অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিচার না হওয়া, নিরাপত্তার অভাব, কোন কোন ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা, মাত্রারিক্ত দুর্নীতি এবং বিদেশের উন্নত জীবনের লোভের কারণেই বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এটর্নি জেনারেল অফিস-এই চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করা গেলে অর্থ পাচাররোধ সম্ভব বলেও জানিয়েছেন তারা।
পাশাপাশি জাতিসংঘের দুর্নীতি বিরোধী আইনের সহায়তায় পাচার করা অর্থ ফেরত আনা সম্ভব বলেও মন্তব্য তাদের।
গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার বা প্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বিষয়টি নিয়ে বলেন, আমার কাছে দুইটি ব্যাখ্যা আছে। একটি হচ্ছে, মানুষ অসৎ হলে ও খারাপ উদ্দেশ্য থাকলে অর্থ পাচারে লিপ্ত হয়। অন্যটি হচ্ছে, দেশে যখন মাত্রারিক্ত দুর্নীতি, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তখন তারা নিজেদের নিরাপদে রাখার উপায় খোঁজে। বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটলে যেন বিদেশে সহজে চলে যেতে পারে সে উদ্দেশে অর্থ পাচার করে।
নিরাপত্তাবোধের অভাবের কারণেও অর্থ পাচার হতে পারে মন্তব্য করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, দেশে যখন নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয় ও ভাল কোনো সম্ভাবনা দেখে না তখন মানুষ হতাশায় ভোগে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনায় বিদেশি ব্যাংকে রিটার্ন বেশি পাওয়া যায়। এছাড়াও উন্নত দেশে বসবাসের লোভ তো আছেই। এসব কারণে বিত্তশালীরা অর্থ পাচার করছে।
কিভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা এনবিআরের কাছে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণের সার্টিফিকেট জমা দেয়। কিন্তু কত টাকার আমদানি বা রপ্তানি করা হলো তার কোনো হিসেব জমা দেয় না। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু অর্থের লেনদেন সম্পর্কে জানে। সেখানে আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ জমা দেওয়া হয় না। ফলে এই দুইটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি ও টাকার পরিমাণ নির্নয়ে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে।
“ব্যবসায়ীরা যে কৌশলে, পণ্যের আমদানি মূল্য বেশি আর রপ্তানি মূল্য কম দেখিয়ে অর্থ পাচার করছে তা তদন্ত করার দক্ষতার অভাব আছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। এসব কারণেও অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।”
অর্থনীতিতে অর্থ পাচার নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে উল্লেখ করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, পাচার না হলে দেশে বিনিয়োগ বাড়তো। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো। অর্থনীতির আওতা আরো বড় হতো। এরফলে বৃদ্ধি পেত জিডিপি।
অর্থপাচারের বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এটা উদ্বেগেরে বিষয়। তবে আমি এতে অবাক হইনি। কারণ অপরাধের বিচার না হলে অপরাধ বাড়বে-এটাই স্বাভাবিক।
বিভিন্ন কারণে অর্থপাচার হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাচার করা অর্থ গ্রহণকারী দেশগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার হওয়া এসব অর্থ নিজ দেশে কাজে লাগানোর জন্য আইনকে দুর্বল করে তৈরি করেছে। কারণ ওইসব অর্থ তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারছে। এতে তাদের মুনাফা হচ্ছে।
“এছাড়া অনেকে ক্ষেত্রে বিদেশে পণ্য লেনদেন হয়। সে অর্থ ফেরত আনা হয় না। অন্যদিকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে অনেকে টাকা নিয়ে যায়। কিন্তু সেই অর্থ আর ফেরত আসে না।”
কিভাবে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব জানতে চাইলে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতিসংঘের দুর্নীতি বিরোধী আইন অনুযায়ী এটা প্রতিরোধ করা খুব সহজ। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের আাইনি সহায়তা নামক চুক্তিতে স্বাক্ষর করা লাগে। বাংলাদেশ কয়েকটি দেশের সাথে এই চুক্তি করেছে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি।
এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, এটর্নি জেনারেল অফিস ও দুদক-এই চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করা গেলে অর্থ পাচার রোধ করা সহজ হবে বলেও জানান তিনি
যারা অর্থ পাচার করছে তারা কোনো না কোনো ভাবে ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পৃক্ত-এমন মন্তব্য করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এটা আরো আগ থেকে হয়ে আসছে। ক্ষমতাসীনদের ছায়াতলে থেকে তারা এটাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে সিঙ্গাপুর থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে সক্ষম হয়েছে সরকার। অন্যান্য দেশ থেকেও আনতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
তবে অর্থ পাচার না হলে রাজস্ব দ্বিগুন হতো বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অনেক অর্থ পাচারকারী নজরদারিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন এনবিআরের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান। বুধবার দু’জন পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে সম্মাননা প্রদান বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, মুদ্রাপাচারের অনেকগুলো মামলা রুজু করা হয়েছে। বাণিজ্যিক বেশ কিছু মুদ্রাপাচারের ঘটনা তদন্ত করে রহস্য উৎঘাটন ও মামলা দায়ের করা হয়েছে। বেশকিছু অপরাধীকে সনাক্ত করে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। কিছু অপরাধী নজরদারির মধ্যে আছে।
গত দশ বছরে (২০০৫-২০১৪) বাংলাদেশ থেকে ৭৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার বা ৬ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে পাচারের ঘটনা তদন্ত করতে বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে সরকার।