আমার সন্তানের কাছাকাছি বয়স তোমার শচীন। তোমার নামটি আরো বড়। ‘তেন্ডুলকার’শব্দটি আয়ত্তে আনতে কষ্ট হয়েছিলো বেশ শুরুতে। কিন্তু কিশোর একটি বোম্বেটে ছেলে এমন বিশ্ব অবাক ব্যাট চালিয়ে প্রতিভার ঝলকে চমকে দেবে, ভাবতেও পারিনি। তোমাকে ‘বাবা’ বলছি সুদীর্ঘ আদরে।
ক্রিকেট মাঠ থেকে যেদিন তুমি বিদায় নিলে, কী অনবদ্য বিদায়গাথায় হৃদয় ভিজিয়ে দিলে, ক্রীড়াবিশ্ব তোমাকে শুভাশিসে ভরিয়ে দিলো। আহা! এমন ছেলে হয়না। এতো বিশাল ক্রিকেট নক্ষত্র, অথচ কী অসাধারণ পরিমিত। মাঠে, ঘরে, বাইরে। ক্রিকেট ভুবনের আরেক নক্ষত্র ব্রায়ান লারা, জীবনাচরণে শিথিলতায় দাগ তার। অথচ শচীন তুমি নিষ্পাপ সুশীলতার এক আইকন। কতো যে অর্জন তোমার। তবু এতটুকু দাম্ভিকতার নেই ছাপ। এক অসাধারণ রুচিময় পরিবারের বিশ্ব প্রতিনিধি তুমি। শেষমেষ সেই রুচিঝলমল পটভূমি তুমি কুচি কুচি করে দিলে। কেন শচীন, কেন? কেন?
খুব আঘাত পেয়েছি শচীন। তোমার নয়নমনোহর কাভার ড্রাইভ, একের পর এক সেঞ্চুরি, রেকর্ডের পর রেকর্ড ভাঙা যে জাদুকরী ক্রিকেট অর্জন, তা তুমি নিমেষে এক বিবৃতিতেই বিকৃত করে দিলে! তোমাকে ভালোবাসার কোটি কোটি মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়ে নিমেষে ঘৃণার পাত্রে পরিণত করে দিলে! এমনটা কোনোদিন কোনোভাবেই ভাবতেই পারিনি।
অবশ্য এমন আঘাত পেয়েছিলাম গভীর অনুরক্ত ছিলাম যার, আমাদের যৌবনকে হিরন্ময় উপাদানে পুষ্ট করেছিলেন যে ভূপেন হাজারিকা, পৃথিবীর সব মানুষকে, পদ্মা মেঘনা যমুনাকে এক করে দেবার উদাত্ত আহ্বানের সেই শিল্পী যখন বিভাজনের উগ্র নৃশংসতার জমায়েতে যোগ দিলেন জীবনের শেষভাগে, সে আঘাতও কম লাগেনি।
‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’ খ্যাত জুলিয়াস ফুচিকের বইটি হাতে দিয়ে পড়তে বলেছিলেন যে রাজনৈতিক বড় ভাই, তাকেই একদিন দেখলাম ফাঁসিদাতা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীদের উত্তরাধিকারের সঙ্গে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। গভীর আঁধারের প্রতিনিধি। অথচ আলোকিত অগ্রণী দাবীদার।
ফিরে আসি ক্রিকেটেই। কাব্যিক মোচড়ে ব্যাটিংকে শিল্পোত্তীর্ণ করার ভারত ক্যাপ্টেন আজহার ওসব কেলেংকারী না করলেই কী হতো না! আর ক্রিকেট-ভালোবাসার মহান উৎস খেলোয়াড় দক্ষিণ আফ্রিকার হ্যান্সি ক্রনিয়ের অধঃপতন মেনে নিতে পারিনি আজো। কী ট্র্যাজিক পরিণতি অমন অসাধারণ ক্যাপ্টেনের।
ভারতের অভিনয় জগতের সুউচ্চ প্রতিভা নাসিরউদ্দিন শাহ। এক সময় নানাবিধ পুরস্কারে ধন্য ব্যক্তিটি বাণিজ্যিক ঢলে প্রবাহিত হয়ে বলেই ফেললেন, ওসব পুরস্কারের কাগজ ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি, ওসব সনদ ফনদ চাইনা, চাই শুধু নগদ নারায়ণ। অনুপম খেরের মতো বড় মাপের অভিনেতা আজ সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের উদগীরণ-ইঞ্জিন।
যে বাংলাদেশ থেকে লিখছি শচীন সেখানে এমনি অজস্র সুনীতি-বিসর্জনের নির্লজ্জ অধ্যায় দেখেছি। যাদের আত্মত্যাগ-পরিশ্রম-নিবেদন দেখে মুগ্ধ অনুসারী হয়েছি, এক জীবনের মূল সময়ে সম্ভাব্য ক্যারিয়ারকে হেলায় লুটিয়ে দিয়েছি, সেসব মহান ব্যক্তিবর্গকে যখন দেখি জীবনের পড়ন্ত বেলায় ব্যক্তি-মহিমা বিকীরণে অধীর-অস্থির হয়ে যেতে। সাফল্যের মাপকাঠি বদলে দিতে। নিবেদিত পরিমিতির বদলে অন্যপ্রকার মাখন খেতে পাগল হয়ে যেতে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম শুনেছো শচীন? তাঁর একটি গানের প্রথম চরণ : রং বদলায় রং বদলায়। তা শচীন জীবনের অভিজ্ঞতায় রংতো বদলাবেই। তবে একেবারে নীতি গুবলেট করে?
