চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

যে জীবন কবিতার

কোনো এক জন্মদিনে কবি শামসুর রাহমানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম ‘কতদিন বাঁচতে ইচ্ছে করছে?’ লাবণ্যধরা হাসি ছড়িয়ে দিয়ে জবাব ফিরিয়ে ছিলেন, ‘লিখে দাও, পাঁচ হাজার বছর।’ কথাটার মানে তখন বুঝতে পারিনি। তিনি চলে যাওয়ার পর একটু একটু করে বুঝেছি এই আকাঙ্ক্ষা একজন কবির কবিতার জন্য, সুন্দরের জন্য। শামসুর রাহমান কবিতার জন্য জীবন যাপন করেছেন। বেঁচেছেন সুন্দরের জন্য এবং তিনি বেঁচে আছেন তার কবিতায় আর সৌন্দর্যে।

তিনি ছিলেন ইচ্ছে ডানায় ভরকরা এক রাজপুত্তুর। ‘ইচ্ছা’ কবিতায় তিনি লিখছেন-

‘যদি বাঁচি চার দশকের বেশি
লিখব।
যদি বাঁচি দুই দশকের কম
লিখব।
যদি বেঁচে যাই একটি দশক 
লিখব।
যদি বেঁচে যাই দু’চার বছর
লিখব।
যদি বেঁচে যাই এক মাস কাল
লিখব।
যদি বেঁচে যাই একদিন আরও
লিখব।’

সত্যি তিনি লিখেছেন। যতক্ষণ বেঁচে ছিলেন কবিতার সঙ্গে ছিলেন, প্রেমে ছিলেন আর মানুষের সঙ্গে ছিলেন।

দুই.

রাজপথ, মিছিল, শহীদ মিনার, বন্যায় ভেসে যাওয়া মুচিপাড়া, তার পৈত্রিক গ্রাম পাড়াতলীতে আমি শামসুর রাহমানকে দেখেছি। প্রথম দেখা এবং জীবনে প্রথম কবি দর্শন, সালটা যতদূর মনে করতে পারি ১৯৮৩। ২১শে ফেব্রুয়ারির সকালে আমাদের স্কুল- গুলশান মডেল হাই স্কুলে অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আমাদের প্রধান শিক্ষক খালেদ মোমিন ছিলেন ভীষণ ভালো সংগঠক। লেখকের প্রতি ছিলো তার শ্রদ্ধা আর আগ্রহ। তিনি আমাদের স্কুলে হাজির করেছিলেন শামসুর রাহমানকে। আমরা হাত মিলিয়েছিলাম কবির সঙ্গে। সেই সকালে ইত্তেফাক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল শামসুর রাহমানের কবিতা ‘গুড মর্নিং বাংলাদেশ’।

কবি নিজের কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন সেদিন। এই ঘটনা আমাদের জন্য রামধনু হয়ে আছে। তারপর তার সঙ্গে আমি হেঁটেছি অনেকটা পথ। ‘স্বাধীনতা তুমি’ আর ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’-এই যমজ কবিতার মালিক শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে রাজপথে নেমেছেন বার বার। হেঁটেছেন দীর্ঘপথ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যখন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেন সেখানে শামসুর রাহমানের অংশগ্রহণ ছিলো উজ্জ্বল। বাংলাদেশ যখন আক্রান্ত হয়েছে অশুভ শক্তির দ্বারা তখনি তিনি পথে নেমে এসে প্রতিবাদ করেছেন। ১৯৮৮ সালে দেশ যখন ডুবে গেলো প্রলম্বিত বন্যায়। তখন তিনি বিপন্ন মানুষের কাছে ছুটে গিয়েছেন। ত্রাণ তুলে দিয়েছেন অসহায় মানুষের হাতে।  দেশের যেখানে-যখন সাম্প্রদায়িকতা ছোবল হেনেছে শামসুর রাহমান সেখানে ছুটে গিয়েছেন। আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছেন। কলাম লিখেছেন।

তিন.

