রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির চার বছর পর কানাডার বেশকিছু পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আগের চেয়ে বেশি তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি কাজ এবং চেষ্টা প্রয়োজন বলে পরামর্শ দেয়া হয়েছে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায়।
কানাডার টরোন্টো-ভিত্তিক একটি শ্রম অধিকার সংগঠন ম্যাকিলা সলিডারিটি নেটওয়ার্কসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন মিলে পরিচালিত একটি গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে বৃহস্পতিবার। সেখানে বিশ্বের ৭২টি উল্লেখযোগ্য পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ওপর গবেষণা করে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে, রানা প্লাজার ভয়াবহ ঘটনার পর তারা নিজেদের সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সেই সংক্রান্ত যতটা সম্ভব তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে কাজ কতটা এগিয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৭২টির মধ্যে ১৭টি খুচরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গবেষণা দলটির সঙ্গে ‘স্বচ্ছ্বতার অঙ্গীকারনামা’য় সই করতে রাজি হয়েছে। এবং তাদের পণ্য যেসব কারখানায় তৈরি হয় সেগুলোর অবস্থা যথেষ্ট ভালো উল্লেখ করে মানের পাশাপাশি কারখানাগুলোর কর্মীর সংখ্যা এবং উৎপন্ন পণ্যের তালিকাসহ অন্যান্য তথ্যও দিতে রাজি হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
ওই ১৭টি ছাড়া আরও অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের তাদের আগের অবস্থানের তুলনায় অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। যদিও তারা অঙ্গীকারনামায় সই করতে রাজি হয়নি।
আন্তর্জাতিকভাবে গবেষণার জন্য তৈরি অঙ্গীকারনামাটির উদ্দেশ্যই হলো পর্যবেক্ষকদের কাজটা একটু সহজ করা। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা পোশাক কারখানার ভবন ধসে ১১শ’র বেশি কর্মীর মৃত্যু হয়।
কানাডার পোশাক কোম্পানিগুলোতে পাঠানোর উদ্দেশ্যে পোশাক রানা প্লাজায়ই তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু ঠিক কয়টি এবং কোন কোন কোম্পানি – সেই তথ্য ওই সময় পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানগুলো যে কানাডার, তা জানা যায় আরও পরে, যখন উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তুপ ঘাঁটতে গিয়ে কানাডীয় কয়েকটি পোশাক ব্র্যান্ডের লেবেল খুঁজে পান।
এই ভয়ানক ট্র্যাজেডির পর আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা মহল বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই এ ধরণের কারখানাগুলোতে সঠিক মান এবং কর্মপরিবেশ বজায় রাখা হচ্ছে কিনা তা মনিটর করতে এ ধরণের অঙ্গীকারনামার ব্যবস্থা করা হয়- যেন বড় বড় পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো কোথা থেকে কী উপায়ে পণ্য তৈরি করে আনছে এবং সেখানকার অবস্থা কী সে সম্পর্কে সম্ভাব্য সব ধরণের তথ্য প্রকাশ করে, যেন নামি ব্র্যান্ডের আড়ালে এত ভয়াবহ ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আর তৈরি না হয়।
‘তখন থেকেই একটি প্রবণতা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যেতে থাকে,’ বলেন ম্যাকিলা’র নীতিমালা বিশ্লেষক বব জেফকট। কানাডার টিভি চ্যানেল সিবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পোশাকশিল্প বর্তমানে স্বচ্ছ্বতার দিকে এগিয়ে চলেছে।
রানা প্লাজার ঘটনার সঙ্গে কানাডার পোশাকশিল্পের সংশ্লিষ্টতা থাকায় গবেষণাটিতে কানাডার ওপর অনেকটাই জোর দেয়া হয়েছে। পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চারটি প্রখ্যাত কানাডীয় পোশাক নির্মাতা কোম্পানিও ছিল: মাউন্টেইন ইকুইপমেন্ট কো-অপ (এমইসি), হাডসন’স বে কোম্পানি (এইচবিসি), লোব্ল’ এবং কানাডিয়ান টায়ার। উদাহরণ হিসেবে জেফকট জানান, এই চারটির মধ্যেই তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছ্বতার দিক থেকে যথেষ্ট ভিন্নতা দেখা গেছে।
জেফকট বলেন, এইচবিসি কিছু কারখানার ঠিকানা এবং কর্মীর সংখ্যা জানালেও সব জানায়নি। জো ফ্রেশ ব্র্যান্ডের মালিক লোব্ল’ আপাতত কারখানাগুলোর নাম এবং দেশের নাম বললেও সেগুলোর ঠিকানা প্রকাশ করেনি। ফলে পর্যবেক্ষক দলগুলোর জন্য নজরদারির বিষয়টি কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে সাপ্লাই চেইন বিষয়ক তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছ্বতার জন্য সর্বনিম্ন যে মানটি নির্ধারণ করা হয়েছে, এমইসি তার খুব কাছাকাছি রয়েছে বলে জানান বিশ্লেষক জেফকট।
তবে কানাডিয়ান টায়ার এখন পর্যন্ত কোনো ধরণের তথ্য-উপাত্ত প্রকাশে রাজি হয়নি। কোম্পানিটির দাবি, তারা নিজেরাই তাদের জন্য কর্মরত কারখানাগুলোর মান এবং সাপ্লাই চেইনেরসঠিক ব্যবস্থাপনা নিয়মিত নজরদারিতে রাখে, যেন কোনো ধরণের আইন বা অধিকার লঙ্ঘন না হয়।
কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয় বলে দাবি শ্রম অধিকার বিষয়ক সংস্থাগুলোর। ইউনাইটেড স্টিলওয়ার্কার্স-এর কানাডীয় পরিচালক কেন নিউম্যান বলেন, ‘আমরা জানি, কানাডিয়ান টায়ারের স্পোর্টচেক এবং মার্ক’স ওয়ার্ক ওয়্যারহাউজ-এর মতো ব্র্যান্ডগুলোর জন্য শুধু বাংলাদেশেরই ৬৭টি ভিন্ন ভিন্ন কারখানা থেকে তৈরি পোশাক যায়। কিন্তু তারা জানাচ্ছে না এই কারখানাগুলোর নাম কী।’
‘এর অর্থ হলো, কারখানাগুলো আসলে নিরাপদ কিনা এবং সেগুলো শ্রমিকদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে, তা মানবাধিকার সংস্থাগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করে দেখতে পারছে না,’ বলেন তিনি।
নিউম্যান বলেন, কানাডার ক্রেতারা অবশ্যই চান যেন অন্তত কানাডার পোশাক বিক্রেতা কোম্পানিগুলো সংশ্লিষ্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে কর্মীদের জন্য ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে, যেন রানা প্লাজার মতো এমন ‘ফ্যাশন ট্র্যাজেডি’ আর কখনো ঘটতে না পারে।