ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে খুব কাছ থেকে গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকেরা, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল জাতীয় চার নেতার দেহ। তিন নেতার মৃত্যু নিশ্চিত হলেও, আরও ঘণ্টাখানেক বেঁচে ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ। ‘পানি, পানি’ বলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার মর্মভেদী অার্তনাদ শুনতে পেয়েছিল পাশের সেলে থাকা বন্দীরা। কিন্তু বর্বর ঘাতক মোসলেমউদ্দিন গ্যাং তাদের গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে চলে যাবার আগে সেলটিকে খুব শক্তভাবে তালাবদ্ধ করে রেখে যাওয়ায় মৃত্যুর আগে তাজউদ্দিন আহমেদের মুখে এক ফোঁটা পানিও কেউ তুলে দিতে পারেনি। অন্তিম পিপাসা নিয়েই ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সম্পর্কে সেসময় সামরিক বাহিনীতে কর্মরত কর্নেল শাফায়াত জামিল, জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, প্রয়াত কর্নেল এম এ হামিদ ও ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনসহ আরো অনেকের লেখা বইয়ে বর্ণনা উঠে এসেছে।
এছাড়া ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যার সময় আইজি প্রিজন নূরুজ্জামান, ডিআইজি প্রিজন কে. আবদুল আউয়াল, জেলার আমিনুর রহমান, সুবেদার আবদুল ওয়াহেদ মৃধা এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় সাক্ষাতকার দিয়েছেন৷ তারা চারজনই ছিলেন চার নেতা হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী৷ তাজউদ্দীনকন্যা সিমিন হোসেন রিমির বইয়ে এ সাক্ষাত্কারগুলো রয়েছে৷
হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক
এ চারজনের সাক্ষাতকার এবং সামরিক বাহিনীর অফিসারদের লেখা বই থেকে জানা যায়, ‘অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ ও কর্নেল রশীদ ২ নভেম্বর মধ্যরাতের পর বঙ্গভবন থেকে আইজি প্রিজনকে ফোন করে মোসলেমের নেতৃত্বে ৪ খুনিকে জেলে প্রবেশ করতে দিতে নির্দেশ দেন৷ অন্তত দুইবার খুনি মোশতাক আইজি প্রিজনকে বলেন, সশস্ত্র মোসলেমরা যা করতে চায়, তাই যেন করতে দেয়া হয়৷
ভোর তখন ৪টা পেরিয়েছে। ওই সময় বঙ্গভবনে একটি ফোন বেজে উঠলো। ফোনটি ধরেন বঙ্গবন্ধুর খুনি শাহরিয়ার রশিদ খান। রশিদের ভাষায়: টেলিফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে এক ভারী কণ্ঠে বলছে, ‘আমি ডিআইজি প্রিজন কথা বলছি, মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমি আলাপ করতে চাই।’
খন্দকার মোশতাককে টেলিফোনটি দেওয়া হলে তিনি কিছুক্ষণ ধরে কেবল হ্যাঁ, হ্যাঁ করতে থাকেন। তার কথা পরিষ্কার বুঝা না গেলেও যেকোন ব্যাপারেই হোক তিনি সম্মতি দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতির অনুমতি সাপেক্ষেই কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করে খুনিরা।
জেলের ভেতর যা ঘটেছিল
সশস্ত্র খুনিরা জেলে ঢুকেই বলে, তারা চার নেতাকে হত্যা করতে এসেছে৷ সেসময় আইজি আবারো বঙ্গভবনে ফোন করলে মোশতাক ও রশীদ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সম্মতি দেয়৷
ভোর তখন সাড়ে ৪ টা। তাজউদ্দিন আহমেদ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম কারাগারের একই সেলে ছিলেন। মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান ছিলেন পাশের সেলে। তাদেরকে এক করে তাজউদ্দিনের সেলে আনা হয়। খুব কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
চারজনকে গুলি করে খুনিরা বের হয়ে আসার কিছুক্ষণ পর আবার সেলে ফিরে যায়৷ দ্বিতীয়বার গিয়ে তারা বেয়নেট দিয়ে চার নেতার শরীরে আঘাত করে৷
জাতীয় চার নেতাকে একত্রে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করা হলে তিনজন সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাজউদ্দিন আহমেদের পায়ে ও পেটে গুলি লাগার কারণে তিনি গুলির পরও অনেক সময় বেঁচে ছিলেন। রক্তক্ষরণের ফলে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পরে মারা যান তিনি।
তাজউদ্দিনের মৃত্যুর আগের মুহুর্তের মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পাশের সেলে কারাবন্দিরা জানায়, গুলির পরও প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে একজনের (তাজউদ্দিনের) আর্তনাদ শুনছিলেন তারা। আর ‘পানি, পানি’ বলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাঁতরানোর মর্মভেদী শব্দ তাদের কানে আসছিল। কিন্তু বর্বর ঘাতক মোসলেউদ্দিন গ্যাং চলে যাবার আগে সেলটিকে খুব শক্তভাবে তালাবদ্ধ করে রেখে যাওয়ায় মৃত্যুর আগে তাজউদ্দিন আহমেদের মুখে এক ফোঁটা পানিও কেউ তুলে দিতে পারেনি। ওই পিপাসা নিয়েই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন তাজউদ্দিন আহমেদ।
জেলহত্যার বিচার
হত্যাকাণ্ডের পরদিন ৪ নভেম্বরে ডিআইজি প্রিজন কে. আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি মামলা করেন৷
দীর্ঘ ২১ বছর এ হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ থাকার পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জেলহত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করে। ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর মামলায় আসামি সৈয়দ ফারুক রহমানসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর মামলার রায়ে ৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে রায় দেন বিচারিক আদালত।
এরপর ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাই কোর্ট সেনাসদস্য মোসলেউদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিলের রায় দেন। রায়ে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য দুই আসামি মারফত আলী এবং আবুল হোসেন মৃধাকে খালাস দেওয়া হয়।এছড়া নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, একেএম মহিউদ্দিন আহাম্মদকেও খালাস দেওয়া হয়।
হত্যাকাণ্ডের সুদীর্ঘ ২৯ বছর পর এর বিচারের রায় হলেও জাতীয় চার নেতার পরিবারের সদস্যরা এ রায়কে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রহসনের রায়’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তারা অভিযোগ করেন, জেলহত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন (লিভ টু আপিল) করে।
২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চ হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন মঞ্জুর করে।
কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যামামলায় হাই কোর্টের রায়ে বাদ পড়লেও ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল আপিল বিভাগ দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন।