ক্রিকেট মাঠে মাগুরার সন্তান সাকিব আল হাসানের এমন কিছু গৌরবময় রেকর্ড রয়েছে যা এর আগে বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারই অর্জন করতে পারেনি। ক্রিকেট দুনিয়ায় বোলিং-ব্যাটিং এ অসাধারণ পারফরমেন্সের কারণে আইসিসি র্যাংকিং এ বেশ কয়েকবার শীর্ষে অবস্থান করেন সাকিব। টেস্ট এবং ওয়ানডেতে সাকিবের অর্জন ঈর্ষণীয় বটে। ক্রিকেটে অলরাউন্ডার হিসেবে তাকে খাতায় রাখেন না এমন কে আছে। কিন্তু ক্রিকেট মাঠের এই তারকা রাজনীতির ময়দানে এসেই যেনো ‘গোল্ডেন ডাক’ মারলেন। একেবারে শূন্য রানে ফিরে গেলেন প্যাভিলয়নে। দর্শকরা ভালোমন্দ কিছুই বুঝতে পারলেন না।
সাকিব রাজনীতির মাঠে আসবেন এমন গুজব আগে থেকেই ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় এবারের একাদশ জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হলে ক্রিকেটের দুই অন্যতম তারকা মাশরাফি এবং সাকিবও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করবেন-এমন এক নতুন আমেজ তৈরি করে। কিন্তু সাকিব আল হাসান চব্বিশ ঘণ্টা না যেতেই নিজের ভোল পাল্টে ফেলেন। নিজেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন বলে ঘোষণা দিয়ে ফের বলেন তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না।
১০ নভেম্বর মাশরাফি আর সাকিবের আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ক্রয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ে। সকাল থেকেই খবর আসতে থাকে তারকা ক্রিকেটার ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ খ্যাত মাশরাফিই শুধু নন, মাগুরার সাকিব আল হাসানও আওয়ামী লীগ থেকে দরীয় মনোনয়ন ফরম কিনবেন। সাকিব আল হাসান মাগুরা-১ আসন থেকে নির্বাচন করবেন। সাকিব নিজেও দৈনিক প্রথম আলোসহ আরও কিছু দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন মিডিয়ার রিপোর্টারদের কাছে নিজেই ফোন করে বিষয়টি নিশ্চিতও করেন।
সারাদিন তাই টেলিভিশন আর অনলাইনে মাশরাফি আর সাকিবের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সংবাদ বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রচার হতে থাকে। কিন্তু রাতেই সাকিব জানিয়ে দেন তিনি মনোনয়নপত্র ক্রয় করছেন না। নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হবেন না। এটুকু জানিয়েই তিনি চুপচাপ থাকেন। কিন্তু কেন ঘোষণা দিয়েও নির্বাচন থেকে তিনি সরে দাঁড়ালেন সে প্রশ্নে নিরুত্তর থাকেন। অনেক সাংবাদিকই তাকে প্রশ্ন করেন। কিন্তু সাকিব সব এড়িয়ে যান। এখন পর্যন্ত সাকিব এই প্রশ্নে নিরুত্তর, আর কোনো কথা বলেননি। তবে মাশরাফি নির্বাচন করছেন এটি নিশ্চিত। মনোনয়ন ফরম তোলার আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে তার কাছ থেকে দোয়া নেন। সাকিব কেন নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন? আবার কেনইবা ঘোষণা দিয়েও ত্বরিৎ সরে দাঁড়ালেন? সারাদেশের ক্রীড়ামোদীসহ মাগুরার সাধারণ ভোটার ও উৎসুক জনতা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। তবে অনেকেই মনে করছেন সাকিব যে কাজটি করেছেন সেটি খুবই অপরিপক্ক। প্রয়োজন ছিল না এমনটি করার। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সরাসরি গ্রিন সিগন্যাল না পেয়ে আগ বাড়িয়ে তার নির্বাচনের কথা বলা ঠিক হয়নি। জেনে শুনে, কনফার্ম হয়েই তার কথা বলা উচিত ছিল।
