স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো প্রকল্পের ব্যাপারে তাঁর দৃঢ় অবস্থান ঘোষণা করেন, তখন সেই প্রকল্পের বিরুদ্ধে কিছু লেখা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ যুক্তি যাই থাক, অতি উৎসাহী লোকজন ওই লেখককে সহজেই ‘উন্নয়নবিরোধী’ বা ‘সরকারের প্রতিপক্ষ’ বলে গালি দিয়ে বিমল আনন্দ যেমন একদিকে উপভোগ করেন, তেমনি নিজেকে সরকারের পক্ষের লোক জাহির করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো না কোনো সুবিধা আদায়ের ধান্দা করেন।
এই লেখাটির মূল উদ্দেশ্য ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস। একজন তাঁর ওয়ালে লিখেছেন, ‘কে জিতবে, রামপাল না বামপাল?’
তীর্যক প্রশ্নটি বেশ যুক্তিসঙ্গত এ কারণে যে, আমরা মনে করতে পারি, পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য গত বছরের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ গ্রহণ করে দেশে ফেরেন, তার কয়েকদিন পর সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার প্রতিবাদ সমাবেশ ও র্যালিতে বেধড়ক লাঠিপেটা করে পুলিশ।
প্রধানমন্ত্রীকে চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার কারণ হিসেবে জাতিসংঘ তখন বলেছিল, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ইউএনইপির এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক কার্যালয়ের (আরওএপি) এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতিবেশগতভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সামগ্রিক পদক্ষেপের স্বীকৃতি হচ্ছে এই পুরস্কার।
সুতরাং পরিবেশ রক্ষার স্বীকৃতি হিসেবে যাঁকে চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তাঁর সরকার অন্তত পরিবেশবিধ্বংসী কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, দেশের মানুষ সেটিই আশা করে। গত ২৭ আগস্ট গণভবনে রামপাল বিদ্যুৎপ্রকল্প ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলনেও তিনি এই আশ্বাস দেন যে,জাতির জনকের কন্যা হিসেবে তিনি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না যা দেশের ক্ষতি করে। দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা তাঁর এই কথায় আশ্বস্ত হতেই চাই।
কিন্তু তিনি সংবাদ সম্মেলনে এই প্রশ্নও তুলেছেন যে, সুন্দরবন রক্ষার নামে যারা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, তারা পয়সা পায় কোথায়?…এমনকি ২৪ আগস্ট এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিএনপি চেয়ারপারসনের সংবাদ সম্মেলনের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গিত করেন, রামপাল ইসুতে ‘বামপন্থীদের’ আন্দোলনের খুঁটির জোর আসলে খালেদা জিয়া। এ সময় শেখ হাসিনা বামপন্থীদের নিয়ে কিছু তীর্যক মন্তব্যও করেন। কিন্তু এই আন্দোলনকে বামপন্থীদের আন্দোলন বলে অভিযুক্ত করায় দলমত নির্বিশেষে যে সাধারণ মানুষ এরসঙ্গে যুক্ত আছেন, তারা নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়ে তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ অবশ্য তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন,‘এই আন্দোলন জনগণের গায়ে গতরে গড়ে তোলা আন্দোলন। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) হয়তো ভুলে গেছেন ভাষা আন্দোলনে মানুষ পয়সা দিয়ে আনতে হয়নি, ৬০ দশকের আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধে মানুষ জীবন বাজি রেখে গেছে। পয়সা দিয়ে দালাল আসে যেমন রামপালের প্রকল্পের পক্ষে প্রচারকরা আছে। এটা খুবই হতাশাজনক যে, প্রধানমন্ত্রী তাদের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করেছেন। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে তরুণেরাই প্রধান শক্তি। তারা আজকের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে জমায়েত হয়েছে। তাদের প্রেরণা, প্রাণের টান বোঝার ক্ষমতা থাকলে সুন্দরবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার উদ্যোগ দেখা যেতো না।’
আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, শুধু রামপাল নয়; উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত জনগুরুত্বপূর্ণ যেকোনো ইস্যুতে মানুষ যখন কথা বলে বা আন্দোলন গড়ে তোলে, আগপাছ বিচার না করেই সেটিকে উন্নয়নবিরোধী বলে আখ্যা দেয়া হয়। রাজনৈতিক ইস্যু হলে যেমন বলা হয় যে এর পেছনে রয়েছে বিএনপি-জামাত, তেমনি উন্নয়ন বা পরিবেশ ইস্যু থাকলে বলা হয়, এর পেছনে রয়েছে বামপন্থীরা। ক্ষমতাসীনদের অনেকে অবশ্য জামাতের সঙ্গে মিল রেখে বামপন্থীদের আজকাল ‘বামাতী’ বলে থাকেন।
এই যখন অবস্থা, তখন ফেসবুকে যিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘রামপাল জিতবে না বামপাল’, তার জবাবও খুব সহজ। সেটি হলো, যেই জিতুক না কেন, হারবে আসলে হরিদাশ পাল।
হরিদাশ পাল এখানে সাধারণ নাগরিক অর্থে; যারা জামাতী বামাতী, বিএনপি, আওয়ামী লীগ- কোনো পরিচয় দিতেই আগ্রহী নয়। দেশের গরিষ্ঠ মানুষ এই হরিদাশ পাল, যারা রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে তার সুফল যেমন ভোগ করবে, তেমনি এই বিদ্যুৎপ্রকল্প যদি দেশের উপকূলের ভ্যানগার্ড সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করে, তারও মাশুল দেবে।
এই হরিদাশ পালদের পক্ষ থেকেই একটি প্রশ্ন বারবার করা হচ্ছিল যে,উন্নয়নের জন্য বিদ্যুতের কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু যেহেতু রামপালের ওই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপ্রকল্প নিয়ে বিতর্ক উঠেছে কেবল সুন্দরবনের কাছে হওয়ায়-সুতরাং এই প্রকল্পটিকে সুন্দরবন থেকে আরও অন্তত ৮ /১০ কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নেয়া যায় না কেন? কেন এই জায়গাটিতেই করতে হবে?
কেন সুন্দরবনের নদীতে বারবার তেলবাহী ট্যাংকার ও জাহাজ ডুবির পরও এই এলাকায় এমন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে যেখানে নিয়মিত কয়লাবোঝাই জাহাজ আসা যাওয়া করবে। কয়লাবোঝাইএকটি জাহাজও যদি সুন্দরবনের নদীতে ডুবে যায়, তার ফল কী হবে তা বুঝতে জামাতী বা বামাতী হওয়ার দরকার নেই; হরিদাশ পালরাও বোঝে।
কয়লা বহনের জন্য নৌপথে যে সহজ যোগাযোগের অজুহাত দেয়া হচ্ছে , সেই একই যুক্তিতে এই প্রকল্পটি কেন দক্ষিণাঞ্চেলের অন্য কোনো জেলার নদী তীরবর্তী এলাকায় করা যায় না? কেন রামপালের এই জায়গাতেই করতে হবে?…হরিদাশ পালদের এই সহজ প্রশ্নের জবাব সরকার কখনোই দেয়নি। বরং এই প্রশ্ন যারা তোলেন, তারাই উন্নয়নবিরোধী।
ভারতের এনটিপিসি কোম্পানি সেই দেশের ছত্তিশগড়ে একই প্রকল্প অর্থাৎ একটি ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিলেও সে দেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের গ্রিন প্যানেলের ইআইএ রিপোর্ট প্রকল্পটিকে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে প্রতিবেদন দেয়। ফলে ভারত সরকার প্রকল্পটি বাতিল করে। অথচ সেরকম একটি প্রকল্প বাংলাদেশের অন্যতম স্পর্শকাতর জায়গা বলে পরিচিত সুন্দরবনের কাছেই কেন করতে হবে এবং এই প্রকল্পটি কীভাবে বাংলাদেশে পরিবেশগত ছাড়পত্র পেল, হরিদাশ পালদের সেই প্রশ্নের উত্তরও নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)