থন দিয়ে সরে যাওয়ার আলোচনা মিডিয়ায় এসেছে। এমনকি মনোনয়ন নির্বাচনে জিতে যাওয়ার পরেও নেতাদের সুযোগ ছিল কনভেনশনে তাঁকে মনোনীত না করে অন্য কাউকে মনোনীত করার। এই দুই অপশনের কোনটি বাস্তবায়ন হয়নি। তাঁর মানে এই দাঁড়ায় যে শীর্ষ নেতারা বারাক ওবামা সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ট্র্যাডিশনাল কোন রিপাবলিকান প্রার্থীকে দিয়ে রাষ্ট্রপতি পদ জেতার কথা ভাবতে পারেননি; এই পদে জেতার জন্য ট্রাম্প ছাড়া অন্য কারো উপর ভরসা রাখতে পারেননি। ট্রাম্পকে তাঁরা নির্বাচন জেতার ট্রাম্পকার্ড হিসেবে বাজারে ছেড়েছেন। পরবর্তী সময়ে ট্রাম্পের ভিডিও প্রকাশ হওয়ার পর যখন মিডিয়া ব্যাপকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে লেগেছে তখন জনা পঞ্চাশেক রিপাবলিকান বিগ ফিগার মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে তাঁদের সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন। তাঁর পরেও ট্রাম্পের সঙ্গে রয়ে গেছেন সাবেক স্পিকার নিউট গিংগ্রীচের মত মহীরুহ। ট্রাম্পকে জিতিয়ে আনতে পারলে রিপাবলিকানদের মূল শক্তি কেন্দ্র বিলিয়নিয়ারগণের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব হবে। image

ট্রাম্পের আরেক শক্তি হচ্ছে তাঁর ব্যাক্তিগত ক্যারিশমা। তিনি টেলিভিশনে রিয়ালিটি শো উপস্থাপনা করেছেন। তিনি জানেন কিভাবে মানুষকে কোন বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে হয়, ধরে রাখতে হয়। তিনি এই টেকনিকটি কাজে লাগিয়েছেন দীর্ঘ দিনের অর্থনৈতিক বৈষম্য পীরিত সাদা, স্বল্প শিক্ষিত, খেটে খাওয়া মানুষের সমর্থন আদায়ে যারা মার্কিন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ। নির্বাচনে জেতার জন্য সকলের ভোটের প্রয়োজন নেই। ছলে, বলে, কৌশলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারলেই চলবে। তাই তিনি সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।

যুক্তরাজ্যে মার্গারেট থ্যাচার এবং যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড রিগ্যানের সময়ে শুরু হওয়া মুক্তবাজার অর্থনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল গ্লোবালাইজেশনের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীর সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যাকে সমালোচকেরা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ নামে আখ্যায়িত করেছেন। পরবর্তীকালে ইউরোপ এবং আমেরিকার সরকার প্রধানেরা অর্থনৈতিক গ্লোবালাইজেশন কার্যকর করার জন্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও) বানিয়েছেন এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশে নানা অজুহাতে সরকার পরিবর্তন করেছেন এমনকি যুদ্ধ পর্যন্ত লাগিয়েছেন। মূলধন যেহেতু ইউরোপ ও আমেরিকার বড় বড় ব্যাবসায়ীদের হাতে ছিল তাই বাণিজ্য সহজীকরণের সুবিধাগুলো সেই সব ধনীদের পকেটেই ঢুকেছে। এতে ইউরোপ ও আমেরিকার ধনী লোকেরা আরও বেশী ধনী হয়ে উঠলেও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সেসব দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষেরা। বাণিজ্য সহজীকরণের ফলে বাজার যেখানে এবং সস্তা শ্রম যেখানে পুঁজিপতিরা সেখানে গিয়ে কারখানা বানিয়েছে। ফলে স্বদেশী শ্রমিকদের কাজের পরিসর কমে গিয়েছে, শ্রমের আর্থিক মূল্য কমেছে, বহু শিল্প নগর ভুতুড়ে নগরে পরিণত হয়েছে, কাজের জন্য শ্রমিকদের এক রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে চলে যেতে হয়েছে। পুঁজিপতিদের ব্যবসায়ী স্বার্থে চিকিৎসা এবং শিক্ষাকেও বেসরকারীকরণের ফলে সাধারণ মানুষ এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বহুলাংশে। বেপরোয়া মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে আমেরিকার ধনীতম ১০% লোক দেশের ৭৬% সম্পদের মালিক। ৯০% এর অধিকারে আছে মাত্র ২৪%। ইউরোপের অবস্থাও ভিন্ন কিছু নয়। জাতীয় আয় ‘৬০ সালের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধির পরেও আমেরিকার সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় এখন ‘৬০ সালের তুলনায় কম। hillary-trump

