বাংলাদেশের সকল শ্রেষ্ঠ অর্জনের অধিকাংশই রাজনীতিবিদদের হাত ধরে এসেছে। রাজনীতিবিদরা দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, তবে বিরাজনীতিকরণ, অপরাজনীতি, সন্ত্রাসবাদের বিস্তার, রাজনৈতিক অপরাধ ইত্যাদি কারণে অনেকেই এখন রাজনীতি সম্বন্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকেন। তবে রাজনীতির দূষিতকরণ বন্ধে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। আর রাজনীতির মাঠের প্রাণ হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মী।
যে কর্মীরা নেতার নির্দেশকে যেকোন মূল্যে মানতে বদ্ধপরিকর থাকেন। বর্তমান রাজনীতিতে তৃণমূলের রাজনীতির একাগ্রতা এবং নিষ্ঠার কথা বারংবার উঠে আসছে। দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং বৈদেশিকভাবে দেশের সামান্য/বিশদ ক্ষতি (বিভিন্ন ভাবে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে) সামনের সারির নেতারা করে থাকেন। তৃণমূল কখনো দল এবং নেতার সাথে বেঈমানি করে না। সেই তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সব থেকে বেশি গুরুত্ব পেতেন ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা অবলীলায় ফজিলাতুন নেছার সাথে দেখা করতে পারতেন। নেতাকর্মীদের পারিবারিক বিষয়, কারাগারে থাকলে মামলা পরিচালনা ইত্যাদি বিষয়ের সাথে ছেলেমেয়েদের বিয়ে এবং অন্যান্য কাজেও সহযোগিতা করতেন ফজিলাতুন নেছা।
ফজিলাতুন নেছা রাজনীতিকে স্বামীর মতো নিজের অস্থিমজ্জায় বপন করেছিলেন। তাইতো, তিনি সবাইকে আপন করে নেওয়ার দীক্ষা নিয়েছিলেন, ছোটকাল থেকেই তিনি নিজের মধ্যে মানবিক গুণগুলোর সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় থিতু হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে তিনি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আন্দোলন-সংগ্রামকে বেগবান করতে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। প্রতিটি কর্মীকে তিনি অত্যন্ত স্নেহভরে আদর করতেন, নিজের পরিবারের সদস্যদের মতো করেই ভাবতেন সকলকে। রাজনৈতিক কর্মীদের সমস্যাকে নিজের সমস্যা হিসেবে জানতেন।
তৃণমূলের কর্মী থেকে শুরু করে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থানরত সকলেই ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। ফজিলাতুন নেছাও তার প্রজ্ঞা ও সততার বিনিময়ে সকলের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি কর্মীদের বিভিন্ন ধরণের দিক-নির্দেশনা দিতেন। অনেক সময় এমন হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই নেতারা বঙ্গবন্ধুর সামনে উপস্থাপন করতে পারতেন না। সে জায়গাগুলোতে নেতাকর্মীরা ফজিলাতুন নেছার দ্বারস্থ হতেন এবং তিনি অত্যন্ত মমতার সহিত নেতাকর্মীদের অভিযোগ পরামর্শ শুনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।
তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ যেকোন সময় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে উপস্থিত হতে পারতেন কোন রকম শংকা বা দ্বিধা ছাড়াই এবং এ পরিবেশ অবশ্যই ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে ছিল। রাজনৈতিক কর্মীদের প্রিয় আড্ডাস্থল হয়ে উঠেছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর। শেখ মুজিব কারান্তরীণ থাকাকালীনও রাজনীতির পরিবেশটা সকলের জন্য মসৃণ করে তুলেছিলেন বেগম মুজিব।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সংগঠনের পেছনে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের নিরলস প্রচেষ্টার অব্যাহত চালিকাশক্তির কথা আজ সর্বত্র শোনা যায়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রিয় ভাবীকে তাদের সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা-প্রত্যাশার কথা বলতে পারতেন। এমনও অনেক ঘটনা আছে যেখানে শেখ মুজিব কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বলার সাহস শক্তি পাচ্ছেন না। এ রকম মুহূর্তে নেতাকর্মীরা ফজিলাতুন নেছার সান্নিধ্যে চলে যেতেন এবং যৌক্তিকতা অনুযায়ী শেখ মুজিব তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতেন। কর্মীবান্ধব ফজিলাতুন নেছা মুজিব প্রকৃত রাজনৈতিক নেতার স্ত্রী হিসেবে সকলের নিকট অনন্য মর্যাদা লাভ করেছিলেন।
কর্মীবান্ধব শেখ মুজিবের ন্যায় ফজিলাতুন নেছাও রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি সহনশীল ও যত্নবান ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যমতে, তিনি মাদারীপুর বোনের বাড়ি যাচ্ছিলেন দুজন রাজনৈতিক সহকর্মী নিয়ে। শীতের রাত ছিল, চাদর না থাকায় কষ্টের অন্ত ছিল না তাদের। ফজিলাতুন নেছা তার নিজের গায়ের চাদর খুলে দিয়েছিলেন কর্মীদের সুরক্ষার জন্য। যোগ্য নেতার সহধর্মিণী হিসেবে ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন অনন্য, অতুলনীয় ও মহানুভব।