সাকিবের মনোনয়নপত্র কেনার ঘোষণায় অনেকেই তাৎক্ষণিক ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করছিলেন। বিশেষ করে যারা দলনিরপেক্ষ এবং ক্রিকেটের ভক্ত তারা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন এভাবে যে ক্যারিয়ার এমন পর্যায়ে নির্বাচনের প্রতি তার আগ্রহ দেখানোটা সুবিবেচনা প্রসূত হয়নি। রাজনীতি এবং নির্বাচন করতে চাইলে তার জন্য সামনে অনেক সময় আছে। যেহেতু তিনি আরও টানা কয়েক বছর খেলতে পারবেন সেহেতু রাজনীতির মাঠে এসে নিজেকে বিতর্কে জড়ানো তার প্রয়োজন ছিল না। রাজনীতি করতে চাইলে খেলা থেকে অবসর নিয়েই তিনি করতে পারবেন।
তবে সাকিব মত বদলে ফেলায় সারাদেশের মতো স্বস্তি নেমে এসেছে মাগুরাতেও। মাগুরা-১ আসনে মনোনয়ন পাবার আশায় রয়েছেন অনেকেই। এরমধ্যে সবার আগে যিনি রয়েছেন তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সহকারি সচিব অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর। এছাড়াও রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল ( অব.) আব্দুল ওয়াহাব, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া কুতুবুল্লাহ কুটি, ড. শফিকুল ইসলাম, কাজী রফিকুল ইসলামসহ আরও অনেকে। উল্লিখিতদের মধ্যে অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর অনেকদিন ধরেই মাঠ পর্যায়ে নিরলসভাবে কাজ করছেন। প্রতিটি রাজনৈতিক, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদানসহ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে তিনি নিরন্তর ছুটে চলেছেন। আবার রাজনৈতিক মাঠের নিয়ন্ত্রণ অনেকদিন ধরেই তার দখলে।
তবে এটা সত্য মাশরাফি এবং সাকিবের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রথম ইঙ্গিতটা দিয়েছিলেন পরিকল্পনমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গত ৩০ মে একনেকের একটি সভায় তারকা ক্রিকেটার মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার সাথে বিশ্বের অন্যতম অলরাউন্ডার মাগুরার গর্ব সাকিব আল হাসানও রাজনীতিতে আসছেন বলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন। মন্ত্রীর এই ঘোষণার পর বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ সর্বত্র আলোচনার ঝড় ওঠে। অবশ্য সেসময় বিষয়টি নিয়ে সাকিব আল হাসান কোথাও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত থাকেন। ফলে বিষয়টি সেসময় এক অর্থে বেশ রহস্যময়ই রয়ে যায়।
সেসময় পরিকল্পনা মন্ত্রীর ঘোষণায় মাগুরাবাসী ক্ষুব্ধই হন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং সাধারণ জনগণ বিষয়টিকে অপরিপক্ক মন্তব্য বলে চিহ্নিত করেন। অনেকেই সমালোচনা করতে থাকেন যে, ক্রিকেট ময়দানের সাকিবকে রাজনীতির ময়দানে আনা হলে সেটা ক্ষমতাসীন দলের জন্য ভীষণরকম বুমেরাং হবে। ক্রিকেট জনপ্রিয়তা দিয়ে সাকিবকে মাপার বিন্দুমাত্র কোনো সুযোগ নেই। যারা তখন এমন মন্তব্য করেন তাদের বক্তব্য ছিল ক্রিকেট খেলে, বিজ্ঞাপনের মডেল হয়ে কোটি কোটি টাকা রোজগার করলেও সাকিব মাগুরাবাসীর সুখে-দুঃখে কখনই পাশে দাঁড়াননি। মাগুরার গরিব অসহায় দুঃস্থদের সাহায্য সহযোগিতা করেছেন এমন কোনো নজির স্থাপন করতে পারেননি। শুধু কর্পোরেট দৃষ্টিভঙ্গিতে সবজায়গাতে নিজের ক্যারিয়ারটাকেই কেবল প্রায়োরিটি দিয়েছেন। মানবিক বা সেবাধর্মী কোনো ধরনের কাজকর্মের সাথে সম্পৃক্ত না থাকা এবং আচারণগত সমস্যার কারণে মাগুরাবাসীর অপছন্দের তালিকাতেই তিনি থেকেছেন সবসময়।
