আধুনিক জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র বা জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব বেশিদিন আগে নয়। ইউরোপের শক্তিরা নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধগুলো বেশিরভাগ সময়ই ধর্ম নিয়ে হতো। এরপর একটা পর্যায়ে এসে তারা যুদ্ধ বন্ধের চিন্তা করে। এর ফল হিসেবেই আসে ট্রিটি অব ওয়েস্টফ্যালিয়া (Treaty of Westphalia), যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মেলে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, একইভাবে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম প্রমাণ করে যে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের ধারণা খুবই কল্পনাপ্রসূত, এর জন্মের মধ্যেই নিহিত থাকে এর ধ্বংসের বীজ।
ট্রিটি অব ওয়েস্টফ্যালিয়ার সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন: এটি ১৬৪৮ সালের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সই হওয়া অনেকগুলো শান্তিচুক্তির সিরিজ, যার মধ্য দিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের ৩০ বছরের এবং স্পেন ও ডাচ প্রজাতন্ত্রের মাঝে ৮০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটে। স্পেন এই সময় আনুষ্ঠানিকভাবে ডাচ প্রজাতন্ত্রকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার জানান, ট্রিটি অব ওয়েস্টফ্যালিয়ার মধ্য দিয়ে মোটা দাগে দু’টি বিষয়ে বিভিন্ন পক্ষ সমঝোতায় আসে: ১. সীমানাভিত্তিক রাষ্ট্র। অর্থাৎ প্রতিটি রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট সীমানা থাকবে। এখান থেকে প্রতিটি দেশের ভিন্ন মানচিত্রের একটি ধারণা পাওয়া যায়। ২. হস্তক্ষেপ না করা বিষয়ক নীতি। অর্থাৎ এক দেশ অন্য দেশের ব্যাপারে নাক গলাবে না বা আক্রমণ করবে না।
‘রাষ্ট্র অনেক পুরনো সংগঠন হলেও আধুনিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি এ দু’টোই,’ বলে মন্তব্য করে ড. মজুমদার বলেন: একটি দেশ অন্য দেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে বা অনধিকার চর্চা করলে আমরা বলি ওই দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। কারণ ট্রিটি অব ওয়েস্টফ্যালিয়ার অধীনে জার্মানির ওয়েস্টফ্যালিয়া অঞ্চলে চুক্তিবদ্ধ হয় জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনসহ বড় বড় সব ইউরোপীয় শক্তি।
রাষ্ট্র গঠনের চারটি মৌলিক উপাদান: ভূখণ্ড, লোকসংখ্যা, সরকার ও সার্বভৌমত্বের মধ্যে শেষের উপাদানটি সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর। কেননা একে হস্তান্তর করা যায় না। এটিই একমাত্র উপাদান যার বাস্তব কোনো অবয়ব নেই, যাকে ছোঁয়া যায় না।
বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, জাতিরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে বৈধতা দেয় সার্বভৌমত্ব। আজকের অর্থে এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এসেছে ইউরোপের সেই ট্রিটি অব ওয়েস্টফ্যালিয়া থেকেই। সেক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করা ও যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখযোগ্য।
‘স্বাধীনতা’ এবং ‘সার্বভৌমত্ব’- এ দু’টি ধারণার সঙ্গে সবাই কমবেশি পরিচিত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, স্বাধীনতা কোনো জাতি, দেশ, বা রাষ্ট্রের এমন একটি অবস্থা যার অধীনে সেখানকার সব অধিবাসী বা তার একটি অংশের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা এবং (সাধারণত) সার্বভৌমত্ব থাকবে।
অন্যদিকে সার্বভৌমত্ব বলতে কোন দেশ বা রাষ্ট্রের নিজের অভ্যন্তরীণ এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণের চূড়ান্ত ক্ষমতাকে বোঝায়। আইনশাস্ত্রে সার্বভৌমত্ব বলতে বোঝায় অন্য কারও হস্তক্ষেপ ছাড়া একটি শাসন ব্যবস্থার নিজেকে পরিচালনার পূর্ণ অধিকার ও ক্ষমতা।
ইন্টারন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব সোশ্যাল সায়েন্সেস বইয়ে বলা হয়েছে, ‘সার্বভৌমত্বের ধারণা বলতে এমন এক রাজনৈতিক তত্ত্বকে বোঝায়, যার অনুসারে, প্রতিটি সরকার পদ্ধতিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো এমন এক নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকতে হবে, যা কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি প্রয়োগ করবে এবং তা হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতাসম্পন্ন ও সিদ্ধান্ত কার্যকরের ক্ষমতাসম্পন্ন।’
