বিশ্ব জুড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচিতি মূলত একজন অসাধারণ কবি হিসেবে। এ কারণেই তাকে আমরা ডাকি ‘বিশ্বকবি’ বলে। তবে তিনি যে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তা কারও অজানা নয়। একদিকে তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী, অন্যদিকে ছিলেন প্রতিভাধর এক ঔপন্যাসিক।
মেধা ও প্রতিভার গুণে গানের ভিন্ন একটি ধারাই সৃষ্টি করেছেন তিনি, যা বিশ্বব্যাপী পরিচিত রবীন্দ্র সঙ্গীত নামে। এছাড়াও তিনি একাধারে ছিলেন একজন দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, চিত্রশিল্পী। তিনি এমনই একজন জাতীয়তাবাদী ছিলেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতিমালার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যিনি নাইট উপাধির মতো অসামান্য সম্মাননা প্রত্যাখ্যান করতেও পিছপা হননি।
সেই বিস্ময়-প্রতিভার বিশ্বকবির ছিলেন বিশেষ দু’জন বন্ধু। তাদের একজন হলেন ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসের সেই বিখ্যাত মহাত্মা গান্ধি, আর অন্যজন বিশ্বখ্যাত জার্মান পদার্থবিদ অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। ১৫৪ তম জন্মবার্ষিকীতে চলুন জেনে নেই সেই বিখ্যাত ব্যক্তিদ্বয়ের সঙ্গে বাংলার এই বিখ্যাত কবির বন্ধুত্ব সম্পর্কে।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি, যাকে আমরা মহাত্মা গান্ধি নামেই জানি, তার ‘মহাত্মা’ উপাধিটা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই দেয়া। ১৯১৫ সালে এই উপাধিটি দেন তিনি। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, রবি বাবু গান্ধিকে ভীষণ শ্রদ্ধা করলেও তার কিছু কিছু চিন্তাধারার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেন।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, রবীন্দ্রনাথ সবসময়ই গান্ধির নেতৃত্বের প্রতি ব্যাপক শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। তবে বেশ কিছু বিষয়ের ভিত্তিতে তিনি বলতেন, গান্ধি স্বাভাবিক যৌক্তিকতা থেকে সরে যাচ্ছেন।
ভারতীয় নিউজপোর্টাল স্ক্রল.ইন সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিষয়টিতে আলোকপাত করে। ১৯৩৪ সালে নেপাল-বিহার ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর এর কারণ হিসেবে গান্ধি বিহারিদের মধ্যে নিচুবর্ণের লোকদের অস্পৃশ্য মনে করার ধারণাকে দায়ী করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হরিজন সম্প্রদায়ের সঙ্গে অচ্ছুত হিসেবে আচরণ করে বর্ণবাদের পাপ করার কারণেই স্রষ্টা শাস্তিস্বরূপ এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ পাঠিয়েছেন। পরবর্তীতেও এমন কথা আরও কয়েকবার বলেছিলেন মহাত্মা গান্ধি।
রবিঠাকুর নিজে অস্পৃশ্য-অচ্ছুত জাতীয় ধারণা আর বর্ণবাদ বিরোধী হলেও গান্ধির এসব দাবিগুলোকে অযৌক্তিক মনে করতেন। গান্ধির নিজস্ব জার্নাল হরিজন-এই এ বিষয়ে একটি চিঠি লেখেন তিনি। সেখানে তিনি যুক্তির মাধ্যমে গান্ধির দাবি খণ্ডন করেন। গান্ধির বক্তব্যকে তিনি সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, প্রাকৃতিক ঘটনার সঙ্গে নীতিবোধকে মেলানো একেবারেই ভুল।
সেই চিঠির উত্তরে গান্ধি লেখেন, তার মতে খরা, বন্যা, ভূমিকম্পের মতো ঘটনাগুলো যদিও শুধু পার্থিব বিষয় বলেই মনে করা হয়, এগুলো আসলে মানুষের নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
অন্যদিকে গান্ধি ছাড়াও আরেক বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল রবীন্দ্রনাথের। তিনি হলেন বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। ১৯৩০ থেকে ১৯৩১ – এই সময়ের মধ্যে রবিঠাকুর আইনস্টাইনের সঙ্গে চারবার দেখা করেন। তাদের মধ্যে আলোচনার বিষয় থাকত দু’জনের কাজকর্ম ও অবদান, সত্যের সাধনা এবং সঙ্গীতের প্রতি তীব্র অনুরাগ।
আইনস্টাইনের সঙ্গে প্রথমবার দেখা করার পর কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘তার (আইনস্টাইন) মধ্যে কোনো ধরণের কাঠিন্য ছিল না – ছিল না কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক দূরত্ব রাখার প্রবণতা। আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি এমন একজন মানুষ যিনি মানবিক সম্পর্ককে মূল্য দেন এবং তিনি আমার প্রতি প্রকৃত আগ্রহ ও বুঝদারি দেখিয়েছেন।’