তবে এটা সত্য সাকিব ভেতরে ভেতরে যে রাজনীতিতে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সেটা অনুমান করা যাচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে একাধিকবার দেখা করাটা এই অনুমানকে সত্যি করছিল। আবার গত বছরের সেপ্টেম্বরে রংপুর সিটি কর্পোরেশনে আওয়ামী লীগ থেকে মেয়র পদে মনোনয়ন প্রত্যাশী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ আশিকুর রহমানের ছেলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সাবেক সহ সম্পাদক রাশেক রহমানের জন্য দোয়া চাইতে সাকিবের রংপুরে যাওয়াটাকেও সবাই আমলে নিচ্ছিলেন। এরপর গত এপ্রিলে যখন ভারতে নিধাহাস ট্রফি খেলতে যান তখন গণভবনে দাওয়াত পান সাকিব আল হাসান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সপরিবারে দেখা করেন। তখন থেকেই এই প্রশ্ন আরো জোরালো হয়ে উঠছিল যে সাকিব কি দ্রুতই রাজনীতিতে আসছেন?
সেসময় ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআইএর সঙ্গে আলাপচারিতায়ও সাকিব বিষয়টি রহস্যময় করে রাখেন। পিটিআই-এর সাংবাদিক রাজনীতিতে আসা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কৌশলী উত্তর দিয়ে বলেন, রাজনীতি নিয়ে তিনি এখনই কিছু ভাবেননি, তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না। তাই কোনোকিছুই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এদিকে কয়েকমাস আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে সেসময় তরুণ ভক্তদের উদ্দেশ্যে সাকিব ফ্লোরিডা থেকে নিজের ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেই স্ট্যাটাসে অনেকেই সাকিবের রাজনীতিতে নামার ফের গন্ধ পান। এরপর সত্যি সত্যিই সাকিব রাজনীতিতে আসার আগ্রহ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের দলীয় নমিনেশন ফরম কেনার ঘোষণা দেন এবং ঘোষণা প্রত্যাহারও করেন।
সাকিবের পিছু হটা নিয়ে নানারকম কথাবাতা চলছে। কিন্তু সঠিক উত্তর মিলছে না কোথাও। তবে অনেকেই মনে করছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সাঁয় পাননি বলেই সাকিব আগেভাগেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। ভেতরে যাই ঘটুক সাকিব নিশ্চিত বুঝতে পেরেছেন রাজনীতির মাঠ, ২২ গজের ক্রিকেট পিচ নয়। রাজনীতির মাঠ আরও অনেক বড়। এখানে ফুটওয়ার্ক করতে হয় ক্রিকেটের চেয়েও শতগুন সতর্কতায়। ফুটওয়ার্ক ঠিক না হলে ‘গোল্ডেন ডাক’ মেরে প্যাভিলিয়নে ফিরতে হয়।
সাকিব সেটাই করেছেন। রাজনীতিতে নামার আগে দেশ ও জনগণের জন্য নিজের মানবিক দিক উন্মোচন করতে না পারলে আসলে পাশে কেউ থাকে না, কারো সমর্থন পাওয়া যায় না। সবশেষে বলবো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাকিবকে রাজনীতির ময়দানে না এনে। জননেত্রীর আবেগকে সাকিব বিনা শ্রমে কিনতে চেয়েছিলেন, সেটা হয়নি। সাকিবের উচিত রাজনীতিতে নামার আগে বা সংসদে বসার ইচ্ছে পোষণের আগে নিজেকে পুনর্মূল্যায়ন করা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)