স্বাধীনতা অর্জন ‘বিপ্লব’-এর চেয়ে ভিন্ন কিনা– এ প্রশ্নটা বহুদিন ধরেই চলছে। পাশাপাশি সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য সহিংসতাকে বৈধতা দানের বিষয়টি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও কিছু বিপ্লবের লক্ষ্য থাকে জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন; অন্যগুলো শুধু ক্ষমতা লাভ বা পুনর্বিন্যাসের উদ্দেশ্যে ঘটানো হয়। সেখানে গণতন্ত্রের মতো স্বাধীনতার দরকারি উপাদানগুলো না-ও থাকতে পারে। জাতিরাষ্ট্রই প্রথম কোনো বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ছাড়া স্বাধীনতার ধারণা দিয়েছে।
আধুনিক সময়ের রাষ্ট্রগুলোকে ‘জাতিরাষ্ট্র’ (Nation state) বলা হয়। এর আগের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ‘সাম্রাজ্যিক রাষ্ট্র’ (Empire state)। যেমন, রোমান সাম্রাজ্য। এরও আগে ছিল নগররাষ্ট্র (City state)। সেগুলোর আকার ছিল খুব ছোট।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব
ঠিক কোন দেশটি প্রথম স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল তা স্পষ্ট না হলেও প্রথম জাতিরাষ্ট্র, অর্থাৎ একই জাতির জন্য একটি রাষ্ট্র– এ ধারণার উদাহরণ প্রথম পাওয়া যায় ইতালিতে। পাঁচটি নগররাষ্ট্র একই ভাষার ওপর ভিত্তি করে এক হয়ে যায়।
একইভাবে ভাষার ওপর ভিত্তি করে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ধারণা। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার শুধু ধর্মের ভিত্তিতে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করে তা টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন যে একটি অবান্তর ভাবনা, এটিই তার হাতেনাতে প্রমাণ বলে মন্তব্য করেন ড. শান্তনু মজুমদার।
বাংলাদেশের হাজারো বছরের প্রাচীণ জনপদের ছিল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, স্বকীয় ধর্ম, লোকাচার, নৃতাত্ত্বিক ও ভাষিক ঐতিহ্য। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়ে এই জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক – কোনো ক্ষেত্রেই আত্মবিকাশের সুযোগ পায়নি। শিক্ষা, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস-দর্শন, রাজনীতি-অর্থনীতি চর্চা ও সাধনা ছাড়া তাদের মাথা তুলে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। আর এজন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন স্বাধীনতা।
স্বাধীন বাংলার চিন্তা আজ নয়, সেই গুপ্ত যুগ থেকে বারভূঁইয়াদের আমল হয়ে ব্রিটিশ যুগে বঙ্গভঙ্গ ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে বাঙালির মাঝে এসেছে। সবশেষে ১৯৪৭-এ ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগ মুহূর্তে বসু-সোহরাওয়ার্দী, কীরণ শংকর রায়, আবুল হাশিম স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলার প্রস্তাব করেন বাংলা ও বাঙ্গালির স্বার্থে। যদিও তা ব্যর্থ হয়।
প্রাচীন গ্রিক স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর গণতান্ত্রিক আদর্শের পাশাপাশি ১৩ শতকে ইংল্যান্ড পার্লামেন্টের অভ্যুদয়, ১২১৫-এর ‘ম্যাগনা কার্টা’, ১৬২৮ সালের ‘পিটিশন অব রাইট’, আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বিখ্যাত বাণী, ‘সব মানুষই সমান হয়ে জন্মায়’ এবং ১৮৬২ সালের ‘দাস-মুক্তির ঘোষণাপত্র’ বাঙ্গালি তৎকালীন নেতৃস্থানীয়দের স্বাধীনতার চেতনায় আকৃষ্ট করতে থাকে।
এরপর ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, ইন্দোনেশিয়া, কিউবা, ভিয়েতনাম বিপ্লব ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং ভলতেয়ার, রুশো, মন্তেস্কুর মতো ব্যক্তিদের বিপ্লবাত্মক চেতনা বাঙ্গালির মনে একেক সময় স্বাধীনতা এবং সার্বভৌম ক্ষমতার ধারণা আনে বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা।
অন্যদিকে ভাষা, সংস্কৃতির ওপর আঘাত জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে। বাংলার যে কোনো সার্বভৌমত্ব নেই, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন তা নিশ্চিত করলে বাঙ্গালি গোপন ও প্রকাশ্যে আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের নকশা গড়ে তোলে।
বাঙ্গালির সংগ্রামের লক্ষ্যই স্বাধীনতা ছিল বলে ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর এক বেতার ভাষণে উল্লেখ করেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ধারণা ছিল বাংলার প্রত্যেক মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে জনগণকে মুক্তি দেয়া। বাঙালি হবে একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি। ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মিশ্র আদর্শে এই ভূখণ্ড পরিচালিত হবে।