সংগীতের ভুবনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কত কত গান। সুর, লয়, ধ্বনির সম্মিলনে গড়ে ওঠেছে এক মায়াবী জগত। যা ধরা যায় না। ছোঁয়া যায় না। নাগালও পাওয়া যায় না। কেবলই অনুভব করা যায়। তবে গানের আছে প্রকারভেদ। কত রকমের যে বিভাজন। বিভিন্ন রাগের। বিভিন্ন অনুরাগের। কোনোটা আনন্দের। কোনোটা বেদনার। আবেগ আছে। আছে ব্যাকুলতাও। কখন কোন গান যে হৃদয়তন্ত্রী ছুঁয়ে যাবে, অনুভবে বেজে ওঠবে কোন সুর, কেউ বলতে পারে না। মন-মানসিকতা, মেজাজ-মর্জি, পছন্দ-অপছন্দের ওপর নির্ভর করে ভালো লাগা, মন্দ লাগা। মানুষের মন তো বর্ষার আকাশের মতো। কখন কোন রূপ ধারণ করবে, নিজেও জানে না। প্রতিটি মুহুর্তেই বদলায়। বদলে যায়। এরসঙ্গে তাল মিলিয়ে গান লিখেছেন গীতিকাররা। সুর দিয়েছেন সুরকাররা। আর গেয়েছেন কণ্ঠশিল্পীরা। কোনো গান বা সুর যখন প্রচারিত হয়ে যায়, সেটি হয়ে যায় সর্বজনীন। এটা যতটা না বাণিজ্যিকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে, তার চেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ে শ্রোতাদের কণ্ঠে ও অনুভবে। তবে সব গান তো আর একই রকম জনপ্রিয়তা পায় না। প্রচারিত গানটি কারো ভালো লাগতে পারে। নাও লাগতে পারে। এটা শ্রোতার রুচি ও কানের ওপর নির্ভর করে। তবে একই রকম কিংবা একই মেজাজের গান সাধারণত সব সময় ভালো লাগে না।
মানুষ তো বৈচিত্র্যপিয়াসী। কখনো সফট, কখনো হার্ড পছন্দ করে। ভোরবেলায় এক রকম, অপরাহ্নে হয়তো আরেক রকম আবার গোধুলিলগ্নে একদমই ভিন্ন মেজাজের গান ভালো লাগতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে গান শোনা বা গাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশ-পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্টর। রোমান্টিক মুহুর্তে যে গানটি শুনতে মন চায় কিংবা গাইতে ইচ্ছে করে, যখন মন খারাপ থাকে, তখন নিশ্চয়ই সে ধরনের গান ভালো লাগবে না। আর সব গান একসঙ্গে শোনা ও গাওয়া তো সম্ভব নয়। এ যাবৎ সৃষ্টি করা হয়েছে অঢেল গান। তা থেকে কখনো কখনো কোনো কোনো গান বেজে ওঠে হৃদয়ের গহিনে। ছুঁয়ে যায় বুকের অতল। স্পর্শ করে মর্ম। গান তো আর সবাই গাইতে পারেন না। গানকে মূলত বাঁচিয়ে রাখেন শ্রোতারা। পেশাদার শিল্পীর সংখ্যা তো সীমিত। স্বাভাবিক কারণেই সৌখিন শিল্পী কিংবা বাথরুম সিঙ্গারদের সংখ্যাই বেশি। তাঁদের অধিকাংশই কখনো একাকী, কখনো আত্মমগ্ন হয়ে, কখনো কখনো প্রিয়জনের সান্নিধ্যে নিজের অনুভবটুকু সুরে সুরে মেলে ধরেন। সেটা হতে পারে সুরে কিংবা বেসুরেও। বেশিরভাগ সময় আনমনে কিংবা অবচেতনায় কণ্ঠে ওঠে আসে গান। আর গুনগুন করেন না, এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। একান্ত নিজস্ব মুহূর্তে গান যেভাবে বন্ধু হতে পারে, তার কোনো বিকল্প হয় না।
গানের প্রতি মুগ্ধতা সেই শৈশব থেকে। এ জীবনে কম গান তো শোনা হলো না। বাংলাদেশ বেতারের সম্প্রচার থেকে শুরু করে হালের ইউটিউব পর্যন্ত কত গানই তো হৃদয় পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। সব গান তো আর স্মৃতির অ্যালবামে সাজানো নেই। কত গানই হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। প্রিয় শিল্পী, প্রিয় গানের সংখ্যাও নেহাত মন্দ নয়। কখনো কোথাও সেই গানগুলো বেজে ওঠলে বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সুখের আবেশ। আবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় কষ্টের অনুভূতিও। কখনো কখনো টলমল করে চোখ। আসলে গানের কাছে নিজেকে যেভাবে সঁপে দেওয়া যায়, নিজেকে নিবেদন করা যায়, গান যেভাবে আবিষ্ট করে, আপ্লুত করে, অন্য কোনোভাবে সেটা সম্ভব হয় না। আমি গানের একদমই বোদ্ধা নই। স্রেফ ভালোবাসা থেকে গান পছন্দ করি। গান গাইতে না পারাটা জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট হয়ে আছে। তারপরও একান্ত নিভৃতে বুকের ভিতরটা যখন গুনগুন করে ওঠে, তখন কিন্তু অল্প কিছুই গানই বার বার ফিরে ফিরে আসে। আমার মতো অ-সুরের পক্ষে সবার গান গাইতে পারা সম্ভব হয় না। তাছাড়া মনেও রাখতে পারি না। মস্তিস্কের মেমোরি কার্ডের পরিসর এতই সীমিত, চাইলেও বেশি কিছু জমিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। অল্প যে ক’জন শিল্পী তাতে স্থান করে নিয়েছেন, তাঁদের অন্যতম হলেন লাকী আখান্দ।
