আজব এক দেশ হচ্ছে আমাদের এই বাংলাদেশ! এদেশের আইন প্রণেতারা আইন সভায় দাঁড়িয়ে অবলীলায় বলছেন যে, প্রচলিত আইনে অপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর করা সম্ভব নয়, তাই তাদের ক্রসফায়ারে হত্যা করতে হবে। যেদেশের আইন প্রণেতারা ভয়ঙ্কর অপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর করার জন্য আইনের সংশোধনী আনা বা নতুন আইন প্রণয়নের কথা চিন্তা করতে পারেন না, সেদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে কীভাবে?
আইনপ্রণেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিকালে ধর্ষণ মহামারি রূপ নিয়েছে। ছাত্রী, শিশু, নারী শ্রমিক প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। কেউ রক্ষা পাচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণকারী গ্রেপ্তার হলেও বিচার হচ্ছে না। তদন্ত, চার্জগঠন, তথ্য-প্রমাণ-সাক্ষ্য-আলামত সংগ্রহ, উপস্থাপন ইত্যাদি যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর চলে যাবে, কিন্তু ন্যায় বিচারের দেখা মিলবে না।
কাজেই দুচারজন অপরাধীকে মেরে ফেলা অনুচিত নয়। বরং অপরাধের তাৎক্ষণিক শাস্তি হিসেবে ওটাই গ্রহণযোগ্য বেশি। শুধু আইনপ্রণেতারাই নন, এর পক্ষে সওয়াল করার লোকের খুব একটা অভাব হয় না। তাই তো আমাদের দেশে ধারাবাহিকভাবে বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টারের নামে ধারাবাহিক হত্যালীলা চললেও এর বিরুদ্ধে বড় কোনো প্রতিবাদ-অসন্তোষ নেই। মানুষ এই ভেবে সান্ত্বনা খোঁজে যে, শয়তানটা উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে।
কেবল সন্দেহভাজন অপরাধীকে ধরে ক্রসফায়ারে দিলেই অপরাধ কমে না। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে গত দেড় বছরে ৪৬৬ জনকে বিনাবিচারে হত্যা করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। প্রশ্ন হলো, এই ৪৬৬ জন মানুষকে বিনাবিচারে হত্যার মাধ্যমে দেশে মাদক সমস্যার কতটুকু সমাধান হয়েছে?
আসলে অপরাধ কমানোর প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে, যে কোনো মূল্যে অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা। অপরাধ করে কেউ-ই যেন পার না পায়-তা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে বিচার প্রক্রিয়া বদলাতে হবে। আইন সংশোধন করতে হবে। তদন্ত, তথ্য-প্রমাণ-আলামত-সাক্ষ্যসহ বিচারিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত যাবতীয় বিষয়গুলো দ্রুত এবং নির্ভুল করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য যা যা করণীয় তার সবই করতে হবে। এর বাইরে কাউকে মেরে ফেলা কোনো সভ্য সমাজের জন্য মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়।
আইন প্রণেতারা আইনসভায় দাঁড়িয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যার সপক্ষে কথা বলছেন, এটা ঠিক নয়। এটা মারাত্মক একটা ইঙ্গিত বহন করছে। এর ফলে মানুষের আইন এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি যেটুকু বিশ্বাস রয়েছে, তা-ও ভেঙে যাচ্ছে। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করার দায়িত্ব তাঁদেরই। পাশাপাশি আমাদের সবার তা রক্ষা করার দায়িত্ব।
এ দেশে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিসর্জন এমনিতেই অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। আমরা তাতেও খুব বেশি হেলদোল দেখাইনি। বিচারপ্রক্রিয়াটাও যদি বাতিলের খাতায় চলে যায় আর তা দেখে আমরা যদি উদ্বাহু নৃত্য করি, তবে এর চেয়ে বড় অঘটন আর হতে পারে না। আমাদের দেশে এখন পুলিশকে দিয়ে অপরাধীকে খুন করানোর পদ্ধতিকে অনেকটাই বৈধতা পেয়েছে। আইনের শাসনহীনতার সমাজে গণতন্ত্র ভালো চলছে না বলে ফ্যাসিবাদকে আলিঙ্গন করতে চায় যে মন, সেই মন এই রকমই শর্টকাট খোঁজে। আমরা সুস্থ সমাজ গড়তে পারিনি, কার্যকর প্রশাসন তৈরি করিনি, বিচারব্যবস্থাকে দ্রুত লয়ে বাঁধতে পারিনি। অগত্যা এখন ট্রিগার-অন্ত-প্রাণ পুলিশের কেরামতি দেখে হাততালি দিচ্ছি। অনেক খুনের ঘটনার পর আমরা সাব্বাসি দিচ্ছি, নরকের কীটেরা নরকে চলে যাক!
