বইছে শ্রাবণের অশ্রুধারা। শোকের এই মাসে আমরা নানাভাবে স্মরণ করছি জাতির পিতাকে। শত্রুরা ভেবেছিল তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে যাবে বাঙালির বিজয়গাথা ও অসামান্য ইতিহাস।
নিকষ অন্ধকার সেই সময়টায় বিশ্বাসঘাতকের দল বলছিল তিনি নাকি আমাদের এই জয়যাত্রায় কেউ নন। তার উত্তরে কবি মহাদেব সাহা লিখেছিলেন ‘এই নাম স্বতোৎসারিত’। এই কবিতায় তিনি আরো বলেছিলেন, “..কিন্তু বাংলাদেশের আড়াইশত নদী বলে,/ তুমি এই বাংলার নদী, সবুজ প্রান্তর/ তুমি এই চর্যাপদের গান, তুমি এই বাংলা অক্ষর”। তাই তো কবি শামসুর রাহমান তাঁর ‘ধন্য সেই পুরুষ’ কবিতায় লিখেছেন, “ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে/ চিরকাল, গান হয়ে/ নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা, যাঁর নামের ওপর/ কখনো ধুলো জমতে দেয়না হাওয়া”। কবি মনে করেন এ সেই পুরুষ “যাঁর নামের ওপর পতাকার মতো/ দুলতে থাকে স্বাধীনতা”।
এমন অক্ষয় এই নাম একদিনেই সৃষ্টি হয়নি। হাজার বছর ধরে এই সমাজ উন্মুখ হয়ে বসেছিল এমন একজন নেতার আগমনের অপেক্ষায়। নীল আকাশ ভেদ করে তিনি এসেছিলেন আমাদের একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র দেবেন বলে। শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সেই নবীন দেশটিকে পুননির্মাণেও তিনি তাঁর প্রতিটি ক্ষণ উজাড় করে দিয়েছেন। পরিবারের দিকে তাকাননি। সন্তানদের সামান্য সময়ও দিতে পারেননি। সাড়ে তিন বছরেই আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে দিয়ে গেছেন এক শক্তিশালি আর্থ-সামাজিক ভিত্তি। সে সময় হাতে কোনো সম্পদ ছিল না। রিজার্ভে ছিল না এক ডলারও। অন্তহীন সব সমস্যা।
তিনি নিজেই বলেছেন, “দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। টাকা নাই, পয়সা নাই, চাল নাই, অর্থ নাই, খাবার নাই, কিছুই নাই।” ( ১৬ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে প্রেসিডেন্ট ভবনে বাস্তুহারাদের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণ থেকে)। কিন্তু তবু তিনি ছিলেন খুবই আশাবাদী। শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলায় রূপান্তরের প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোসহীন। ঐ ভাষণেই তাই তিনি বলেছিলেন,“কিন্তু আমার মাটি আছে, আমার মানুষ আছে, আমার ঈমান আছে, আমার যা কিছু আছে তাই নিয়ে নতুন করে সোনার বাংলাকে নতুন করে গড়তে হবে এবং নতুন করে মানুষের জীবিকার বন্দোবস্ত করতে হবে।”
তিনি সেদিনই আহ্বান করেছিলেন এই বলে যে এজন্যে পুরো জাতিকে ধৈর্য ধরতে হবে। একই কথা তার কয়েকদিন বাদে অস্ত্র জমা দিতে আসা মুক্তিবাহিনীর সদস্যদেরও তিনি বলেছিলেন। প্রশ্ন করেছিলেন- যদি স্বাধীনতা যুদ্ধ আরও প্রলম্বিত হতো তাহলে কি তারা তা চালিয়ে যেতো না? সেই মনোভাব নিয়েই দেশ গড়ার কাজে তরুণদের মনোনিবেশ করতে বলেছিলেন। প্রায় সবাই তাঁর এই আহবানে সাড়া দিয়েছিলো। কিন্তু স্বাধীনতা-বিরোধী দালাল চক্র এবং অতিবাম কিছু শক্তি অস্থির তরুণদের আরও অসহিঞ্চু করে তুলছিল। সা¤প্রদায়িকতা ও ‘বিপ্লবে’র নামে তারা পুরো সমাজে অশান্তি তৈরি করছিল। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধেয় নেতা মওলানা ভাসানীও নতুন দেশ গড়ার চ্যালেঞ্জগুলোর কথা জেনেও প্রথম থেকেই সবকিছুতে খুত ধরছিলেন এবং সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিচ্ছিলেন।
এসবের সাথে যুক্ত হয়েছিল তাঁরই অনুসারী এক সময়ের ছাত্রলীগ নেতারা যারা দ্রুত ‘সমাজতন্ত্র’ কায়েমের নামে অসহিঞ্চু তরুণদের আরও অস্থির করে তুলছিল। একাংশকে সশস্ত্র করতেও তাদের বিবেকে বাজেনি। ঘাটতি অর্থনীতির টানাপোড়নে তো ছিলই। এমন পরিস্থিতিতে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও নষ্ট মানুষ মজুতদারি, চোরাচালান ও মুনাফাখুরি তৎপরতায় লিপ্ত হয়ে সমাজ ও অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছিল। দলে ও প্রশাসনের মধ্যেও দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের অন্যায় কাজকর্ম বঙ্গবন্ধুকে খুবই মর্মাহত করছিল। তাছাড়া সদ্য স্বাধীন দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রেরও অভাব ছিল না রাজনীতিতে ও প্রশাসনের অন্দরমহলে ।
এমন বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই তিনি তাঁর আকর্ষণীয় নেতৃত্বের গুণে দেশকে পুননির্মাণে একের পর এক আইন ও নীতিমালা তৈরি করে যাচ্ছিলেন। সংবিধান তৈরিতে কালবিলম্ব করেননি। দেশের অভুক্ত মানুষের জন্য খাদ্য সাহায্য জোগাড় করছিলেন। অবকাঠামোর পুনর্বাসনে মনোযোগী ছিলেন। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণও করছিলেন। মনে হয় তিনি তখন দশ হাতে কাজ করছিলেন। সে সময়ের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় তিনি যে প্রজ্ঞা, ক্ষীপ্রতা ও সাহস দেখিয়েছিলেন তা এক কথায় অনন্য।
তাঁর বাস্তবানুগ এবং একই সঙ্গে দূরদর্শী সেসব নীতি ও কর্মের খানিকটা বিবরণ এখানে তুলে ধরছি। বঙ্গবন্ধুর নতুন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল বহুমুখী। তবে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো ছিল খুবই ভয়াবহ। খাদ্য ঘাটতি ছিল তীব্র। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার শূন্য। এতোসব মানুষের খাদ্য জোগানোই ছিল পয়লা নম্বরের সমস্যা। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই ছিল।
যুদ্ধের সময় কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। তাই খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। তদুপরি এক কোটির মতো শরণার্থী দেশে ফিরেছেন। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হচ্ছিল। ঘরবাড়ি তৈরি ও মেরামতে সহযোগিতা করতে হচ্ছিল। খাদ্যের মজুত, বীজ এবং অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহে দারুণ ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। খাবার বিতরণেরও সমস্যা দেখা দিচ্ছিল।
কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। কৃষি ও পানি সম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম যুদ্ধে ব্যাহত হয়েছিল। শিল্পখাতও দারুণ সংকটে পড়েছিল। উদ্যোক্তারা পাকিস্তান চলে গেছেন। উর্ধ্বতন ব্যবস্থাপক ও দক্ষ শ্রমিকরাও চলে গেছেন। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করা হয়নি। বিদেশের সাথে ব্যবসায়িক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তাই দ্রুতই এসব শিল্পকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নিতে হয়। প্রাদেশিক সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারে রূপান্তর, নতুন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, ব্যাংকগুলো জাতীয়করণ করে ফের চালু করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না।
