চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রিক্সা: চাকায়, ঢাকায়!

অনেক সিনেমা বা নাটকে শুনেছি… আপনার জন্য দুইটি খবর আছে। একটি ভাল, অন্যটি খারাপ। কোনটা আগে শুনবেন? তেমনিভাবে আজ দুটো ঘটনার কথা শুনাবো। একটি সাদামাটা, অন্যটি কষ্টের। সাদামাটা কাহিনীটা দিয়েই শুরু করি।

সোমবার সন্ধ্যা। রাজধানীর ইস্টার্ন প্লাজা থেকে বসুন্ধরা সিটির দিকে যাচ্ছি রিক্সায়। সাথে ছোট ভাই প্রিয়ন্ত। আমাদের হাসি-ঠাট্টার আলাপগুলো মনযোগ দিয়ে শুনছিল রিক্সাওয়ালা। তাতেই বোধ করি সাহস যুগিয়েছে মন খোলার। রিক্সা থেকে নামতেই তিনি জানালেন, কিছু বলতে চান। তবে শর্তও জুড়ে দিয়ে বললেন, রাগ করলে বলবে না। টাকা-পয়সা বা অন্য কোনো সাহায্যও চায় না সে।

এই কথাগুলোও তার বলা হয়ে গেছে মুহূর্তের মধ্যেই। আমি বললাম, কি এমন কথা? বলেই ফেলো তো।

সমস্যাটা যে বেশ বড় হবে সেটা ধরেই নিয়েই প্রশ্নটা করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা হলো, তা যেন পর্বতের মূষিক প্রসব!

সে জানালো, তার মোবাইল থেকে কল যায়, কিন্তু মোবাইলে কল আসে না। তার মহাবিপদ। হতাশার সর্বশেষ স্তরে অবস্থান করছেন আমাদের রিক্সাওয়ালা হাফিজ।

তার মোবাইল সেটটা হাতে নিয়ে দেখলাম, উল্টোপাল্টা চাপাচাপিতে কল ডাইভার্ট হয়ে গেছে।তিন-চার সেকেন্ডে তার তিন-চার দিন পুষে রাখা সমস্যার সমাধান করে দিয়ে অমূল্য এক হাসি উপহার পেলাম। সে হাসি থামছিলই না। বার বার শুধু একই প্রশ্ন, “কি করছুইন,মামা?”

এ খুশির অভিব্যক্তি ভাষায় বর্ণনা করা এক কথায় অসম্ভব। কত সহজে একজন মানুষকে খুশি করা যায় আমাদের দেশে!

এবার প্রসঙ্গ বদলাই। রিক্সার আলোচনায় মনে হলো, রিক্সা সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা? জানতে পারলে মন্দ হয় না, তাই না?

রিক্সা শব্দটা আমাদের জীবনের সাথে মিশে গেলেও পরের ধন বুকে নিয়ে আছি আমরা। শব্দটা জাপানি। বাহনটাও। তবে শুরুটা দু’চাকা দিয়ে। তখন টানতো মানুষ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে টানা রিক্সার দেখা মিলবে এখনও! আর এখন তো আমাদের দেশে ইঞ্জিন পর্যন্ত সংযুক্ত হয়েছে রিক্সায়।

এবার রিক্সার ইতিহাস। যতটুকু যানা যায়, জাপানি বাহন রিক্সা আবিষ্কার করেছেন একজন অ-জাপানি। স্কোবি নামের এক মার্কিন মিশনারি, ১৮৬৯ সালে, জাপানে বসেই। ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়ে মিয়ানমারেও। সেখান থেকে আসে চট্টগ্রামে। আর ঢাকায় রিক্সার প্রচলন হয় কলকাতা থেকে। যানা যায়, পালকির বিকল্প হিসেবে রিক্সার অনুপ্রবেশ।

এবার কাঁটাছেড়া করবো রিক্সা শব্দটিকে। জাপানি জিনরিকিশা শব্দ থেকে আজকের রিক্সা এসেছে। জিন=মানুষ, রিকি=শক্তি, শা= বাহন। মনুষ্যের শক্তিতে যে বাহন চলে তাই জিনরিকিশা। যেহেতু বর্তমানের রিক্সা প্যাডেলে চালায় মানুষ, তাই জিন অংশটুক ঝড়ে গিয়ে রয়ে গেল আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী “রিক্সা”।

এবার পরের ঘটনায় যাই। সন্ধ্যার হাফিজের গল্পটা থেকে কয়েক ঘণ্টার ফ্ল্যাশব্যাক। ভর দুপুর। আমি আর আমার অগ্রজ পারভেজ স্যার সচিবালয় থেকে রিক্সা নিলাম। হঠাৎ রিক্সা থামিয়ে দিল রিক্সাওয়ালা। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বিচলিত হয়ে ফোনে কথা বলতে লাগলো। পরভেজ স্যার বললেন, “নিশ্চয়ই কোনো খারাপ খবর!”

সত্যিই তাই। রিক্সা চালানো শুরু করেই গামছা দিয়ে চোখ মুছতে লাগলো সে। দু-তিনবার জিজ্ঞেস করার পরে জবাব এলো, ‘আমার আব্বা মারা গ্যাছে। আম্মায় জানাইলো। গ্রীনরোডের হাসপাতালে ভর্তি আসিল।’

খবর শুনেও আমাদের নামতে বলেনি মানুষটা। রিক্সা চালাতে শুরু করেছিল চোখ মুছেই। তবে, খবরটা আমাদের কানে পৌঁছামাত্রই আর বসে থাকতে পারলাম না। রিক্সা থেকে নেমে সাধ্যমতো আর্থিক সহযোগিতা আর ভরসা দিয়ে কঠিনতম দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দিলাম আমাদের রিক্সাওয়ালাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় নামটা জানা হয়নি ওর।

শুধু জেনেছি একজন মেহনতি মানুষকে, যে পিতৃ বিয়োগের খবর পাওয়ার পরেও গামছায় চোখ মুছে দায়িত্ব পালন থেকে সরেনি।

আজ সকালেও কানে বাজছে ওর একটিই কথা, ‘তুই কান্দিস না মা। আমি আইতাসি।’

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)