করোনা আসার সাথে সাথে বাঙালি সমাজ কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন, শাটডাউন, জনতার কারফিউ, ক্লাস্টার ট্রান্সমিশন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন, হটস্পট এরিয়া সহ প্রভূত শব্দের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আরো নতুন নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে।
মানুষের কোলাহলে শুরু হওয়া দিনগুলো উক্ত শব্দগুলোর পদভারে জর্জরিত, অদৃশ্য শত্রুকে পদদলিত করতে সারা পৃথিবীব্যাপী করোনা ভাইরাসকে মোকাবেলা করতে বদ্ধপরিকর। তবুও থেমে নেই ভাইরাসের মহামারী, লাশের স্তূপ আর বিভীষিকা দেখে শঙ্কিত সমগ্র বিশ্ব। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ থেকে মানুষ জাতি কবে রেহাই পাবে সেটিও হলফ করে বলা যাচ্ছে না।
কেননা, শুরুর দিকে করোনার প্রকোপ কিছু দেশে সীমাবদ্ধ থাকলে বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ভাইরাসটির বিস্তার ও ভয়াবহতা স্তব্ধ করে দিয়েছে পৃথিবীর প্রাণস্পন্দনকে। এ এক অভাবনীয় পরিস্থিতি যেখানে কেউই ভাইরাসটির আক্রমণের বাইরে নয়, প্রভাবশালী রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সাংবাদিক, ডাক্তার, শিক্ষক, কর্মজীবি, শ্রমজীবী কেউই নিরাপদে নেই। জীবনের জয়গান গাওয়া পৃথিবীটা মৃত্যুর মিছিলে অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে লকডাউনের ভাবানুবাদ হচ্ছে প্রত্যেক মানুষ স্ব স্ব ঘরে অবস্থান করবে এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচল ও যাতায়াত বিশেষ প্রয়োজন (জরুরী ওষুধ সংগ্রহ ও হাসপাতালে গমন) ছাড়া বন্ধ রাখবে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, এ সংকটময় মূহুর্তে ঘরে অবস্থান করা প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব, বিশেষভাবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক দায়িত্ব পালন করে নিজের পাশাপাশি পৃথিবীতে বসবাসরত প্রত্যেকেকে নিরাপদে রাখার যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে সবাইকে।
আর এক্ষেত্রে লকডাউনই হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতিতে উত্তরণের জন্য একমাত্র ও কার্যকরী পদক্ষেপ। কেননা করোনার উৎপত্তিস্থল চীনের প্রতিবেশী দেশ ভিয়েতনামে করোনায় আক্রান্তে এখনো মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভিয়েতনামের সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপের ফলেই সকল জনগণকে একীভূত করে লকডাউনে সক্ষম দেশটির জনগণ করোনাকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে লকডাউনের কোন বিকল্প নেই।
করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি আতঙ্ক ও ভয়ের সৃষ্টি করছে, যেখানে আমরা কেউই বিপদের আশংকা থেকে মুক্ত নই। নিত্যদিনের পরিসংখ্যান পূর্বের দিনের পরিস্থিতিকে ছাড়িয়ে ভয়াবহ সংকটকে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। তারপরেও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো করোনার ভয়াবহতাকে আমলে নিয়ে যথার্থ গুরুত্ব প্রদান করছে না। করোনার সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে সকলেই ওয়াকিবহাল থাকলেও নিয়ম মানতেই যেন নারাজ সকলেই। পাশের জেলায় কিংবা পাশের থানায় রোগী সংক্রমণের খবর পেলেও নিজেরা স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়ামবলী মেনে চলছে না। একটি গ্রামের চিত্র তুলে ধরে লকডাউনের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা প্রয়োজন, লকডাউন কি আসলেই মানছে দেশের জনগণ? কিছু কিছু জায়গায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে লকডাউন করা হয়েছে এবং সেখানে লাল পতাকা টানিয়ে সতর্কাবস্থা জারি করেছে প্রশাসন।
