কানে হাত না দিয়েই চিলে কান নিয়েছে বলে চিলের পিছনে দৌড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আবার বহু প্রচলিত উদাহরণ -“বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে।”
প্রথম কথার অর্থ -অর্থহীন সমস্যার পেছনে বৃথা দৌড়াদৌড়ি। দ্বিতীয় কথার অর্থ -উপায়হীন সমস্যার আবর্তে বিচরণ করা।
বর্তমানে আমাদের সমাজে প্রায় সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি বিরাজমান। এই দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে কিছু সংখ্যক ভিতু বা সংকীর্ণ লোকজন স্বদেশ ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমাতে ব্যস্ত। অথবা মেধাবী সন্তানকে চিরতরে বিদেশের মাটিতে পাঠিয়ে দেয়ার কল্পনা। আরও কিছু সংখ্যক আছেন যারা গা ঝাড়া দিয়ে ভাবছেন- আমার সন্তানকে বাজে ছেলেদের সাথে মিশতে দিব না; চব্বিশ ঘণ্টাই চোখে চোখে রেখে মানুষ বানাব।
ভুলে গেলে চলবে না পাশের বাড়ির আগুন সম্পূর্ণ পাড়া বা মহল্লার জন্য ধ্বংস বইয়ে দিতে পারে। গোটা দেশের তরুণ সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ-এর মত করে, মা মাটি আর মাতৃভাষাকে ভালবাসতে হবে। একটি দেশের কল্যাণ নির্ভর করে একটি সুশিক্ষিত জাতির উপর। প্রকৃত কল্যাণ সেই জাতির নারী অগ্রসরতার ওপর। আমাদের দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী আগ্রসরতার ওপর।
আর আজ দেশে যে সমস্যাটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো”নারী নির্যাতন”। নারী নির্যাতন নামক সমস্যাটির পেছনে কেবল হন্য হয়ে ছুটে চলাই সার হচ্ছে। হচ্ছে না এর কোন জোরালো প্রতিকার। কোথায় এই নির্যাতনের বীজ লুকানো অবস্থায়? কোথায় এর শিকড়?তা উপড়ে ফেলতে হবে। আজ বড় বেশি প্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছে নারী নির্যাতনের সঠিক কারণ অনুসন্ধান করে পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা।একথা বলা যাবে না, পদক্ষেপ আদৌ হয়নি। যেমন -“স্বর্ণকিশোরী”। এরাই আগামী দিনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আমাদের আরও সমৃদ্ধ থাকার কথা।যেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সর্বত্র আজ নারীর পদচারণা।খেলাধুলায় নারী বহির্বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে। এভারেস্ট বিজয়ে এদেশের নারী গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। পাড়া গাঁয়ের সাহসী কিশোরী নিজেই বাল্য-বিবাহ রোধে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। এ দেশের নারীরা আজ জলে স্থলে অন্তরীক্ষে পিছিয়ে নেই কোথাও।
তবে কেন নারী নির্যাতনের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নারী নির্যাতনের চিত্র যতটা প্রকাশ পাচ্ছে, তার চাইতে অপ্রকাশিত নির্যাতন দ্বিগুণ বা আরও বেশি। কাগজের পাতা উল্টালেই চোখে পড়ে নির্যাতিত কন্যা শিশু। যা জাহেলিয়া যুগের কন্যা শিশু যেমন আপন আলয় কিংবা বিদ্যালয়ে নিরাপদ নয়। তেমনি বাসের কিশোর হেল্পারের কাছেও নারী আজ নির্যাতিত। এর চাইতে সামাজিক নীচতা আর কি ই বা হতে পারে!
অথচ যে কিশোরের কথা ছিল বই এর বোঝা কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফেরা। অথবা খেলার মাঠে ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, ফুটবল খেলায় প্রতিযোগিকে হারিয়ে দেয়া। কিন্তু তার দুরন্ত কৈশোরের উচ্ছলতার পরিবর্তে পরিবারকে অর্থের জোগান দিচ্ছে। তার হাতে টাকা আসছে নিজের প্রয়োজনের অধিক। ফলে সে করছে এই টাকার অপব্যবহার। রাস্তায় ঘাটে, পার্কে, স্টেশনে অগণিত শিশুর অবাধ বিচরণ। যা একটি দেশ বা জাতির জন্য শুধুই অকল্যাণকর। অভিভাবকহীন এই শিশুগুলো কী কোনদিন সভ্যতার আলো খুঁজে পাবে! সুসন্তান তৈরির জন্য প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব পরিবারের। শিশুরা ভাল এবং মন্দ দুটোই শিখে পরিবার থেকে। কাজেই পারিবারিক পরিবেশ সুন্দর হওয়া একান্ত কাম্য। মা -বাবার স্নেহের পরশ, মা বাবার সঙ্গ পাওয়া শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক।
শিশুশ্রম কঠোর আইনের মাধ্যমে বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি করে পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করা একান্ত প্রয়োজন। একটি সুন্দর সুশীল সমাজ গঠনের জন্য শিশু -কিশোরদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা খুব জরুরি। প্রত্যেক শিশু-কিশোরের বিদ্যালয়ের পড়াশুনোর পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য খেলাধুলার যেমন প্রয়োজন জ্ঞান-বিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী অ্যাডভেঞ্চার, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদি বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। এই পর্যায়ে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ -এর বিশাল আয়োজন “বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র”। আরও এক সুবিশাল বই-এর আয়োজন “বাতিঘর”। বর্তমান সময়ের স্বনামধন্য লেখক অধ্যাপক জাফর ইকবাল -এর কিশোর উপন্যাসগুলিও যথেষ্ট সহায়ক। এই জাতীয় বই পাঠের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের ভেতর সৎ সাহস, পরোপকারী, আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব গড়ে উঠবে। অনেক পুরনো হলেও সেই কথা মনে করিয়ে দেয়-“একটি প্রদীপের আলো থেকে লক্ষ প্রদীপ জ্বালানো যায়। ”
নেপোলিয়ন যেমন একজন শিক্ষিত মায়ের সংস্পর্শে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে চেয়েছিলেন, তেমনি একজন মা অথবা বাবার অসচেতনতাই একটি জাতি ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। ধ্বংস কারো কাম্য নয়। আমরা আমাদের সন্তানদের আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাব। তাই মনে ধারণ করতে হবে – “সকলের তরে সকলে আমরা,প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)