আমার সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, অনুভব-অনুভূতিতে লাকী আখান্দ হয়ে আছেন পরম প্রশান্তির এক নাম। তাঁর গাওয়া, তাঁর সুর করা, তাঁর লেখা একাধিক গানই আমাকে সঙ্গ দেয়। আমাকে আমোদিত করে। আমাকে উৎফুল্ল করে। অন্তর্মুখী মনোভাবের কারণে এগিয়ে গিয়ে কাউকে কোনো কিছু বলতে পারি না। কারো কাজেও আসতে পারি না। তবে দূর থেকে সহানুভূতি বোধ করি। অনুভূতির প্রকাশটা ঘটে ভিতরে ভিতরে। সে ক্ষেত্রেও লাকী আখান্দের মতো শিল্পীরা এগিয়ে আসেন। তাঁদের গানগুলোই বাড়িয়ে দেয় সহযোগিতার হাত। কোনো ‘নীলা’র মন খারাপ দেখলে বুকের মধ্যে বাজতে থাকে, ‘দিয়েছে কে তোমায় ও মনে ব্যথা/কাঁটা হয়ে হয়ে বিঁধেছে কি কারো কথা/কাছে এসো তুমি মেয়ে মুছে দেবো আঁখি পারা/চলে যাবে তখনই যত বেদনা’। যখন এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করি, তখন হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, ‘আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না/ফেরারি পাখিরা কুলায় ফেরে না’। প্রিয় কাউকে নীল মণিহার দেওয়া না হলেও মুহূর্তটুকু কল্পনা করতে ভালোই লাগে, ‘এই নীল মণিহার, এই স্বর্ণালী দিনে/ তোমায় দিয়ে গেলাম/ শুধু মনে রেখো’। আবার কখনো সান্ত্বনা খুঁজি, ‘দ্বীপজ্বালা রাত জানি আসবে আবার/কেটে যাবে জীবনের সকল আঁধার’।
লাকী আখান্দের সুর করা গানগুলোও বুকের মধ্যে ভাবাবেগ সৃষ্টি করে। উদ্বেলিত করে। নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর গাওয়া ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে/মনে পড়লো তোমায়’ গানটি বৃষ্টির দিনে অকারণেই স্মৃতিকাতর করে দেয়। ফেরদৌস ওয়াহিদের ‘আগে যদি জানতাম তবে মন ফিরে চাইতাম/ এই জ্বালা আর প্রাণে সহে না’, কুমার বিশ্বজিৎ-এর ‘যেখানে সীমান্ত তোমার/ সেখানে বসন্ত আমার/ ভালোবাসা হৃদয় নিয়ে/আমি বার বার আসি ফিরে/ডাকি তোমায় কাছে’ কিংবা জেমসের ‘লিখতে পারি না কোনো গান আজ তুমি ছাড়া/ ভাবতে পারি না কোনো কিছু তুমি ছাড়া/কী যে যন্ত্রণা এই পথ চলা/বিরহ স্মৃতি তোমাকে ঘিরে তুমি জানো না’ ভিন্ন ভিন্ন আবেগ, অনুভূতি এনে দেয়। সামিনা চৌধুরীর ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে/রাতের নির্জনে/ জোনাকীর আলো নেভে আর জ্বলে/শাল মহুয়ার বনে’ গানটি সৃষ্টি করে রোমান্টিক এক আবহ। যেন এমন কোনো দৃশ্যপটের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার অপেক্ষায় আমিও।
হ্যাপী আখান্দের গাওয়া ‘চলো না ঘুরে আসি অজানাতে/যেখানে নদী এসে থেমে গেছে/আবার এলো যে সন্ধ্যা শুধু দু’জনে/ঝাউবনে হাওয়াগুলো খেলছে/সাঁওতালি মেয়েগুলো চলছে/লাল লাল শাড়িগুলো উড়ছে/তার সাথে মন মোর দুলছে/ওই দূর আকাশের প্রান্তে/সাতরঙা মেঘগুলো উড়ছে’ আমার প্রিয় গানের একটি। মনটা ফুরফুরে থাকলেই এ গানটি প্রাণখুলে গাইতে ইচ্ছে করে। এমনকি সাধ জাগে ‘ঘুড্ডি’ ছবির রাইসুল ইসলাম আসাদ হতে। সব সময় গানে বর্ণিত অনুভূতি বা মেজাজ নিয়ে একইভাবে গানগুলো গাওয়া বা শোনা হয় না। অকারণেও গানগুলো বুকের মধ্যে গুঞ্জন তোলে। ভরিয়ে দেয় বুকের শূন্যতা। এটাও লাকী আখান্দের গানের মহিমা। তাঁর গানগুলোর আবেদন ফুরিয়ে যাওয়ার নয়।
২০ জানুয়ারি ঢাকা ক্লাবে কয়েকজন ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে সম্মানিত করে লস অ্যাঞ্জেলস প্রবাসীদের একটি সংগঠন। সে অনুষ্ঠানে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয় লাকী আখান্দকে। অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি এসেছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে সেলফি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। তাঁর পাশের টেবিলেই বসেছিলাম। খুবই ইচ্ছে হয়েছিল কাছে গিয়ে তাঁকে বলি, আপনার গান আমাকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে রাখে। মুখচোরা স্বভাবের কারণে প্রিয় কাউকে মনের একান্ত কথা মুখ ফুটে বলতে পারি না। সেদিন তাঁকেও বলতে পারি নি। আর কখনো বলতেও পারবো না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)