রানা প্লাজা ধসের পর দেশের তৈরি পোশাক খাতে বিশেষ করে কারখানার মান দিক দিয়ে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন এই খাতে কর্মরত শ্রমিক, বিদেশী ক্রেতাদের জোট, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং উদ্যোক্তারা। তাদের মতে পোশাকখাতের কর্ম পরিবেশ, আইনি কাঠামো, অবকাঠামো ও নিরাপত্তাসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে।
চার বছর আগে ২০১৩ সালের এই দিনে (২৪ এপ্রিল) শুধু বাংলাদেশেরই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে ভবন ধসের এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। রাজধানীর অদূরে সাভারে ধসে পড়ে রানা প্লাজা নামের বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। যেখানে অধিকাংশ ফ্লোরে ছিল তৈরি পোশাক কারখানা।
ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সরকারি হিসাবে ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হন প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়েছেন অনেকে। তৈরি পোশাক শিল্পে এত বড় দুর্ঘটনার ৪ বছর এ খাতের বর্তমান অবস্থা কি তা জানতে সশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেছে চ্যানেল আই অনলাইন।
রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিক আবুল কালাম সেদিনের বিভীষিকাময় দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, সেসব আর মনে করতে চাই না। এখনও মাঝে মাঝে আঁতকে উঠি। তবে এক সময়ের অগোছালো ও অনিয়মের মধ্যে থাকা তৈরি পোশাক কারখানার অভূতপূর্ব মান উন্নয়নে খুশি।
বর্তমানে গাবতলীর অ্যারোমা ফ্যাশনে কাজ করা আবুল কালাম আরো বলেন, এখানে কারখানার মান, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কর্মপরিবেশ, নিয়মিত বেতন সব কিছুই ঠিক আছে। আগে মাসের ২০ তারিখের পর বেতন পেতাম। এখন ৬ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে পাচ্ছি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক লীগ সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, কারখানাগুলোতে অগ্নি নিরাপত্তা, কর্ম পরিবেশ, উন্নত বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবস্থা, দ্রুত বের হওয়াসহ সব কিছুতে শতভাগ উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু শ্রমিকদের অধিকার এখনও সুরক্ষিত হয়নি। এক্ষেত্রে আরো উদ্যোগ নেয়া দরকার।
তবে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে সমন্বয় করা গেলে অধিকার নিশ্চিত হবে। কোনো আন্দোলনের দরকার হবে না বলে মনে করেন তিনি।
শ্রমিকদের এসব কথার সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে উদ্যোক্তা ও সরকারের নেয়া উদ্যোগ বিশ্লেষণ করে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) সূত্রে জানা গেছে, ১ হাজার ৫৪৯ পোশাক কারখানা প্রাথমিক পরিদর্শন শেষে কারখানাগুলোর ঝুঁকিভেদে ছয়টি ক্যাটাগরি করেছে ডিআইএফ। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রেড ক্যাটাগরিতে ২৩ কারখানা, আম্বার ক্যাটাগরিতে ২১৮, ইয়েলো ক্যাটাগরিতে ৫৬২, গ্রিন ক্যাটাগরিতে ৪৪৯, অগ্নি ও বৈদ্যুতিক ক্যাটাগরিতে ২৮২ এবং ব্ল্যাক ক্যাটাগরিতে ১৫ কারখানা রয়েছে। এদের অধিকাশের ত্রুটি সংশোধন হয়েছে বলে অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়া ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্সের সদস্য কারখানা রয়েছে ২ হাজার ২০৬ টি। এগুলোর সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে যথাক্রমে ৭৭ ও ৭৫ শতাংশ। অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও ভবনের কাঠামোগত প্রাথমিক ত্রুটি সংশোধনের কাজ শেষ করেছে দুই জোটের ১৩৫ কারখানা।
সংস্কারকাজে সন্তোষজনক অগ্রগতি না থাকায় এখন পর্যন্ত ২০২ কারখানার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স।
অধিদপ্তরের তথ্যভান্ডার অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৪ হাজার ৭৬৫ পোশাক কারখানা আছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৭৫৬ কারখানা পরিদর্শন করেছে অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও ডিআইএফই। বাকি ১ হাজার ৯টি কারখানা কোনো ধরনের পরিদর্শনের আওতায় আসেনি। অবশ্য এগুলো বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য নয়।