১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি নেওয়ার পক্ষে সবাই ছিলেন একজোট, কিন্তু শেখ মুজিব কিছুতেই প্যারোলে মুক্তি নিবেন না, এদিকে রেণুরও কড়া নির্দেশ (খাবারের ভেতর চিরকুট পাঠানো) কোনভাবেই প্যারোলে মুক্তি নেওয়া যাবে না, কারণ সারা বাংলার জনগণ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। যুব ও ছাত্রনেতারা প্যারোলে মুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিলে বসার আহ্বান জানান। এ রকম পরিস্থিতিতে জুলফিকার আলী ভুট্টোও বিষয়টির সুরাহার জন্য ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। কিন্তু ফজিলাতুন নেছা মুজিব ভুট্টোর সাথে দেখা করতে অপারগতা জানান এবং ঐ সময় তিনি পাশের বাড়ির বদরুন্নেসা আহমেদ এমপির বাসায় চলে গিয়েছিলেন। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, ফজিলাতুন নেছা মুজিব অসাধারণ মনোবলের অধিকারী ছিলেন, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে কৌশলী ও বুদ্ধিমতীও ছিলেন বটে।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ফজিলাতুন নেছা মুজিব পারিবারিক দায়দায়িত্ব সামলানোর পরে রাজনৈতিক কর্তব্য পালন করতেন আপন মহিমায়, প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকায়। কর্মীরা পেতেন মায়ের স্নেহ, বোনের মমতা ও রাজনৈতিক দীক্ষা। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব নিজ হাতে রান্না করে হুজুরের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন হাসপাতালে। ফলমূলসহ অন্যান্য পথ্যাদি নিয়ে যেতেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। সকল নেতৃবৃন্দের সাথে সখ্যতার যে শিকড় তিনি গড়ে তুলেছিলেন, তার সুফল বঙ্গবন্ধু রাজনীতির মাঠে পেয়েছিলেন।
একবার খোন্দকার মোশতাক আহমদ জেলে থাকাকালীন তার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন। অবস্থার ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে রেণু পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিলেন। যেকোন মূল্যে মোশতাকের স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তিনি উঠে পড়ে লেগেছিলেন। ফজিলাতুন নেছা মুজিব নিজ উদ্যোগে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে লন্ডনের আওয়ামী লীগ নেতাদের ধরে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এই হলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বর্তমান কালের রাজনীতিবিদদের জন্য পাথেয় স্বরূপ। অথচ, খোন্দকার মোশতাকই স্বাধীনতার চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত করে শেখ মুজিবকে হত্যার প্রধান ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের রাস্তা বন্ধ করে ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ জারি করে।
ফজিলাতুন নেছা মুজিব শুধু নিজের দলের নেতাকর্মীদের জন্য পৃষ্ঠপোষকতার ভূমিকা পালন করেননি। অন্যান্য মুক্তিকামী জনগণ ও অন্য দলের নেতাদের জন্য সীমাহীন ত্যাগ ও আতিথেয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন সবাইকে। অলি আহাদ রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর একজন কট্টর সমালোচক ছিলেন কিন্তু তার প্রতিও ফজিলাতুন নেছার অমায়িক ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। স্মৃতিপটে অলি আহাদ উল্লেখ করেন “ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁহার পত্নী প্রচুর খাদ্যদ্রব্যসহ আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন। তাঁহাদের সহৃদয়তায় আমি মুগ্ধ হইলাম। ইতিপূর্বে রাজশাহী কারাগারে থাকাকালেই শেখ সাহেব আমাকে ১৯৬২’র সংবিধান (আইউব সংবিধান)-এর কপি পাঠাইয়াছিলেন। মুজিব ভাই ও ভাবীর রাজনৈতিক মতবাদ ও কর্মধারার সহিত আমার প্রভূত গরমিল থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সময়ে আমার প্রতি তাঁহাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য আমাকে চিরকাল তাঁহাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। যাঁহারা রাজনৈতিক মত-বিরোধকে সামাজিক সম্পর্কোচ্ছেদের সোপান হিসাবে ব্যবহার করেন; এই ঘটনার উল্লেখে আশা করি তাঁহাদের চক্ষু উন্মিলিত হইবে, তাঁহারা অতঃপর ইহার অন্তর্নিহিত মূল্য ও তাৎপর্য অনুধাবনে সচেষ্ট হইবেন”।
চলবে…