১৯৭২ সালে আমি ‘মুকুল নিকেতন’ স্কুলে ভর্তি হই। আমাদের বাসার পাশেই স্কুল। শিশু শ্রেণিকে সবাই বলতো বেবি ক্লাস। সেই শৈশব থেকে চিনতে শুরু করি রতন দা’কে। তিনি আমাদের সকলেরই রতন দা, অধ্যক্ষ আমীর আহাম্মদ চৌধুরী।
ময়মনসিংহ জেলা মুকুল ফৌজ পরিচালিত বিদ্যালয় মুকুল নিকেতনে পড়ার সাথে সাথে খেলাধুলা, সামাজিক কার্যক্রম, সাংস্কৃতিক চর্চা সবকিছুতেই আমরা এগিয়ে যাই। একটা স্মৃতি খুব মনে পড়ে, তখনকার বিডিআর ক্যাম্পের (বর্তমান বিজিবি) বিশাল মাঠে কী যেন প্রোগ্রাম। সারামাঠ জুড়ে জোয়ানরা সারিবদ্ধ বসা, ডিসিপ্লিনড। আমি শিশুশিল্পী, মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাইকে গাইলাম, ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়’। নিঃশব্দে আমি আমার কণ্ঠই শুনছিলাম, মিষ্টি দরদী আওয়াজ। গান শেষে দৌড়ে স্টেজ থেকে নামতেও সুযোগ দেননি রতন দা, কোলে তুলে নিয়েছেন। এমনিতেই লাল চোখ! দেখি তিনি কাঁঁদছেন। পরে জেনেছি, তার খুব প্রিয় ছিল দেশপ্রেমের এই গানটি।
তার সাথে অসংখ্য স্মৃতি, দীর্ঘসময়। সম্ভবত ক্লাস ফোরে পড়ি তখন। পেছনের মাঠ আর সামনের মাঠ দু’ভাগে ভাগ ছিল মুকুল ফৌজ, মাঝে টিনের বড়ঘর। পিছনের মাঠে রতন দা বড়দের সাথে কী যেন কাজের কথা বলছেন, অপেক্ষায় কখন কথা বলতে পারি। মুকুল ফৌজের ডিসিপ্লিন আর কিছুটা মিলিটারি কায়দা-কানুন খুব প্রশংসিত ছিল। আমারও ভালো লাগতো। সুযোগ পেয়েই বলে ফেললাম, রতন দা, আমরা একটা নাটক করতে চাই বড়ঘরে, কাজী নজরুলের ‘লিচুচোর’। তিনি ভাঙ্গা গলায় হাসতে হাসতে বললেন, তা তুমি কোন চরিত্রে অভিনয় করবে? বললাম, আমি তো পরিচালক! অনুমতি জুটলো, সাথে দুই সিনিয়র মুকুলকে ট্যাগ করে দিলেন, বিষয়টি সুন্দর হওয়ার জন্য। নাটকের প্রধান অতিথি ছিলেন রতন দা, সেদিন নাটক দেখে খুব খুশি হলেন। খাওয়ার ব্যবস্থা করতে চাইলেন। তখন বললাম, আমার মা বাসায় সবার জন্য খিচুড়ি-লাবড়া রেঁধেছেন।
তার কিছু আগে বা পরেই মুকুল ফৌজের সেরা মঞ্চ নাটক ‘সিরাজউদ্দৌলা’ মঞ্চস্থ হয়। সে আরো বড় ইতিহাস। সিরাজউদ্দৌলার অভিনয় করে সাড়া জাগালেন, জুনায়েদ ভাই। সবই রতন দার নেতৃত্বে। কিছুদিন পর মুকুল ফৌজে এলেন, মোশারফ মাসুম। শিশুদের সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ। ছোটমাঠের বড়ইগাছ তলায় নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সমারোহ। এমনিতেই আনন্দময় শৈশব হয় না, পেছনে কোন মানুষের স্পর্শ থাকতে হয়। এবার আমাদের জন্য রতন দা নির্বাচন করলেন নাটক, ‘টোনাটুনি’। নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় মাসুম ভাই। সেই নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে আমরা বাংলাদেশ টেলিভিশনে যাই ১৯৭৮ সালে। মুকুল ফৌজের মুকুল হিসেবে আমরা গর্বিত। সবই রতন দার অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার ফল।
এরশাদ সাহেবের শাসনামলের কথা, আমরা চল্লিশজন মুকুল রতন দার সাথে অভিমান করেছিলাম। রতন দা আমাকেই সবার দলনেতা ভেবে ডাকলেন সেই পেছনের মাঠে। বললেন, দেখো, এরশাদ সাহেব আসবেন ময়মনসিংহে, আমরা সকল ব্যক্তিগত ভুল বোঝাবুঝি বাদ দিয়ে, এরশাদ সাহেবকে গান, বাজনায়, সংবর্ধনায় খুশি করতে পারলে স্কুলটার জন্য একটা বড় অনুদান, প্রায় ৩৫ লাখ টাকা বা ভবন পাবো। তিনি আরো বললেন, পেরু (প্রয়াত জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, আমাদের পিয়ারু ভাই) আমাকে বলেছে। রতন দা তার ভালোবাসার স্কুলের কথা ভেবে সেদিন বলেছিলেন, আমরা কেউ থাকবো না, এই স্কুলটা থাকবে, ভবনটা খুব জরুরি। আমি কনভিন্সড হলাম। অন্যদের বললাম, রতন দার কথাটা। সবাই রাজী হলো। স্কুলটাতো সবার। ১৯৮৫ সালে এরশাদ সাহেবের সংবর্ধনায় সবাই যুক্ত হলাম। রাজকীয় সংবর্ধনা হলো মুকুল নিকেতনে! আমরা আমাদের স্কুলের কথা ভেবে, স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা রতন দার কথা রেখেছিলাম।
রতন দার সাথে পরবর্তীতে নারী নির্যাতন ও সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলা নববর্ষ উদযাপন পরিষদ, কাদের সিদ্দিকীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কমিটি, ৮৮ তে বন্যার্তদের জন্য আশ্রয় ক্যাম্প, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের কাজে একসাথে ময়মনসিংহের রাজপথে ছিলাম দীর্ঘসময়! একজন ডেডিকেটেড ও দক্ষ সংগঠক। নিখুঁত তার কাজ। যার নেতৃত্বে কাজ করে স্বস্তি পাওয়া যায়।
১৯৯৫ এর পর চাকরিসূত্রে ময়মনসিংহ ছাড়ি, তারপর উনার সাথে সরাসরি কাজের সুযোগ হয়নি। ১৯৭২ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত বাবা-মার পর যার থেকে সবচেয়ে বেশি শিখেছি, দেখেছি দিন-দুনিয়া তিনিই আমাদের রতন দা।
উনার মৃত্যুর পর একটি বিষয় আমাকে ভাবাচ্ছে। উনার কি ‘দ্বৈতসত্তা’ ছিল? হতেই পারে, মনোবিশ্লেষকরা বলতে পারবেন ভালো। তবে, আমার রতন দা আজীবন আমার ‘শিক্ষক’ হয়েই বেঁচে থাকবেন। তার হাসিটা আমি ভুলতে পারছি না। স্নেহটা টের পাচ্ছি!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)