একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলার নেপথ্যে ছিলো পাকিস্তান। দেশের একাধিক রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদ, জঙ্গি সংগঠন এবং গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে পরিকল্পনা করে ওই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, গুরুত্বপূর্ণ নথি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং আসামিদের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের একাধিক রাজনৈতিক দল, জঙ্গি সংগঠন ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিলো।
শত শত পৃষ্ঠার দলিল বিশ্লেষণ করে গ্রেনেড হামলা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল চ্যানেল অাই অনলাইনকে বলেছেন: মূলতঃ এই হামলার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের পেছনে ছিলেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা, কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গি নেতা আর পাকিস্তান।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে ৭৫’র ১৫ আগস্ট সপরিবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা এবং লক্ষ্যের মিল পেয়েছেন।
এই মামলার মতো বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাতেও রাষ্ট্রপক্ষের অাইনজীবী হিসেবে চিফ প্রসিকিউটর সিরাজুল হকের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন: পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মতোই ২১ আগস্টের হামলার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করা হয়েছিলো।
‘ওই সময়ের (২০০৪ সালের) কিছু সামরিক কর্মকর্তা আর জঙ্গি নেতাদের নিয়ে হাওয়া ভবনে বসে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সবকিছু চূড়ান্ত করেন,’ বলে তিনি মন্তব্য করেন। প্রমাণ হিসেবে আসামিদের জবানবন্দি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং তদন্ত প্রতিবেদেনের কথা উল্লেখ করেন কাজল।
গ্রেনেড হামলা মামলায় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে আসামিরা বলেছেন, হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ওই সময়ের পরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) মহাপরিচালক আব্দুর রহিম, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা ফরিদ, মুফতি আব্দুল হান্নান, হুজির সাবেক আমির মাওলানা আবদুস সালাম এবং কাশ্মীরি জঙ্গি আব্দুল মাজেদ বাট।
একাধিক সাক্ষীকে উদ্ধৃত করে মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, হামলায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের পাকিস্তানে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিলো। ট্রেনিংয়ের পর তাদেরকে আর্জেস গ্রেনেডও সরবরাহ করে পাকিস্তান। আর হামলা শেষে পাকিস্তান তাদেরকে আশ্রয়ও দেয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং সেসময়ের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ নিহত হন ২৪ জন নেতাকর্মী।
গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা মামলায় ৪৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত ১৭৬ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
কাজল বলেন: সপরিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য এবং শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হাওয়া ভবন আর সাবেক মন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর বাসভবনে বসে ষড়যন্ত্র করা হয়। সেই ষড়যন্ত্র অনুয়ায়ী মুফতি হান্নানসহ আরও কয়েকজন দুষ্কৃতকারী এ নারকীয় হামলা চালায়।
রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী জানান, হামলায় যে আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে তা শুধু পাকিস্তানই উৎপাদন করে। বিশ্বের অন্য কোনো দেশ এই আর্জেস গ্রেনেড বানায় না। সুতরাং যে গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে তা নিশ্চিত পাকিস্তান থেকে এসেছে।
‘মামলায় আটক হওয়া কয়েকজন আসামির ঘন ঘন পাকিস্তানে আসা-যাওয়া আর সেখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করার প্রমাণ আমরা আদালতে উপস্থাপন করেছি,’ বলে কাজল জানান।
তিনি বলেন, হামলার পরপরই ঘটনাস্থলের পাশ থেকে সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি দ্রুত চলে যায়। এরপর কারাগারে পাওয়া যায় অব্যবহৃত তাজা গ্রেনেড। আর হামলায় যে ধরণের কৌশল ব্যবহার করা হয় সেটা একমাত্র সামরিক বাহিনীতে দেখা যায়। হামলাকারীদের দীর্ঘদিন ধরে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
মামলার পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা করে মোশাররফ হোসেন কাজল জানান, তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছিলো। এরপর ২০০৮ সালের ১১ জুন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি।
তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ৩ জুলাই অধিকতর তদন্তের পর তারেক রহমান, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আরো ৩০ জনকে আসামি করে মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ।
শেষ পর্যন্ত এ মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জন। এদের মধ্যে ২৫ জন গ্রেফতার হয়েছে।
কয়েকজনের সাক্ষ্য ও জবানবন্দি
জেনারেল রফিক: ওই সময় সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনস (এমও)- এর দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন। তিনি তার সাক্ষ্যে বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর অবিস্ফোরিত চারটি গ্রেনেড সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী।
জজ মিয়া: বহুল আলোচিত জজ মিয়া তার সাক্ষ্যে বলেছেন: ২০০৫ সালে প্রথমে আমাকে সেনবাগ থানায় ধরে নেওয়া হয়েছিলো। চোরাচালানের মামলা রয়েছে জানিয়ে থানায় নেওয়ার পর নোয়াখালীর পুলিশ সুপার আমার সঙ্গে কথা বলেন। মারধরের পর চোখ বেঁধে আমাকে ঢাকায় আনা হয়। এ সময় থানায় জীবন নাশের হুমকি দেওয়া হয়। এই বলে হুমকি দেওয়া হয় যে, ‘তুই বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিলি। যদি এটা স্বীকার না করিস, তাহলে অন্য মামলায় আসামি করে তোকে ক্রসফায়ারে দিয়ে দেব’।
জজ মিয়া বলেন: আমাকে বলা হয় যেভাবে বলি তোকে সেভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের কথা শুনলে তুই বেঁচে যাবি। তোকে রাজসাক্ষী রাখা হয়েছে।
মুফতি হান্নান: মামলার আসামী জঙ্গি নেতা হান্নান তার জবানন্দিতে বলেছেন, মাওলানা তাহের ও আরেক সহযোগীকে নিয়ে ২০০৪ সালের ১৮ ও ১৯ আগস্ট তৎকালীন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর বাসায় যান তিনি। সেখানে তাজউদ্দিনও ছিলেন। ওই বাড়িতে বসেই ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা হয়।
‘আলোচনার একপর্যায়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ওই বাসায় আসেন। কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে যান। পিন্টু তাদেরকে বলেন, হামলার জন্য গ্রেনেড ও টাকা তাজউদ্দিন সরবরাহ করবেন। এরপর আমি সেখান থেকে চলে আসি। পরে তাহের ও অন্য কারও মাধ্যমে টাকা ও গ্রেনেড আমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। তারপর আমার লোকজনকে দিয়ে হামলা করি,’ বলে স্বীকার করেছেন হুজি-বি নেতা হান্নান।
মিজানুর রহমান: মামলার সাক্ষী ডিজিএফআই-এর জঙ্গি দমন সংক্রান্ত ব্যুরোর সেসময়ের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মিজানুর রহমান আদালতে বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার (বর্তমানে বরখাস্ত ও পলাতক), তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও অন্য কারো সম্পৃক্ততার কথা গোপন করার জন্য মাওলানা তাজউদ্দিনকে ২০০৬ সালের অক্টোবরে সুকৌশলে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয় ডিজিএফআই।
মেজর জেনারেল (অব.) সাদিক হাসান রুমি: ডিজিএফআই-এর সাবেক প্রধান জেনারেল রুমি সাক্ষ্যে বলেছেন, গ্রেনেড হামলায় কারা কারা জড়িত তা জানার জন্য ডিজিএফআই-এর পক্ষ থেকে একটি অনুসন্ধান চালাতে চেয়েছিলাম। ঘটনার পরদিন দুপুরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এ জন্য অনুমতি চাইলে তিনি (খালেদা জিয়া) বলেন, এ বিষয়ে তদন্তের জন্য একটি কমিটি করে দেওয়া হবে। আপনাদের তদন্তের প্রয়োজন নেই।