এজন্যে অধ্যাদেশ তৈরি করতে হয়েছে। দ্রুতই সেগুলো চালু করতে হয়েছে। কৃষক ও শিল্প ইউনিটগুলোকে অর্থায়নের উদ্যোগ নিতে হয়েছে। পাশাপাশি চলছিল বাজেট ও প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ। অবকাঠামো খাতের পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহ। প্রধান সমুদ্র বন্দরে মাইনপোতা। বড় বড় রেল ও সড়ক-সেতু বিধ্বস্ত। আর কে না জানেন যে সমুদ্রবন্দর, নদীবন্দর, রেল, সড়ক ও নৌব্যবস্থা একে অপরের পরিপূরক। ফেরিও শত্রæরা ধ্বংস করে গেছে। বিমান তো ছিলই না। তাই যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। বন্ধু দেশ সমূহের সহযোগিতা এবং আমাদের কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের প্রচেষ্টায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পাচ্ছিল।
তা সত্ত্বেও জরুরি খাদ্য পরিবহনে গতি আনা যাচ্ছিল না। এর ওপর ছিল বৈরি ভূরাজনীতি। পাকিস্তানী নষ্ট কূটনীতির কারণে চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনও অনেকটাই বৈরি। বিশেষ করে পিএল৪৮০ কর্মসূচির আওতায় খাদ্য সাহায্য বিষয়ে তাদের বৈরি মনোভাব বাংলাদেশের ভঙ্গুর খাদ্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছিল। তা সত্ত্বেও কিছু বন্ধু দেশের সহায়তা এবং বঙ্গবন্ধুর মোহনীয় নেতৃত্বের গুণে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও আর্থিক সংস্থাগুলোর সদস্য হতে পেরেছিল বাংলাদেশ। চীনের ভেটোতে জাতিসংঘের সদস্যপদ পেতে দেরি হয়।
শেষ পর্যন্ত সেই সমস্যারও সমাধান হয় বঙ্গবন্ধুর নীরব কূটনীতির জোরে। ভারত, কানাডা, সুইডেন বিদেশী মুদ্রা দিয়ে সাহায্য করেছিল বলেই আন্তর্জাতিক সংস্থায় সদস্যপদ পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ সকল সামাজিক খাতের অবকাঠামোও ঢেলে সাজাতে হয়েছিল নতুন সরকারকে। সামাজিক সচেতনতা বাড়িয়ে এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নীতি গ্রহণ করেছিল সরকার। জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষাকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেবার নীতিটিও ছিল খুবই প্রাসঙ্গিক।
মোদ্দা কথা সামাজিক সমাবেশকরণ ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পিত উন্নয়নের মূল কৌশল। একাত্তরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ছিল ‘মাইনাস’ ১২ শতাংশ। বাহাত্তরে অর্থনীতির আকার ছিল আট বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নতুন করে শুরু করতে হয়েছে। অথচ বিদেশী মুদ্রার ভাণ্ডার শূন্য। এমন বাস্তবতায় শুরুর দিনগুলোতেই বঙ্গবন্ধুর নেয়া অর্থনৈতিক কৌশলগুলোর মধ্যে নীচের কয়েকটি ছিল উল্লেখ করার মতো:
এক. অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও সামাজিক পুঁজির সমাবেশের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ। কৃষিতে বেশি করে বিনিয়োগের মাধ্যমে খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধি করা।
দুই. খাদ্য সাহায্য ছাড়াও বিদেশী সহায়তা গ্রহণ করা। তবে তা হতে হবে শর্তবিহীন। বিদেশী সহায়তা নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলা।
তিন. যদিও অর্থনীতি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকবে তবুও ব্যক্তিখাত ও সমবায়ের বিকাশকে উৎসাহিত করা হবে।
