চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

যারা যেভাবে চালান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয় হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করছেন ব্যবসায়ীরা। শিক্ষার্থী-অভিভাবক-শিক্ষকসহ অনেকেই বলছেন, শিক্ষাটাকেও তারা শেষ পর্যন্ত ব্যবসার উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করছেন। শিক্ষাকে যতোটা না তারা সেবা হিসেবে মনে করেন তার চেয়ে অনেক বেশি মনে করেন লাভজনক ব্যবসা হিসেবে। 

দেশের সবগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ট্রাস্টি বোর্ড পরীক্ষা করে দেখো গেছে, উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই নানান ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কেউ হাসপাতালের মালিক, কারো বা আছে ওষুধ কোম্পানি। কেউ কোনো বড় জ্বালানি কোম্পানির কর্ণধার, কেউ বা জড়িত কম্পিউটার ব্যবসার সঙ্গে। এনজিওদের নামেও খোলা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। 

ভ্যাট নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের পর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবসা হয়তো পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না; তবে সরকারের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরো যুগোপযোগি করতে বাধ্য করা। পড়াশোনার মান যেনো বাড়ানো হয় সেজন্যও তাগিদ দিয়েছেন তারা। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. ফাহমিদুল হক বলেন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগই কোনো নিয়ম নীতি ঠিকঠাক মানতে রাজি নয়। তাদের একটা নির্দিষ্ট সময় পরে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সেটাও মেনে চলছে না অনেকে। আবার অনেকে নিজস্ব ক্যাম্পাস তৈরি করলেও সেটা অনেক সময় ঢাকা কেন্দ্রিকই থেকে যাচ্ছে। ফলে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না কিছুতেই।

এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন তুলেছেন যে একটি ভবনে কিভাবে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকে? এরকম বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় কি না সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। 

তার উপর সিজিপিএ নিয়েও নানান কথা রয়েছে। সবাই না হলেও বেশিরভাগের মধ্যেই শিক্ষার মান ঠিক না রেখেই সিজিপিএ দেওয়ার প্রবণতার অভিযোগ আছে।

ঢাবির শিক্ষক ফাহমিদুল হক বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার মান তো বটেই, প্রশ্ন রয়েছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান নিয়েও। ‘সরকারের তাই এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত,’ বলে মনে করেন তিনি।

শুরু থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায়ীদের একটি নতুন ব্যবসাক্ষেত্র। তারা সেটাকে কাজেও লাগিয়েছে। কিন্তু যেসব শর্ত পূরণ করার কথা তা হয়নি বলে ছাত্র-ছাত্রীরাও নিয়মিত অভিযোগ করে। 

এসব সমস্যার সমাধান বিষয়ে ড. ফাহমিদুল হক বলেন, সমস্যার সমাধানে সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যেসব নীতিমালা রয়েছে সেসব আবারও যুগোপযোগি করে প্রণয়ন করতে হবে।

‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল, পিএইচডি এসব করা সম্ভব হয়, কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব প্রোগ্রাম নেই। সেসব চালু করলে শিক্ষার মান আরো উন্নত হবে।’

তিনি বলেন, হার্ভার্ডও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেও টিউশন ফি দিতে হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষার সঠিক মান বজায় রাখা নিশ্চিত করতে হবে তেমনি টিউশন ফিও যেন কখনো মাত্রাছাড়া না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের  শিক্ষক গৌতম রায় এ বিষয়ে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন।

‘সেগুলোর জন্য যেমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, তেমনই সরকার এবং ইউজিসিরও কিছু দায়িত্ব পালন করতে হবে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় ব্যক্তিগত লাভালাভের কথা চিন্তা করেই গড়ে উঠেছে। তাই সেটাকে কিভাবে দেশের জন্য আরো উপযোগি করে তোলা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে,’ বলে মনে করেন তিনি।

গৌতম রায় বলেন, প্রতিষ্ঠার সময় এসব প্রতিষ্ঠানকে বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিলো, যেমন নির্দিষ্ট সময় পরে স্থায়ী ক্যাম্পাসে চলে যাওয়া। কিন্তু এসবের বেশিরভাগই মানছে না কেউ। সেদিকে একটু নজর দিতে হবে। কারা মেনে চলছে, কার মানছে না সেটা দৃঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

‘ইউজিসির ভূমিকাটাও বেশ বড়। তারা সবগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে র‌্যাঙ্কিং করতে পারে। তারপর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কি সমস্যা রয়েছে সেটা সমাধানে তৎপর হতে হবে।’

তাছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরও বেশ কিছু কার্যক্রম চালু করা উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, যেমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশ কিছু বিষয় চালু করা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া যায়। যেমন গণিত, ইতিহাস ইত্যাদি। তাছাড়া তাদের গবেষণার বিষয়ের দিকেও দেখতে হবে।

এক্ষেত্রে যেমন তাদের এগিয়ে আসতে হবে তেমনই যেসব প্রতিষ্ঠানে গবেষণার সুযোগ রয়েছে তাদেরও সহযোগিতা করতে হবে। এখন কোনো গবেষণা হলে বুয়েট বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে হয়, তেমনই যেনো কোনো গবেষণা তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গেও নেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে, বলে মনে করেন গৌতম রায়।

পাশাপাশি দক্ষ শিক্ষকের দিকে নজর দেওয়ার কথাও বলেন শিক্ষা গবেষণার এই শিক্ষক।

তিনি বলেন: যেহেতু এসব প্রতিষ্ঠান তৈরিই হয়েছে লাভালাভের চিন্তা মাথায় রেখে তাই সরকার তাদের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত ঠিক করে দিতে পারে। যেমন: তারা টিউশন ফি ঠিক রেখে তাদের লাভের এত অংশ এই কাজে ব্যয় করবে এবং এত অংশ ওই খাতে ব্যয় করবে। এভাবে চলতে পারলে হয়তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সবগুলোই দেশের জন্য উপকারী হয়ে উঠবে।