ডোনাল্ড ট্রাম্প এইসব মানুষের দুঃখের কথা, দুঃখ থেকে পরিত্রাণের কথা বলে আসছেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারাভিযানে। তিনি আমারিকার সঙ্গে অন্যান্য দেশের বাণিজ্য চুক্তি বাতিলের কথা বলেছেন। একথা থেকে শ্রমজীবী মানুষেরা অধিক মজুরীতে কাজ পাবার আশা করছেন।  ট্রাম্প বেশী করে অবকাঠামো নির্মানের এবং সংরক্ষণের কথা বলেছেন; এতে শ্রমজীবী মানুষেরা অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ দেখতে পেয়েছেন। তিনি অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর কথা বলেছেন, মেক্সিকানদের এবং মুসলিমদের ঢুকতে দেবেন না বলেছেন তাতে সাদা শ্রমিকেরা কর্মক্ষত্রে প্রতিযোগিতা কমে যাবার প্রক্রিয়া দেখতে পাচ্ছেন। ট্রাম্প বয়স্ক, শিশু এবং শিক্ষার জন্য অধিক পরিমাণ খরচ বৃদ্ধির কথা বলেছেন। এতে নিম্ন আয়ের মানুষেরা নিজেদের নিশ্চিত বার্ধক্যকাল এবং সন্তানদের স্বাস্থ্য ও সুশিক্ষার নিশ্চয়তা পাচ্ছেন। পক্ষান্তরে এই সাদা, স্বল্প শিক্ষিত এবং শ্রমজীবী মানুষরা হিলারি ক্লিনটনকে ধুর্ত এবং যুদ্ধবাজ হিসেবে বিবেচনা করছে। হিলারির অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথাগুলো তাদের মনের গভীরে পৌঁছাচ্ছে না। ট্রাম্পের কথা বলার ধরন সরাসরি – সাধারণ মানুষ তাঁর কথায় আস্থা পাচ্ছেন।

ট্রাম্পের কথাগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগ সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য শুধুই কথার কথা যা বাস্তবায়ন করা কখনোই সম্ভব নয়। যেমন মেক্সিকোর খরচে মেক্সিকোর সঙ্গে আমেরিকার সীমান্তে দেয়াল তুলে দেওয়া, ন্যাটো সদস্যদের কাছ থেকে বাড়তি ফি আদায় করা, মুসলিমদের আমেরিকায় ঢুকতে না দেয়া ইত্যাদি। আরেকভাগে রয়েছে সত্যিকারের জনহিতৈষী এবং বাস্তবায়নযোগ্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা। সাদা, স্বল্প শিক্ষিত, শ্রমজীবী মানুষেরা এতে সত্যিকারের উপকৃত হতে পারবেন। তবে তাঁর জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে তা তিনি ধনী লোকেরদের এবং কোম্পানিগুলোর কর হার হ্রাস করার মাধ্যমে অর্জিত অতিরিক্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে যোগাড় করবেন বলে জানিয়েছেন। এখানেই শঙ্কা। অতীতে জর্জ ডব্লিউ বুশ আমলে দেখা গেছে অতিরিক্ত কর কর্তনের ফলে একদিকে ধনী লোকেদের পকেট ভারী হয়েছে, অন্যদিকে জাতীয় ঋণের বোঝা ভারী হয়েছে এবং শেষে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একেবারে ধ্বসে পড়েছে। ট্রাম্পের অর্থনৈতিক চিন্তার সঙ্গে একমত হতে পারছেন না সে দেশের জ্ঞানীগুণী লোকেরা। তাঁর সকল কথাবার্তাকে অর্থহীণ বলে বিবেচনা করছে আমেরিকার শিক্ষিত, সচেতন মানুষ।

এত বিপুল পরিমাণ ফাঁপাবুলি এবং চরম দুশ্চরিত্র নিয়ে একটা মানুষ এতবড় এবং শক্তিশালী একটা দেশের রাষ্ট্রপতি হতে পারেন না। জনমত জরিপ এবং নির্বাচনী বিশ্লেষণগুলোও তাই বলছে। ট্রাম্প জিতবেন না তবে মার্কিন রাজনীতির মূলে একটা বড়সড় ধাক্কা দিয়ে যাবেন। আগামী দিনগুলোতে নীতি নির্ধারকেরা এই ধাক্কাটা নিয়ে আলোচনা করবেন, পর্যালোচনা করেন, গবেষণা করবেন এবং তাঁর কথাবার্তার সারবস্তু নিয়ে সমাধানের ব্যবস্থা করবেন। তাহলে ট্রাম্প ঝড়ের কিছু সুফল আমেরিকার মানুষ কখনো না কখনো পেয়েও থাকতে পারেন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)