স্বামী মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারলেও আরেকটু স্বস্তির জন্য গার্মেন্টস কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন মরিয়ম। সেই টাকা দিয়ে সহযোগিতা করতেন নিজের মাকে। ভাই থাকলেও তারা মায়ের দিকে নজর রাখতেন না। তাই চাকরিটা নিয়েছিলেন মরিয়ম। কিন্তু কে জানতো এই চাকরিই তার জীবন কেড়ে নেবে!
মরিয়মের স্বামী বাবুল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ১৪ দিন পর মরিয়মের লাশ পেয়েছি। চেনার কোনো উপায় ছিলো না। শুধু আইডি, হাতের চুরি আর পোশাক দেখে বুঝছি যে ওটা মরিয়মের লাশ। ‘মা হারা সন্তান দুটিরও এখন কষ্টের সীমা নেই। বাবা হয়ে আমি আর কতোটুকুই বা করতে পারি?’
স্ত্রীকে হারানোর পর সন্তান নিয়ে গ্রামেই থাকেন বাবুল। মরিয়মের মায়ের দেখাশোনাটাও তিনিই করেন।
একই দুঃখ রুবিনার ঘরে। চারবোনের মধ্যে দুইজনই কাজ করতেন রানা প্লাজায়। সেদিনের দুর্ঘটনায় কোনোভাবে ছোটবোন রোজিনা বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান রুবিনা। দুই বোনই ছিলেন সংসারের আয়ের উৎস। বাবা আগে রিক্সা চালাতেন, এখন সেই সুযোগও নেই। রুবিনার জন্য কাঁদতে কাঁদতে শরীরও যেন ক্ষয়ে গেছে অনেকটাই। তাই প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন ইউসুফ আকন্দ।
বলেন, ছোট মেয়েটা আবার একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতেই কাজ শুরু করেছে। সেটা দিয়েও এখন সংসার চালানো দায়। তার উপর রোজিনার চিকিৎসার জন্য খরচ হয়েছে অনেক টাকা। সহায়তা পেয়েছিলাম ৪৫ হাজার, পরে আরেকবার ৫০ হাজার টাকা সাহায্য পাওয়ার কথা। সেজন্য ব্যাংকে একাউন্ট করলাম। চিঠিও এসেছে আমার এলাকার টিএনও অফিসে। চিঠি নিয়ে ব্যাংকে গেলাম। কিন্তু এখনো সেই টাকা পেলাম না। কবে পাবো জানি না। সেটা হলেও একটু উপকার হতো বলে জানান ইউসুফ আকন্দ।
কথা হয় রানা প্লাজার ঘটনায় আহত আফরোজার সঙ্গে। শারীরিক অবস্থা তার বিশেষ ভালো না। মাথায় আঘাতটা ছিলো তীব্র। তাই কোনো কিছু নিয়ে বাড়তি টেনশন করলে বা একটু কিছু ভাবতে গেলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। গত কয়েকদিন অসুস্থতার কারণে কথা বলার মতো অবস্থাতেই ছিলেন না আফরোজা।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন তার দুঃখ কষ্টের কথা: আমার ডান হাতের মাঝখানের আঙুলটা নাই। পায়েরও তিনটা আঙুলের অর্ধেকটা কাটা পড়ে যায়। মাথায় অনেক আঘাত পাই। হাতে এখনো খেতে বা অন্যান্য কাজ করতে খুব সমস্যা হয়।
বিপদ আসার পর অবশ্য বেশ কিছু সহায়তা পেয়েছেন আফরোজা। দুই দফায় বেশ খানিকটা সাহায্য পেয়েছেন তিনি। কিন্তু অসুস্থতার কারণে আর কাজে যোগ দেওয়ার সাহস হয়নি। তাই সেসব টাকা দিয়েই গরু কিনে জীবন যাপন করছেন।
এই দুর্ঘটনা তাদের সবার জীবন থেকেই কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। কেড়ে নিয়েছে নিকটজন; নিকটজনকে করেছে পঙ্গু। তাই ভবিষ্যতে যেনো এমন দুর্ঘটনা আর না ঘটে সেটাই চাওয়া সকলের।
সবাই সহায়তা পেয়েছেন: শ্রম মন্ত্রণালয়
এই দুর্ঘটনায় যারা যারা আহত হয়েছেন তাদের সবাইকে বা যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে যতোটা সম্ভব সহায়তা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন: শ্রম মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল, আইএলও ট্রাস্ট ফান্ড, জেলা প্রশাসন ও প্রাইমার্ক থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মতো সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
‘তাছাড়া রানা প্লাজায় আহতরা যখনই এসে বলেছেন যে তারা কোনো সাহায্য পাননি, তখনই আমরা তাদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি।’
তিনি জানান, শুধু সাময়িকভাবে সহায়তা নয়, যখন যেভাবে সম্ভব দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বা নিহতদের সন্তানদের সহায়তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ‘ভবিষ্যতে যেনো এমন ঘটনা আর না ঘটে সেজন্য আমরা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। কর্মক্ষেত্রে যেনো সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে সেই চেষ্টাও আমরা করে চলেছি।’
নিহত সকলের সন্তানদের দায়িত্ব নিয়েছি: বিজিএমইএ
একইরকম কথা বললেন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, আহতদের আমরা নিজহাতে ট্রিটমেন্ট করিয়েছি। যেসব বাচ্চার অভিভাবক সেই সময়ে আক্রান্ত হয়েছে তাদের ভরনপোষণে আমরা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।
‘এই দুর্ঘটনার পর যেমন সরকার এগিয়ে এসেছিলো আক্রান্তদের পাশে তেমনই অনেক বেসরকারি এবং সাধারণ মানুষও এগিযে এসেছিলো। সারাবিশ্বে এই ঘটনাতেই সবচেয়ে বেশি মনিটরিং হয়েছে,’ জানিয়ে তিনি বলেন: সবার চিকিৎসাসেবা যতোটা সম্ভব দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এরপরও যতজন এসেছে সবার দেখাশোনা করেছি।
‘বিগত ছয় মাসে আর আমরা এমন কাউকে পাইনি যারা বলেছে তারা কোনো সহায়তা পাননি। সবাই কিছু না কিছু হলেও সহায়তা পেয়েছে।’
ভবিষ্যতে যেনো এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে সেটাও নিশ্চিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে বিজিএমইএ। সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এরইমধ্যে ৩৮টি পোশাক কারখানা দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া যাদের ভবনে টুকটাক সমস্যা আছে সেসব সারানোর কথা বলা হয়েছে।
‘পাশাপাশি বিজিএমইএ এমন একটি ফান্ড গঠন করতে চায় যেনো যারা কারখানার উন্নয়ন করতে চায় কিন্তু টাকার অভাবে করতে পারেন না; তারা যেনো সেখান থেকে টাকা নিয়ে ভবনের সংস্কার করতে পারেন।’
তারপরও নিহতদের স্বজন আর আহতরা বলছেন, সময় জীবনের ক্ষতগুলোর উপর সবচেয়ে বড় মলম হলেও কিছু ক্ষত কখনোই দূর হবার নয়। রানা প্লাজা দুর্ঘটনাও তেমনই একটি ট্র্যাজেডি।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ১১শ ৩৫ জন নিহত হন আর আহত হন প্রায় ২ হাজার মানুষ। ধংসস্তুপ থেকে উদ্ধার করা হয় ২ হাজার ৪৩৮ জনকে।