এসব কথা লিখতে খুব কষ্ট পাচ্ছি শচীন। তোমার দীর্ঘকালের একান্ত অনুরক্ত আমি, মনে হতো পৃথিবীর সব স্নেহ ঢেলে দিই তোমাকে। পাতানো খেলার লোভের ফাঁদে পা দাওনি তুমি। ভোগবাদী বেলেল্লা জীবনধারাকে প্রত্যাখ্যান করে চলেছো এতটাকাল। সেই তুমি?
ভারতীয় উপমহাদেশে আমরা সবাই একসাথে ছিলাম ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। তারপর ক্ষমতার বিভাজনের খেলায় কে দোষী, কে দায়ী সেসব জটিল প্রশ্ন এড়িয়ে বলতে চাই গোটা উপমহাদেশের সব দেশেই বড়- ছোট-মাঝারি পুঁজিওয়ালাদের কৌশলেএবং পুঁজিহীনদের মেহনতে চলছে জীবনগাড়ি। ভারতে পাঞ্জাবকে বলা হয় শস্যভান্ডার। সেখানকার গমে তৈরি পাউরুটি ভদ্রলোকদের ভাষায় ব্রেড। সেই ব্রেড নিশ্চয়ই সকালবেলায় তোমার ব্রেকফাস্ট মেনুতেও আছে। তা ভাত খাও, রুটি খাও, নান খাও, তাতে পাঞ্জাবী কৃষকদের পুঁজি ও মেহনত তোমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও জড়িয়ে আছে।
সেই শস্যপণ্য নিয়ে ভারতে এক বড় বিবাদ ঘটে গেছে। হঠাৎ ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতার’ মশলা দিয়ে তোমাদের শাসকবর্গ এমন বিল-তরকারি সংসদের একবেলাতেই বানিয়ে বললো, হে কৃষক এ তরকারিই তোমাদের একমাত্র খাদ্য। কারো সঙ্গে মতবিনিময় না করে এমন বিতর্কিত শস্যপণ্য-আইন জারি করতে চাইলো যাতে গোটা পাঞ্জাবের কৃষকসমাজ বিগড়ে গেলো। পৃথিবী এমন বিস্ময়কর কৃষকবিদ্রোহ কখনো দেখেনি।বড় ধনী-মাঝারি ধনী- মেহনতী কৃষক একজোটে এমন কঠিন পণ শান্তিপূর্ণ বিদ্রোহ ঘটালো যাতে চমকে গেল পৃথিবী। এমন কঠিন শীতে মহাসড়কের পাশে অবস্থান নিয়ে দিল্লীর উপকণ্ঠে দুই শতাধিক কৃষক প্রাণ দিল, তবু বিদ্রোহীরা এতটুকু টলে গেলোনা। শাসকরা কতো যে কৌশল করলো, তবু কাজ হলোনা আজো।
এমন সময় বিশ্ব ক্রিকেটের আদর সন্তান শচীন তুমি একবারও তোমার অন্নদাতাদের পাশে এতটুকু সান্ত্বনা দিতে গেলেনা, যাবেনা, ভাবতেও পারিনি।
পৃথিবীতে সব আন্দোলন সংগ্রামেই বাইরের সংহতি-সহায়তা থাকে। আমাদের বাংলাদেশ ভারত- সোভিয়েতের মিলিত সমর্থনে পৃথিবীতে নবমানচিত্র হিসাবে সৃজিত হয়েছে। গণচীনের বিপ্লব সহায়তা পেয়েছে সোভিয়েতের। আর ভিয়েতনাম? চীন সোভিয়েততো আছেই গোটা পৃথিবীর নৈতিক সমর্থন পেয়েছে। দুইশতাধিক কৃষকের প্রাণ কেড়ে নেওয়া বিদ্রোহে এই ক্ষুদ্র আমি সহ পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের সমর্থন রয়েছে। মিয়ানমারের সর্বপ্রকারের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক।
তা ভারতের কৃষক বিদ্রোহে পৃথিবীর কিছু সেলেব্রিটির একাত্মতা প্রকাশে তুমি সহ ভারতের কিছু সেলেব্রিটি হঠাৎ ‘সার্বভৌমত্ব’ লংঘনের গর্জন তুললে কেন?
অবশ্য প্রথমে তেমন বুঝিনি। পরে বুঝলাম ‘আ-আ’ ভয়াল বিশাল পুঁজি-ফ্যাক্টর। সংসদে হঠাৎ শস্যপণ্য বিল পাশ করানো হয়েছে ঐ ‘আ-আ’ গোষ্ঠীর জন্যই….. এটাই কৃষক বিদ্রোহীদের মূল অভিযোগ। খাদ্যব্যবসাটা চাই ‘আ-আ’দের। কৃষক উৎপাদন করবে, নেপোয় মারবে দৈ। ‘আ-আ’ খাবে লাভের আসল মাখন।
শচীন তোমাকে ক্রিকেট ভুবনে ভোগবাদী কোন বিচ্যূতিতে পিছলে পড়তে দেখিনি। শেষ পর্যন্ত ঐ ‘আ-আ’ আকর্ষণে পিছলে গেলে? ‘আ-আ’ মানে ‘আম্বানি-আদানি’ কর্পোরেট জুটি। যা বর্তমান ভারত সরকারের মূল খুঁটি। ওদের ইঙ্গিতে হেলে যান মহাবীর মোদিজী।
শচীন, তুমিও হেলে গেলে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এরম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)