এ বড় অদ্ভুত সময়। নেট খুললেই ধর্ষণ, খুন, লাইভ আত্মহত্যা; অঢেল সমাহার। চ্যানেল ঘোরালে রিয়েলিটি শো। বড় পর্দা থেকে ওয়েব সিরিজ়, ‘সত্য ঘটনা অবলম্বন’এর ভরা জোয়ার। বিনোদন যত রিয়েলিটিকে আঁকড়াচ্ছে, রিয়েলিটি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হয়ে উঠছে বিনোদনের মতো। সেখানে এখন নিত্যনতুন টুইস্ট চাই, ধামাকা চাই। সবচেয়ে বড় কথা, নায়ক চাই। অ্যাকশন হিরো চাই। আপাতত পুলিশ-র্যাবই আমাদের হিরো।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এক দিকে ন্যায়বিচারের অসহনীয় দীর্ঘসূত্রতা আর অন্য দিকে একের পর এক পৈশাচিক অপরাধের সাক্ষী থাকতে থাকতে দেশবাসীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙা কি অস্বাভাবিক? দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, হতাশা আর অসহায়তা যদি এই এনকাউন্টারে কিছুটা কলজে জুড়োনো অনুভব পেয়ে থাকে, তা কি একেবারেই অপ্রত্যাশিত?
না, নিশ্চয়। কিন্তু যা কিছু দৃশ্যত ‘স্বাভাবিক’, তা-ই সমর্থনীয়, এমনও তো নয়। কারও দোষ প্রমাণ হওয়ার আগে, দোষ প্রমাণ হওয়ার সুযোগটুকুও না দিয়ে তাকে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে মেরে ফেলাটাই যদি ন্যায়বিচারের পরাকাষ্ঠা হয়, তার চেয়ে বেদনাময় কিছু হতে পারে না। আর এ দেশের এনকাউন্টার-ইতিহাস মাথায় রাখলে তো পারেই না। বরং ধর্ষণ-খুনে অভিযুক্তের এনকাউন্টারকে ঘিরে এই যে জনসমর্থনের বন্যা বইছে, তাতে রীতিমতো আশঙ্কা হয় যে, এর পর ধর্ষক-খুনি নাম দিয়ে অন্য অনেককেও না নিঃশব্দে সাফ করে দেওয়া হয়! এ দেশ এমন ঘটনা অনেক দেখেছে।
নিহতেরা আলাদা হতে পারে, সব মরণ সমান না হতে পারে, কিন্তু আজ্ঞাবাহী পুলিশের মুখ আর কত আলাদা হবে?