পত্রিকার খবরের মাধ্যমে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়া নানা পেশা শ্রেণির মানুষদের মাধ্যমে করোনার ভাইরাসের প্রকোপ বিস্তার লাভ করছে এবং ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যাদের শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে তাদের সাথে নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেরত আসা মানুষদের যোগসাজশ ছিল। গ্রামের মসজিদগুলোতে মাইকিং করে জানানো হচ্ছে; গাজীপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়িতে আসা কর্মজীবীদের বাধ্যতামূলকভাবে হোম কোয়ারেন্টাইনের থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? এমনো হয়েছে নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা এক কর্মজীবীকে ঘরে থাকার জন্য বলা হলে উক্ত কর্মজীবীর পরিবারের বাকি সদস্যরা সমস্বরে ঝগড়া শুরু করে দেয়। সুতরাং গ্রামের পরিস্থিতি কেমন সেটা বোঝানোর জন্য এ উদাহরণটি যথেষ্ট। তবে একটা কথা না বললেই হয়, সরকার কিংবা প্রশাসন যত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক না কেন নিজেরা সাবধান এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত স্বাস্থ্য নিয়মাবলী না মেনে চললে করোনা প্রতিরোধ করা কোনভাবেই সম্ভবপর হবে না।
প্রশাসন কিছু কিছু জায়গায় লকডাউনের ব্যবস্থা করেছে আবার কিছু কিছু জায়গায় স্থানীয় লোকজন মিলে লকডাউনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আদৌ কি গ্রামের মানুষজন লকডাউনের কর্মকান্ড মেনে চলছে-সঙ্গত কারণেই গ্রামের মানুষের কথা বলা হচ্ছে কেননা সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর শহর থেকে গ্রামের দিকে যে জনশ্রুত নেমেছিলো তার কারণেই গ্রামে বসবাসকৃত মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে শহরের তুলনায় বেশি। প্রশাসনের উদ্যোগে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর পুলিশ-আর্মির টহলের কারণে বাজারে সাময়িকভাবে লকডাউন পালন করা হয়।
টহলের পূর্বে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বাজার কমিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ অবগত থাকায় তারা মানুষজনকে সজাগ করে দেয় এবং মানুষজন প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা আসার পূর্বে যেমন সটকে পড়ে আবার দায়িত্বপ্রাপ্তরা চলে যাবার পরে বাজারে অনেকেই এখনো ভিড় জমায়। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের যে ভিডিওগুলো ইতিমধ্যে অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সেখানে থেকে নিশ্চিত করে বলা যায় শারীরিক দূরত্ব বজায় না রাখলে করোনার ভয়াবহতাকে প্রতিরোধ করা কখনোই সম্ভব নয়।
স্বাভাবিকভাবে দেখলে দেখা যায়, গ্রামে গঞ্জে দোকান পাট বন্ধ রয়েছে। কিন্তু দোকানের সামনে গিয়ে খোঁজ নিলে ভেতর থেকে কন্ঠ শোনা যায় কি লাগবে ভাই? অর্থাৎ দোকানপাটও যেমন খোলা রয়েছে মানুষও কিন্তু বাজারে দেদারসে যাচ্ছে। কারণ মানুষ না গেলে দোকানের ভেতরে দোকানদার থাকার কথা না। সুতরাং লকডাউন কেমন চলছে সেটা কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে। চোর-পুলিশ খেলা চলছে, পুলিশের ভয়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কারণে জনসাধারণ অনেকেই বাড়িতে অবস্থান করছে। কিন্তু বাড়িতে অবস্থান যে অত্যন্ত জরুরী সেটা বিবেচনায় নিয়ে বাড়িতে থাকার অভ্যাস করতে হবে। অন্যথায় করোনার প্রকোপে মহামারীর শঙ্কা অমূলক কিছু নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)