বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়, অতিথিপরায়ণতায় বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মানুষদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির ঐতিহ্যও লোকমুখে প্রশংসার দাবি রাখে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে বিভিন্ন পেশা, শ্রেণির, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ সুদীর্ঘকাল থেকে ঐক্যের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভ। সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের মহারণে বাংলাদেশে বসবাসকৃত সকল মতের মানুষ নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলো, ব্যতিক্রম কিছু ছাড়া। এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ও অবদান রয়েছে। অন্যথায় বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অর্জনের মাহাত্ম্যগুলো অর্জিত হতো না। কাজেই ঐক্য, একতা, ফলপ্রসূ আলোচনা বাংলাদেশের মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সংলাপ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক দলগুলো উদ্ভূত যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলা ও সংকট নিরসনের জন্য সংলাপের আয়োজন করে থাকে। সংলাপের আয়োজনকে ঘিরে জনমনে প্রত্যাশা আর ইতিবাচক চিন্তা চেতনার আবেশ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবে সংলাপ মানেই ইতিবাচকতাকে বোঝানো হয়ে থাকে যেখানে উদ্ভূত সমস্যার যৌক্তিক ও বাস্তব সমাধান প্রত্যাশা করে থাকে জনগণ। আমাদের দেশেও রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য সংলাপের আয়োজন করে থাকে। তবে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের সফলতা কখনো আসেনি বিশেষ করে রাজনৈতিক সংলাপ থেকে। আমরা যদি ফ্ল্যাশবাকে চলে যাই তাহলে দেখতে পাই, ১৯৮৪ সালে এরশাদের শাসনামলে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জেনারেল এরশাদের সংলাপ হয়েছিলো এবং সে সংলাপ তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এরশাদের শাসনামলের পাতানো নির্বাচনে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন বর্তমানে ঐক্যফ্রন্টের নেতা আ স ম রব এবং তিনি এরশাদের পতনের সময় আত্মগোপনে ছিলেন এবং তিনিই এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের ফর্মুলা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে রাজনৈতিক দলগুলো বিএনপির কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সংলাপ আহ্বান করলেও সে সংলাপ খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। ২০০১ সালে জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি। ২০০৬ সালে প্রয়াত আব্দুল জলিল ও মান্নান ভূইয়ার দীর্ঘদিন ধরে চলা সংলাপের কোন সুরাহা হয়নি। ২০১৩ সালে তারানকোর মধ্যস্থতায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের সাথে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষতক কোন ফলপ্রসূ ফলাফল আসেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও সংলাপ সংক্রান্ত কোন সমাধান আসেনি বিশেষ করে রাজনৈতিক মাঠে। কাজেই, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংলাপ নিয়ে জনগণ সহ অন্যান্য দায়িত্বশীল প্রতিনিধিদের মাঝে হতাশার চিত্র পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংলাপগুলো কেন ব্যর্থ হয় তার কারণ হিসেবে বেশ কয়েকটি ইস্যুকে নিয়ে আলোচনা করা যায়।
প্রথমত: রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস ও পারস্পরিক সম্প্রীতির যে ঘাটতি ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে তার নিরসন না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় যেকোনো ধরনের আলোচনায় ফলপ্রসূ ফলাফল কখনোই আসবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিকভাবে অনেক ঘটনা প্রবাহের সুরাহা এখনো অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে। পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ব্যতিরেকে রাজনৈতিক সংলাপের ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর।
দ্বিতীয়ত: সংলাপের শুরু হওয়ার প্রাক্কালে সংলাপের ভবিষ্যৎ নিয়ে মুখরোচক আলোচনা অনেক সময়ই সংলাপের স্থিতাবস্থা নিয়ে জনমনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটায় এবং সংলাপও ফলপ্রসূ হয় না। ইতোমধ্যে ঐক্য প্রক্রিয়ার ঐক্য নিয়েই জনগণের মাঝে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ঐক্য প্রক্রিয়ার মুখপাত্র বাছাইকরণের ক্ষেত্রে বিভ্ন্নি সংবাদ মাধ্যমে যে সংবাদ উঠে এসেছে তা তাদের মধ্যকার বিভেদের চিত্র তুলে ধরেছে।
তৃতীয়ত: সংলাপ এবং ঐক্য প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট নেতাদের ব্যক্তিগত সুবিধা চরিতার্থ করার ইতিহাস আমরা দেখেছি। এ প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট দলছুট নেতাদের আমরা দেখেছি যারা নিজেদের সুবিধার প্রয়োজনে যেকোনো সময় দল পরিবর্তন করে থাকে। এ রকম নেতাদের সমন্বয়ে সংলাপে ফলপ্রসূ আলোচনা হওয়াটা দুষ্করই বটে। তারা রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ কষে দেখবেন কোন পক্ষ থেকে বেশি সুবিধা আদায় করা যায় এবং তার ভিত্তিতেই তাদের মতামত ও দল পরিবর্তনের সম্ভাবনা নির্ধারিত হয়ে থাকে।
চতুর্থত: ভূ-রাজনৈতিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্যজনিত কারণে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় চাপের জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপে আলোর মুখ দেখছে না।
পঞ্চমত: আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সামগ্রিক আর্থ সমাজের উন্নয়নের কারণে বৈশ্বিক রাজনৈতিক মেলবন্ধনের কারণে বিশ্বনেতাদের কাছে আমাদের নেতাদের মাঝে মধ্যে ধর্না দিতে দেখা যায়। আন্তর্জাতিক অপশক্তিগুলো বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমস্যা জিইয়ে রাখার ছলচাতুরী করে থাকে। তাদের ছলচাতুরীর চালনায় কতিপয় রাজনীতিবিদ আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে বলে সংবাদ মাধ্যম মারফত জানা যায়। এ সবই রাজনৈতিক সংলাপ ফলপ্রসূ না হওয়ার পিছনে মুখ্য কারণ হিসেবে কাজ করে থাকে।
আবার সংলাপের পূর্বে নিজেদের মধ্যে বৈরী পরিবেশের আলামত দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে গণভবন থেকে নৈশভোজের আহ্বান জানানো হলেও শেষ মুহূর্তে ঐক্যপ্রক্রিয়ার নেতারা নৈশভোজ না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এদিকে আওয়ামী লীগ থেকে পাঠানো চিঠিতে সংবিধানসম্মত উপায়ে সংলাপে আলোচনার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। অন্যদিকে ঐক্যপ্রক্রিয়ার নেতাদের ৭ দফা বাস্তবায়ন সংবিধান পরিপন্থী (সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে)। আবার বিএনপি নেতারা বলেছেন, খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। বিষয়গুলো ঐক্যপ্রক্রিয়ার সাথে আওয়ামী লীগের সংলাপের সফলতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে থাকে। তবে আপাতদৃষ্টিতে এবং পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, এ সংলাপের বাস্তবায়ন অর্থাৎ দুই পক্ষই সংলাপ থেকে গৃহীত সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবে এমন নজির হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
তবে যাই হোক, কাঙ্ক্ষিত সংলাপকে আমরা স্বাগত জানাই। সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবেন এ প্রত্যাশা সকলের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)