কারখানার মান, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার বিষয় শতভাগ উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেন বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, রান প্লাজা ধসের পর বিদেশি ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও ন্যাশনাল অ্যাকশন প্লান-এই তিনটি পক্ষ এসবের উন্নয়নে কাজ করছে। তবে তাদের দাবি অনুযায়ী ৭০ শতাশ উন্নতি হলেও আসলে শতভাগই উন্নতি হয়েছে।
শ্রমিক অধিকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রানা প্লাজা ধসের সময় বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন ছিল ১৪৩টি। এই সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ৫৯১-তে। এতে সহজে অনুমেয় যে, শ্রমিক অধিকারে মালিক পক্ষ কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে।
শ্রমিকদের জন্য মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা, বীমা সুবিধা, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সব ধরনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব করতে গিয়ে প্রত্যেকটি কারখানায় ব্যয় হয়েছে গড়ে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা।
তবে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেও উৎপাদিত পণ্যের এক পয়সাও দাম বাড়ায়নি ক্রেতারা। উল্টো কমিয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর আইনি কাঠামো, অবকাঠামো ও নিরাপত্তাসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে।
অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সভুক্ত কারখানাগুলোর ৪৯ শতাংশের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তামান নিশ্চিত হয়েছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু ন্যাশনাল অ্যাকশান প্লানের অধীনে যে ৫১ শতাংশ কারখানা রয়েছে; সেগুলোর সংস্কার কাজ এখনও শুরুই হয়নি।
এছাড়া কোনো সংগঠনের সদস্য নয়, এরকম প্রায় এক হাজার কারখানা রয়েছে। এগুলোর খবরও কেউ জানে না। এই পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে পুরো সংস্কারকাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
তিনি বলেন, জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার (এনটিএপি) অধীনে থাকা কারখানাগুলো নিয়ে কিছু জটিলতা আছে। এগুলোর সংস্কারকাজে যে পরিমাণ আর্থিক সক্ষমতা দরকার, তা তাদের নাই। তাই সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া দরকার। কারণ আগামী এক বছর অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স থাকবে না। তখন এসব কারখানার সংস্কার চলমান থাকবে কি-না। থাকলেও কিভাবে তা পরিচালনা করা হবে-তা নিয়ে ভাবতে হবে।
তবে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা বাড়লেও তাদের কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে না। কিছু ক্ষেত্রে তারা বাধার সম্মখীন হচ্ছে বলে জানান তিনি।
জানা যায়, সংস্কারকাজ তদারক করার জন্য ডিআইএফই’র নেতৃত্বে সংশোধন সমন্বয় কমিটি (আরসিসি) গঠন করা হয়েছে। কমিটির অধীনে একাধিক প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হবে। তারা প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে কারিগরি সহায়তা দিবে।
এ বিষয়ে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ওই ধসের পর আইএলওসহ আন্তর্জাতিক সস্থাগুলোর সহায়তা যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তিন হাজার ৯শ কারখানা সরেজমিনে পরিদর্শন করে মাত্র ৪২টি পেয়েছি ঝুঁকিপূর্ণ। সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৩৯টি পেয়েছি মোটামুটি ঝুঁকিপূর্ণ, আর কয়েকশ পেয়েছি সামান্য ত্রুটিযুক্ত সেগুলো সংস্কার হয়েছে। কারখানা নিয়ে এখন আর দুশ্চিন্তার কিছু নাই।
শ্রমিকদের অধিকারে অনেক অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই ঘটনার ৮০ দিনের মধ্যেই ‘লেবার ল’ তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাদের কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও ন্যায্য অধিকারসহ সব কিছুরই উন্নতি হয়েছে।