২০০০ সালের ১১ নভেম্বর। শামসুর রাহমান মেঘনা নদী পারি দিয়ে যাচ্ছেন তার পৈত্রিক গ্রাম পাড়াতলীতে। নরসিংদী জেলার রায়পুর উপজেলার এই গ্রামটি মেঘনার দ্বীপ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় শামসুর রাহমান এই গ্রামেই আশ্রয় নিয়েছিলেন পরিবার নিয়ে। আর বাড়ির পুকুর ঘাটে বসে লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা নিয়ে আলোড়িত সেই দুই কবিতা। রায়পুরা ঘাট থেকে ছইয়ের নৌকা যাচ্ছে পাড়াতলী। নৌকায় শামসুর রাহমান, তার স্ত্রী জোহরা রাহমান, কন্যা সুমাইয়া ইসলাম, পুত্রবধু টিয়া রাহমান, নাতনী নয়না রাহমান, রাকা, ভাগিনা সোহেল, কবি আবু হাসান শাহরিয়ার আর আমি। প্যারিস থেকে আনা টুকটুকে লাল রঙের শার্ট পরে আছেন কবি। ছইয়ের ফাঁক দিয়ে রোদ এসে খেলা করছে কবির চুলে, মুখাবয়বে।

নৌকায় বসে তিনি আমাকে লিখে দিলেন তার অনুভুতি-কথা, ‘এই মুহূর্তে আমাদের নৌকা মেঘনা নদীর বুক চিরে চলেছে আমাদের গ্রাম পাড়াতলীর দিকে। নামতে হবে আলুঘাটে। মেঘনার সঙ্গে আমার আত্মীয়তা সুদূর বাল্যকাল থেকে। কতরকম রূপই না আমি দেখেছি এই নদী-নারীর। কখনও সে খুব শান্ত, কখনও সে রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আমি এর এক অযোগ্য প্রেমিক। এর রূপে মুগ্ধ চিরকাল। সম্প্রতি এর রূপ আগের মতো নেই আর। কিন্তু তা ব’লে আমার প্রেমে ভাটা পড়েনি, ফিকে হয়ে যায়নি অনুরাগ। আমি আজ এর স্তনে, গালে, কটিতে অস্তিত্ব বিছিয়ে রেখেছি। ভালো থেকো, সুন্দর থেকো আমার মেঘনা, প্রিয়তমা মেঘনা।’

তারপর বাড়ির আঙিনা, পুকুর ঘাটে বসে শামসুর রাহমান সেই রাতের কথা স্মৃতি থেকে ফিরিয়ে আনলেন। অনেক পথ পছনে ফেলে মধ্যরাতে যখন অতীত-পুরুষের দরজায় টোকা দিলেন। অমনি খুলে গেলো প্রাচীন দরজা। আর ফুলের গন্ধ আলিঙ্গন করলো কবিকে। আর আমরা যেদিন গেলাম পাড়াতলী, সেদিন, সেই দুপুরের এক কিশোর কবির পাশে দাঁড়িয়ে মুখস্ত শুনিয়েছিলো তারই কবিতা । তখন অন্যরকম এক আলো দেখেছিলাম শামসুর রাহমানের চোখে। তিনি হয়তো ভাবছিলেন, এই অনাহারের দেশে, এই অনাচারের দেশে কবিজীবনে এক ধরণের সার্থকতা নিশ্চয়ই রয়েছে!

চার.

আমি কাছ থেকে, দূর থেকে যতটা তাকে দেখেছি, বুঝেছি আমার মনে হয় তিনি অন্যরকম ভালো মানুষ ছিলেন। এই শহরের একটা আলো ছিলেন তিনি। কবিতায় পুরো নাগরিক তিনি। সুদর্শন। খুব সহজে মানুষকে ‘না’ বলতে পারতেন না। ভোর থেকে তারানামা রাত অব্দি শ্যামলীর সেই দোতলা বাড়ির দক্ষিণের ঘরে বসে থাকতেন সুন্দরের জন্য, কবিতার জন্য। জন্মদিনে টেলিফোনে তাকে কেউ শুভেচ্ছা জানালে মুগ্ধ হতেন। উপহার পেলে শিশুর মতো খুশি হতেন। অনেকদিন ধরে ২৩ অক্টোবর জন্মদিনে শ্রেষ্ঠ উপহার ছিল শরতের সকালে বস্তির মিষ্টি কিশোরীর মুঠোভরা শিউলি ফুল। 

একবার এক ভর দুপুরে শামসুর রাহমান লেখার টেবিলে বসে আছেন শব্দ ধরবেন বলে। হাতে ধরা চায়ের পেয়ালা। হঠাৎই ঝংকার তুলে বাজলো টেলিফোন। ওপার থেকে হয়তো কেউ প্রশ্ন করেছিলো-‘কী করছেন, বা করছো?’

কবি স্নিগ্ধ হেসে উত্তর দেন, ‘চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে জীবন পান করছি।’

এই জীবন পান করা, কবিতায় জীবন যাপন করা শামসুর রাহমান আজ, এদিনে চলে গেছেন দূরে-বহুদূরে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)