ওদের সত্যি নাম আমার জানা নেই। অথবা ওদের মা-বাবার রাখা নামটি, যাকে সমাজ সত্যি নাম হিসেবে ধরে নিয়েছিল, সেটাও আসলে ওদের সত্যি পরিচয় কিনা কে জানে!
আমাকে বলেছিল ওর নাম ‘পিয়া’। ওর সাথে যে দুজন ছিল তাদের একজনের নাম জয়া অন্যজনের নাম কল্পনা।
ওরা তিনজনেই শাড়ি পরা ছিল। খোপায় ফুল ছিল প্লাস্টিকের। ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে টানা কাজল, হাতে কাচের একরাশ চুড়িসহ আরো নানা প্রসাধনী।
ওদেরকে এ সমাজ ‘হিজড়া’ বলে ডাকে। মহাভারতের ইতিহাসে উর্বশীর অভিশাপে অর্জুন নপুংসক রূপ ধারন করার সময় বৃহন্নলা নাম নেয়। সেই থেকে নানান সাহিত্যিকসহ অনেকেই হিজরাদের বৃহন্নলা বলে থাকে। এই নামটি আমারো প্রিয়। আমি ওদের বৃহন্নলা বলে ডাকি।
প্রথমবার এই বৃহন্নলাদের সাথে আমার পরিচয়ের কারনটা একটু বেদনার। গত দু বছর আগে আমার এক ছোট ভাইকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় রাজধানীর তেজগাঁ এলাকায়। খুনিরা হত্যা করে পালানোর সময় সেখানে উপস্থিত কিছু বৃহন্নলা খুনিদের আটকে ফেলে।
এ বছরের শুরুর দিকে আমার ভাইয়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটা তাই আমি ওদের সাথে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেই।
প্রথমবার বিজয় সরণি মোড়েই ওদের খুঁজে পাই। সিগন্যালে গাড়ি থামতেই ওরা ছুটে আসে ১০টা টাকার জন্য। আমি সেবার আমার সিদ্ধান্তের কথা জানাতেই ওরা কিছুটা অবাক হলেও হাসিমুখে রাজি হয়। সেই অনুযায়ী আমার ভাইয়ের মৃত্যু বার্ষিকীর দিনটার দুপুরে আমি ওদের সাথে একসাথে খাই, সময় কাটাই।
সেদিন ওরা প্রত্যেকে খাবার খেয়েছিল চোখের জলে। সে জল আনন্দের ছিল। জয়া আমাকে বলেছিল, ‘পরিবারের বাইরে এই প্রথম কোন সুস্থ মানুষ আমাদের সাথে বসে ভাত খাইলো’। কি আনন্দ সেদিন তাদের! খাবার শেষ হলে ওরা নিজ খরচে আমাকে কোমল পানীয় এনে খাওয়ালো নিজেদের পয়সায় এবং আমার ছেলেদের জন্য চিপস, চানাচুর কিনে দিলো।
সেই থেকেই আমি ওদের বুনু। আমাকে ওরা বুনু বলেই ডাকে। এরপর থেকে রোজ রোজ সিগন্যালে আমার গাড়ি দাড়ালেই ওরা আমার দিকে দৌড়ে আসে। আমিও এক অজানা টানে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামি। ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরি পিয়াকে, জয়াকে। তারা ডানে বামে তাকিয়ে শশা, বাদাম, চিপসওয়ালা খুঁজে আমাকে এক প্যাকেট কিনে দেয়ার জন্য।
আশেপাশের গাড়ির ভেতরের মানুষগুলো আজব দৃষ্টিতে আমাদের দেখতে থাকে। কারণ, তাদের কাছে এরা শুধু অর্থ, উপহার, অধিকার চাওয়ার মানুষ, দেয়ার মানুষ নয়।
মাস চারেক আগে আমি ওদের আগারগাঁওয়ের ভাড়া বাড়িতে গিয়েছিলাম দাওয়াত খেতে। ছোট্ট টিনের ঘরে ওরা আমার জন্য জমিদারি রান্নার আয়োজন করেছিল। আমি ভাত খাবার সময় তারা আমায় ঘিরে বসে। একটা প্লেটে খাবার মেখে আমি নিজে খাই, তাদের খাওয়াই।
তারা ভাত খায় আর ব্যাকুল হয়ে কাঁদে। ক্ষণে ক্ষণে আমায় জড়িয়ে ধরে। বাড়ি ফেরার সময় হলে একটা বাটিতে খাবার গুছিয়ে দেয় আমার সন্তানদের জন্য। আমার সন্তানেরা তাদের খালা ডাকে।
কখনো কখনো আমি নিজেও তাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদি। কেন, তা জানি না। শুধু জানি, যতক্ষণ আমি তাদের সাথে থাকি নিজেকে ভারি সুখি মানুষ মনে হয়।
সেবার আসার সময় ওরা আমাকে জানালো, দলনেতা/নেত্রি পরিবর্তন হবার কারনে আগামী মাসে এ বাড়ি ছেড়ে মিরপুর ১২ তে চলে যেতে হবে। সেখানে গিয়েই ফোন করে আমাকে ঠিকানা জানাবে। এরপর প্রায় তিন মাস পিয়া, জয়া, কল্পনার সাথে আমার আর কোন যোগাযোগ নেই।
গত সপ্তাহে হুট করেই জয়ার ফোন এলো। ফোনের ওপর প্রান্তে সে কাঁদছে!
আমি সে সময় দুপুরের খাবার শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছি। এতোদিন পর জয়ার ফোন আর কান্না কন্ঠে শুনে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। একদমে জানতে চাইলাম, কি হয়েছে? এতোদিন কোথায় ছিলে? এখন কোথায়? অন্যরা কোথায়?
উত্তরে বেশ খানিকক্ষন চুপ থেকে বলল, ‘মিরপুর ১২ তে যেয়ে টিকতে পারি নাই বুনু। ওখানকার স্থানীয় হিজরা যারা, তারা মেরে তাড়িয়ে দিল। বাড়িতে এসে পরছি। কিন্তু বাড়িতে কিভাবে থাকবো বুনু? পিয়াও বাড়িতে চলে আসছে। কল্পনা কই জানি না।
আমি জানতে চাইলাম বাড়িতে কি সমস্যা?
বলল, ‘বাড়িতে তো আগে থেকেই সবাই খারাপ ব্যবহার করে বুনু। মাও প্লেটে ভাত বারে না। কিন্তু সেইটার থেকেও বড় সমস্যা আছে। খারাপ ব্যবহার মেনে নিতে পারলেও, ওই সমস্যা মানতে পারছি না।’ জিজ্ঞেস করলাম কি সমস্যা?
যা বলল সে কথা আসলেই পেটের ক্ষুধার থেকেও অনেক বড়! এ যুদ্ধ অস্তিত্ব রক্ষার! এ প্রশ্ন নিজের পরিচয়ের।
ফোনের ওপর প্রান্তে জয়া কাঁদছে আর বলছে, ‘আমার মাথার লম্বা চুল কাইটা ছেলেদের মত করছি বুনু। শার্ট প্যান্ট পরি এখন। ছেলে সাইজা থাকতে হবে এই শর্তে বাপ মা বাড়িতে উঠতে দিছে। আমার খুব কষ্ট বুনু। এইভাবে আমি থাকতে পারবো না। আমারে একটা কাজ দাও বুনু। আমার পরিচয়ে আমি যেই কাজ পাবো সেইটা করে একবেলা খাবো। কিন্তু পরিচয় লুকায় আমি থাকতে পারব না।’
মুহুর্তে আমার চোখের সামনে প্রথমদিনের কাজল টানা, লম্বা চুলের জয়ার হাসিমুখটা ভেসে উঠল। আমি আর্তনাদ করে বললাম, ‘চুলগুলো কেটে ফেলতে হলো?’
তিন বছর আগে কুয়েত এয়ারলাইনে চাকরিরত অবস্থার একদিন আমার এক কলিগ অনুমতি ছাড়াই এক পিওনের চেয়ারে বসাতে আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। তিনি একজন এক্সিকিউটিভ র্যাঙ্কের মানুষ হয়ে সামান্য পিওনের চেয়ারে বসাকে কিছুতেই অপরাধ বলে মেনে নিচ্ছিল না। আমি বলেছিলাম, ‘ওই চেয়ার পিওনটি তার কাজের দক্ষতা, মেধার বলে পেয়েছে। সেটি তার নিজস্ব অর্জন। অন্যের মেধার কাছে সেটা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, এই চেয়ার তার অফিসিয়াল পরিচয় বহন করে। বিনা অনুমতিতে এখানে বসা অবশ্যই অপরাধ।’
আইনের চোখে অপরাধী ছাড়া প্রত্যেকের জন্ম এবং কর্ম দ্বারা অর্জিত পরিচয় তার জন্য সম্মানের।
জয়ার সমস্যা সেখানেই। জয়ার জন্মের পর তার পরিবার এ সমাজকে জানিয়েছে জয়া তাদের পুত্র সন্তান। ছোট থেকেই তাকে ছেলেদের পোশাক পরতে হয়েছে, ছেলেদের মত করে চুল কাটতে হয়েছে, চলাফেরা, কথা, আচরণে হতে হয়েছে পুরুষসুলভ।
যে বয়সে এসে তার এই মিথ্যা পরিচয় দৈহিক, মানসিক এবং আচরণগত কারনে আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছিলো না, সেই বয়সেই জয়ার পরিবার তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।
প্রথমত জয়া পুরুষ নয় হিজরা। তারওপর মানসিকভাবে তার ভেতর নারীর আচরণের আধিক্য বেশী। সে অবস্থায় তাকে সম্পুর্ণ পুরুষ সাজিয়ে রাখার অর্থ প্রতি মুহুর্তে তার আত্মপরিচয়কে হত্যা করা।
একজন মানুষকে তার নিজস্ব পরিচয়ে তার রাষ্ট্র বাঁচতে দিতে পারবে না? জয়া চোর নয়, ডাকাত নয়, রাজাকার নয়। আইনত সে এই রাষ্ট্রের একজন সম্মানিত নাগরিক। বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে সামাজিকভাবে তারা এখনো অচ্ছুত। পরিবার তাদের মেনে নেয় না। নেই কোন সম্মানের কাজ। স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফর্মে লিঙ্গের জায়গায় তৃতীয় লিঙ্গ লেখবার জায়গাও তো নেই।
আমিও তাদের কিছু দিতে পারিনি। দিতে না পারার কষ্ট না ভুলেই গেলাম। কিন্তু তার পরিচয়, তার বাতাসে ওরা চুল, টেনে দেয়া চোখের কাজল ছিনিয়ে নেয়ার অধিকার কে দিল আমাদের?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)