খুনি-ধর্ষকদের ফাঁসি চেয়ে এ দেশে কোলাহল কিছু কম হয়নি। কিন্তু তাতে খুন-ধর্ষণ কমেনি। শুধু বড় মাপের কোনও অপরাধ হলেই ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসিই চাই’ বলে গলা চড়াতে শিখেছি আমরা। অনেকে কুখ্যাত কোনো অপরাধী ধরা পড়লেই ‘ক্রসফায়ারের’ দাবি তুলছেন। ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’র আর কী কী সম্ভাব্য রূপ হতে পারে, তা-ই নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। ইতিউতি অনেকে বলছেন, গোপন নয়, প্রকাশ্য ক্রসফায়ার দরকার! অনেকে বলছেন, পুলিশ কেন, জনতা আছে কী করতে! দল পাকিয়ে খুনখারাপি তো চালু হয়েই গিয়েছে! ধর্ষণ করলে কেন পিটিয়ে মারা যাবে না?
এ দুর্ভাগা দেশ এখন আর বলে না, তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন! সে বলে, ও যদি করে, আমি করব না কেন? এই ‘ও’ ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন ধর্মের কেউ হতে পারে, কোনও রাজনৈতিক প্রতিযোগী বা প্রতিপক্ষ হতে পারে, যে কেউ হতে পারে। আমরা নিশ্চয় ক’দিন বাদে বলব, আইএস যদি মুন্ডু কাটার ভিডিয়ো বানাতে পারে, আমরা পারব না কেন?
পারিনি একদম, তা-ও নয়। ওই যে, রাজন নামে একজন শিশুকে পিটিয়ে হত্যার ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছিল! সেই বীর সন্তানদের পরিণতি কী হয়েছে, সেই খোঁজ অবশ্য আমরা আর নিইনি। আমরা নিপীড়ক নই, দর্শক মাত্র। ‘জ্বালিয়ে দাও-পুড়িয়ে দাও’ বলে হাঁকাহাঁকি করছেন, যারা পাল্টা ধর্ষকের লিঙ্গচ্ছেদন কিংবা ক্রসফায়ারের নিদান দিচ্ছেন, তারা ক্রুদ্ধ জনগণ মাত্র। এনকাউন্টার নিয়ে প্রশ্ন তুললে যারা ফেটে পড়ছেন, তারা হতবুদ্ধি নাগরিক মাত্র।
অপরাধ জঘন্যতম হলেও ক্রসফায়ারের নিদান কোনো মতেই সঠিক পথ নয়। রাষ্ট্র কখনও এ ধরনের হত্যাকে সহায়তা বা সমর্থন করতে পারে না। রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে যে, সরকার তৈরি হয়েছে সংবিধানের প্রতি আস্থাশীল হওয়ার শপথ নিয়ে। সরকার তৈরি হওয়ার পর আমি সব ভুলে গেলাম আর এ সব কাজে মদত দিলাম, এ চলতে পারে না।
এটা ঠিক যে আমাদের বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। সেখান থেকে মানুষ অস্থির হয়ে যান। এই দীর্ঘসূত্রতার পেছনে রয়েছে সরকারের উদাসীনতা। সেই সঙ্গে গোটা বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরাও সেই দায় এড়াতে পারেন না। তাঁদের আরও সক্রিয় হতে হবে। সক্রিয় করতে হবে। মানুষকে বিচার পাওয়াতে হবে। কিন্তু উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কাউকে মেরে ফেলাটা কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। সে যতো বড় অপরাধীই হোক। কেবল প্রতিশোধ বা বদলা নিতে আমরা যদি একে-অপরকে খুন করে যাই, চোখের বদলে চোখ তুলে নিই, তাহলে এই পৃথিবীর সব মানুষই একদিন অন্ধ হয়ে যাবে। অন্ধের সমাজ নিশ্চয়ই আমরা চাই না।
তারপরও আমাদের সমাজে ক্রসফায়ারের পক্ষে জোর আওয়াজ তোলার লোকের অভাব হয় না। এমন বাস্তবতায় বহুব্যবহৃত বাক্যটাই কেবল মনে পড়ে আবার— যেমন নাগরিক, তার তেমনই শাসক। যেমন সমাজ, তার তেমনই নাগরিক!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)