চার. দেশজ কায়দায় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রচলন করে সামাজিক সুবিচার ও অর্থনৈতিক সাম্য অর্জন করা হবে। সামাজিক গণতান্ত্রিক এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের প্রাধান্য থাকলেও অন্যান্য অংশীজনদের অংশগ্রহণে বাধা দেয়া হবে না। তবে রাষ্ট্র শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তার মানে বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক কৌশলে কৃষি ও শিল্প উভয়েই সমান গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি দু’পায়েই হাঁটতেন। আর নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচকগুলো ক্রমান্বয়ে উন্নতি করছিল।বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী নীতি গ্রহণে পারদর্শী ছিলেন।
তবে তাঁর অর্থনৈতিক দর্শনের মূলে ছিল ‘শোষণহীন সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করা। স্বল্পমেয়াদী নীতিগুলো ছিলো:
এক. এক কোটির মতো শরণার্থীদের উপযুক্ত ত্রাণ দিয়ে নতুন ফসল ওঠা পর্যন্ত পুনর্বাসন করা।
দুই. মুক্তিযুদ্ধের পরপরই সমাজে যে অস্ত্রের ছড়াছড়ি ছিল তা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আইন-শৃক্সখলা পুনঃস্থাপন করা। সমাজে নৈরাজ্য প্রতিরোধ করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
তিন. ভঙ্গুর যাতায়াত ব্যবস্থা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে খাদ্য সংগ্রহ ও বিতরণ করা। সারা দেশে রেশনিং ব্যবস্থা, ন্যায্যমূল্যের দোকান স্থাপন, নিত্যপণ্য আমদানির জন্য টিসিবি প্রতিষ্ঠা করে সরবরাহ চেইনকে মজবুত করা।
চার. একটি প্রাদেশিক সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারে রূপান্তর করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করা।
পাঁচ. সমাজে যাতে কোনো বিশৃক্সখলা সৃষ্টি না হয় সেজন্য অর্থনীতির পুনর্বাসন ও পুননির্মাণের খুব জোর দেয়া হয়েছিল।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর সরকার নয়া বাস্তবতায় দীর্ঘমেয়াদী কিছু লক্ষ্যপূরণেও তৎপর ছিলো।
এক. খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সবুজ বিপ্লব।
সূচনার মাধ্যমে কৃষির আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তি-নির্ভর করার উদ্যোগ নেয়া।
দুই. দীর্ঘমেয়াদী সার্বিক প্রজনন হার কমানোর জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সামাজিক আন্দোলনকে উৎসাহ দেয়া।
তিন. প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে সারাদেশে শিক্ষার আলো জ্বেলে দেয়া।
চার. অধিকার ভিত্তিক উন্নয়নের অঙ্গিকার সমূহকে সংবিধানের মৌল নীতিমালা হিসেবে যুক্ত করা।
পাঁচ. জ্বালানি খাতেও আত্মনির্ভরতার অংশ হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুত উৎপাদনে বাড়তি জোর দেয়া।
ছয়. মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য বিচক্ষণ মুদ্রানীতি গ্রহণ করা।
এসব নীতিমালার সুফল দৃশ্যমান হচ্ছিল। ধান উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়ছিল। মূল্যস্ফীতি তিন বছরেই অর্ধেকে নেমে এসেছিল। অর্থনীতির অন্যান্য সূচকগুলোও ছিল বাড়ন্ত। পাটের রফতানি বাড়ছিল। শিল্প উৎপাদনও বাড়ছিল।
