চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’-এটা আসলে ভণ্ডামি!

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দল পাল্টানোর রীতিমতো হিড়িক লেগেছে। রাজনীতির ময়দানে এ নিয়ে এখন নানামুখী আলোচনা। নিজেদের সুবিধা মত দল পরিবর্তন করছেন নেতারা। লক্ষ্য নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া। রাজনীতির অতিথি পাখিরা রাজনৈতিক আদর্শের জন্য নয় বরং নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্যই দল ত্যাগ করে নতুন দলে যোগ দিচ্ছেন।

রাজনীতির ময়দানে যাকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে দেখা গেছে তিনি এখন পাল ভেড়াচ্ছেন ধানের শীষ তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। আবার ধান নিয়ে যিনি ব্যস্ত ছিলেন তিনি এখন এখন নৌকা নয়ত লাঙ্গলে ভিড়ছেন। যিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন তিনিও সরব হয়েছেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলবদলের উৎসবে মেতে উঠেছেন অনেক নেতা। ক্ষমতার লোভে অনেকে আদর্শ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে ভুলছেন না। আওয়ামী পরিবারের সন্তানরাও বিনা দ্বিধায় হাত মিলাচ্ছেন বিপরীতমুখী রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে।

যেমন-বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি। আর আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী যোগ দিয়েছেন গণফোরামে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা শামসের মবিন চৌধুরী এক সময়ে ছিলেন দলটির প্রাণ। রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে তিনি দল ছেড়ে বেশ কিছুদিন একান্ত নীরবেই ছিলেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে জোটের রাজনীতিতে হঠাৎ করেই সরব হন তিনি। ঘটা করেই যোগ দেন বিকল্পধারায়। পদ পান প্রেসিডিয়াম সদস্যের। আওয়ামী লীগের সঙ্গে একজোট হয়ে এখন তিনি নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করার অপেক্ষায় আছেন।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়নপত্র কিনে চমক দেখিয়েছেন। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। প্রথমে তাকে এরশাদের সামরিক উপদেষ্টা, পরে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের সদস্য বানানো হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরীক হয়ে নির্বাচন করছেন।
এক সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, মাহমুদুর রহমান মান্না ও কামাল হোসেন। তারা প্রত্যেকেই এখন নৌকা প্রতীকের পরিবর্তে ধানের শীষ নির্বাচন করার অপেক্ষায়। ছাত্রদলের প্রথম নির্বাচিত সভাপতি গোলাম সারোয়ার এখন বিকল্পধারায়। জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী নাজিম উদ্দিন আল আজাদও বিকল্পধারায় যোগ দিয়ে যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে নির্বাচনে লড়বেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া গণফোরামে যোগ দিয়েছে।

বিএনপিপন্থী ডাক্তারদের পেশাজীবী সংগঠন ড্যাবের সাবেক সভাপতি ডাঃ রফিকুল ইসলামও রাজনীতিতে চমক দিয়েছেন। হঠাৎ করেই বিএনপি থেকে তিনি যোগ দিয়েছেন বিকল্পধারায়। দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন না পাওয়ায় কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ফারুক আলম সরকার বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। গাইবান্ধা-৫ আসন থেকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন।

সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর-জামালগঞ্জ-ধর্মপাশা ও মধ্যনগর) আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী অধ্যাপক ডা. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বিকল্পধারায় যোগ দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ও বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার ওমর ফারুকও যোগ দিয়েছেন বিকল্প ধারায়। একই দলে যোগ দিয়েছেন কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আমছা আমিন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ২০০১ সালে কুড়িগ্রাম–২ আসন থেকে সংসদ নির্বাচন করে পরাজিত হন।

আমাদের দেশের রাজনীতিতে একটি কথা প্রচলিত আছে: রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই! নীতি-আদর্শ বাদ দিয়ে একে-ওকে দলে ভেড়াবেন, অনৈতিক জোট করবেন, নির্বাচনে জেতার জন্য চিহ্নিত অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলাবেন, আর বলবেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই-এর চেয়ে বড় ভণ্ডামি আসলে কিছু নেই।

আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা ডিগবাজি খান। আদর্শ বিসর্জন দেন। সুবিধাবাদ আর স্বার্থপরতার ষোলআনা উসুল করেন। আর আপ্তবাক্য আওড়ান: রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। প্রেম ও রাজনীতিতে সবই জায়েজ। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কেন কিছু থাকবে না? রাজনীতি কি অদেখা দৈত্যের কায়কারবার যে, এখানে শেষ কথা বলে কিছু থাকবে না? এক দলের মনোনয়ন না পেয়ে আরেক দলের ছাতার তলে আশ্রয় নেয়া, সেখানে এসে আবার বড় বড় বুলি কপচানো, এই ভণ্ডামির অবশ্যই শেষ থাকা উচিত। শেষ বলে রাজনীতিতে শেষ কথা না থাকলেও নীতি আদর্শের ক্ষেত্রে তো শেষ কথা বলে কিছু অবশ্যই কিছু অবশিষ্ট থাকতে হবে।
নীতি-আদর্শহীন দলবদল ও জোট গঠনের পর বলবেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই-এগুলো আসলে হিপোক্রেসি। নিজেদের অপরাধের মাত্রা লঘু করার জন্য বা নিজের বিবেককে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য প্রবোধ-বাক্য। সবাই আজ এই প্রতারণাটা বোঝে। হিপোক্র্যাট নিজেও বোঝে।