আগেই যেমনটি বলেছি বঙ্গবন্ধু ছিলেন খুবই বাস্তবানুগ রাষ্ট্রনায়ক। এই খাদ্য ঘাটতি ও বিধ্বস্ত অবকাঠামোর পুনর্বাসনে বিদেশী সাহায্য নিতে দ্বিধা করেন ন। এমন কি আন্তর্জাতিক অ-সরকারি প্রতিষ্ঠান অক্সফামের কাছ থেকে ত্রাণের বদলে ফেরি সংগ্রহে দ্বিধা করেননি। জাতিসংঘের ও বন্ধুদেশের সহযোগিতা নিতে মোটেও কার্পণ্য করেননি। ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ নীতির আওতায় তিনি জোট-নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে দ্রুতই বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন। এমন কি চীন বা সৌদি আরবের সাথেও তিনি নীরব কূটনীতি পরিচালনা করতে একটুও পিছপা হন নি।
শুরুতেই অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে ডেপুটি চেয়ারম্যান করে পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন। দেশের সেরা মেধাবি অর্থনীতিবিদ, প্রকৌশলী ও সরকারি কর্মকর্তাদের এই কমিশনে জড়ো করেন। অর্থনীতির ভিত্তিকে শক্তিশালী করা এবং সাম্যের অর্থনীতি চালু করার উদ্দেশ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ বরাদ্দ (২৪%) কৃষি খাতে দেয়া হয় । শিল্পকে দেয়া হয়েছিল ২০%। আর শিক্ষাকে ৭.১ শতাংশ। এছাড়াও তিনি কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। উদ্দেশ্য, সোনার বাংলা গড়ার জন্য সোনার মানুষ তৈরি করা। এসব থেকেই বোঝা যায় যে তিনি অনেক দূরে দেখতে পেতেন। আর ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নে বিশ্বাসী ছিলেন।
নেতা হিসেবেও তিনি ছিলেন নান্দনিক। দরদী। বাস্তবানুগ। গরিব-হিতৈষী। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী। সারা বিশ্বের নিপীড়িতদের সহায়। তিনি যৌথ-নেতৃত্বে বিশ্বাস করতেন। তাই তো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁর সহ-নেতারা তাঁর আদর্শেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। তবে নেতাদের চেয়ে তিনি কর্মীদের ওপর বেশি ভরসা করতেন। কর্মী-অন্তপ্রাণ বঙ্গবন্ধু তাই সংকটকালে কখনো নিরাশ হন নি। মুক্তিযুদ্ধের আগ দিয়ে যে ‘লড়াকু মন’ জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন তাকে পুঁজি করেই দেশবাসী দেশ স্বাধীন করেছে। পরবর্তী সময়েও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামেও তিনি এই সাধারণ মানুষের সৃজনশীল উদ্যমের ওপরই বেশি নির্ভর করতেন।
তিনি ছিলেন পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ একজন রাষ্ট্রনায়ক। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করার বিপক্ষে ছিলেন। আর সেকারণেই নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন তাঁকে বিশ্ববন্ধু বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কেননা, সামাজিক শান্তির জন্য এই নীতিটি খুবই জরুরি। দুর্ভাগ্য আমাদের এবং বিশ্বের নির্যাতীত নিপীড়িত মানুষের যে এমন রূপান্তরবাদী মানবিক রাষ্ট্রনায়ককে তাঁরই দেশের কিছু বিশ্বাসঘাতক অমানুষ ১৯৭৫ সানের পনেরই আগস্ট গুলি করে হত্যা করে। শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা হলেও বঙ্গবন্ধু রয়ে গেছেন আমাদের নিশ্বাসে প্রশ্বাসে। তিনি দিন দিন আরো বড়ো হচ্ছেন। আরো বিরাট হচ্ছেন। কেননা তিনি যে ছিলেন ‘দিঘল পুরুষ’। তাই ভরসার বাতিঘর হিসেবে রয়ে গেছে তাঁর চিন্তা, কর্ম ও দর্শন।
“হাত তুললেই
ধরে ফেলতো চাঁদ
আকাশের নীল
ধরে ফেলতো সপ্তর্ষী মণ্ডল কেমন অনায়াসে।
সে ছিল দিঘল পুরুষ
তার বুকের গভীর শব্দে
আকাশ ফেটে চৌচির হয়ে যেতো স্বদেশের মমতায়
আর সাড়ে সাত কোটি মানুষ হয়ে যেতো মন্ত্রমুগ্ধ
হেঁটে যেতো তার সাহসের সীমানায়।”
(বাবুল জোয়ারদার, ‘সে ছিল দিঘল পুরুষ’)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)