দল আমাকে মূল্যায়ন করছে না; বা, দল নীতি বিচ্যুত হচ্ছে বা দল আমাকে সাব-সাইড করে দিচ্ছে। প্রতিবাদে আমি দল ত্যাগ করতে পারি বা আমি আবার নতুন দল গঠন করতে পারি বা, আমি দলের সমালোচনা করে জনমত তৈরি করতে পারি অথবা, নিদেনপক্ষে আমি নিজ দর্শনের উপর বই লিখতে পারি।

কিন্তু যাই করি- আমি কিভাবে এতদিন যে দলের কঠোর সমালোচনা করেছি, যে দলের অস্তিত্ব নিয়েই আমার সন্দেহ ছিল, যে দলের গঠনতন্ত্রেই আমার বিশ্বাস নেই, যে দলের প্রতীক এতদিন আমি পা দিয়ে মাড়িয়ে গেছি- ফুলের তোড়া নিয়ে, সে দলের প্রতীক মাথায় করে আজ কীভাবে সে দলের নেতা বনে যাই?

আমি দলের নতুন নেতা- দলে যোগদান করাতে কি এই দলের গঠনতন্ত্রে কোনো পরিবর্তন হয়েছে? আমি যোগদান করাতে তাদের নীতি-দর্শন-অবস্থান পরিববর্তন হয়েছে? যে নীতিবিচ্যুতির কারণে আমি পুরাতন দল ত্যাগ করলাম, সেই নীতি কি আপনি এখানে লালন করতে পারবেন? এ অবস্থায় আপনাকে আমরা একটি ফুটবল বা ক্রিকেট দলের খেলোয়ারের চেয়ে অধিক কিছু কীভাবে মনে করব?

দেশ পরিচালনা করে রাজনীতিবিদরা। আর আমরা যে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, সেটা সম্ভব হয়েছে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের কারণে। আমাদের যে টুকু অর্জন, উন্নতি এসব আমরা পেয়েছি রাজনীতিবিদদের হাত দিয়ে। বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে সততা ও আদর্শভিত্তিক রাজনীতির হাত ধরে। কিন্তু গত তিন দশকে বাংলাদেশের রাজনীতি তার পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থা থেকে সরে এসে বাণিজ্যনির্ভর হয়ে পড়েছে। সকল পর্যায়ে সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানি নেতাদের দাপট ও খবরদারিতে সামাজিক-রাষ্ট্রীয় শ্লীল-সুন্দর ব্যবস্থায় অশ্লীলতা ভর করে দেশ সুদ্ধ জনগণের কাছে ঘৃণা ও বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজনৈতিক দলে নতুন মুখ আসবে, আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্য দল থেকেও নেতাকর্মীদের আগমন ঘটবে। কিন্তু কাউকে দলে ভেড়ানোর আগে আদর্শের দিকটি বিবেচনায় না নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভবিষ্যতের রাজনীতি। রাজনীতিতে ন্যূনতম একটি নৈতিক অবস্থান থাকা দরকার। কোনও পক্ষে যোগ দেওয়া বা না দেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার যে কোনও নাগরিকের আছে। কিন্তু অধিকার থাকলেই কোনও আচরণের শোভনতা বা নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হয় না।
অর্থের জোরে, শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের সাথে সম্পর্কের জোরে দলীয় মনোনয়ন পেলে এবং নির্বাচিত হলেও স্থানীয় রাজনীতিতে ও সাধারণ মানুষের জন্য এদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। এমপি হওয়ার জন্য, একটুখানি সুযোগ-সুবিধা আর ক্ষমতার জন্য এমন দলবদলের সমারোহ নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর। এর ফলে হয়তো সুবিধাবাদী নেতাদের ব্যবসার পরিধি বাড়াবে। শুল্কমুক্ত গাড়ি ও প্লট বাগিয়ে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু এতে সাধারণ মানুষের কি উপকার হবে? এই রাজনীতি গণমানুষের রাজনীতি না। এই রাজনীতি দ্বারা তৃণমূল মানুষের উন্নয়নের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই নির্বাচনের আগে যেভাবে শুধু মনোনয়ন না পাওয়া নিয়ে দল বদলের হিড়িক বাড়ছে তা আমাদের আশাবাদী করছে না। এই রাজনীতি অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। এই রাজনীতির একটা ‘শেষ কথা’ থাকা উচিত।

দলের সমর্থকদের উচিত এ ধরনের ভণ্ড সুবিধাবাদী নেতাদের বর্জন করা, তাদের ভোট না দেয়া। এইসব নতুন নেতা যখন দলের প্রতীক নিয়ে হারবে তখন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও ভবিষ্যতে এদের মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে অন্তত একবার চিন্তা করবে!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)