এ এক অন্য পৃথিবী। এই পৃথিবী দেখার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু হঠাৎই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অতি দ্রুত আমরা মুখোমুখি হলাম এই অন্য পৃথিবীর। যেখানে গাছের পাতা ঝরার মতোই ঝরে পড়ছে মানুষের প্রাণ। এখন কোথায় শিক্ষা, কোথায় ব্যবসা, কোথায় অর্থ সঞ্চয়, কোথায়ই বা চাকরি! জীবন যখন অচল পয়সার মতো হয়ে যায়, তখন জীবনে এসব মূল্যহীন হয়ে যায়।
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল আলম মাসুদের মা, ৫ ভাই এবং ছেলে করোনায় আক্রান্ত। এদের মধ্যে বড় ভাই মোরশেদুল আলম মারা গেছেন। অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী করোনা শনাক্ত হয়ে চিকিসাধীন আছেন। তার স্ত্রী এবং সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। শমরিতা হাসপাতাল, সন্ধানী লাইফ সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক এমপি হাজী মো. মকবুল হোসেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ, হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এমপি মোহাম্মদ এবাদুল করিম বুলবুল। উল্লিখিত ব্যক্তিদের সকলেই দেশের শীর্ষ ধনীদের অন্যতম। বাঁচার আকুতি নিয়ে স্বেচ্ছাবন্দির জীবন বেছে নিয়েও করোনার আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি!
সবচেয়ে ট্রাজিক মৃত্যু ঘটেছে এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদুল আলমের। তাদের দখলে রয়েছে ৮টি ব্যাংক, ৩টি ব্যাংক বর্হিভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং দুটি বিমা কোম্পানিসহ মোট ৩৪টি কোম্পানি। শুধু বাংলাদেশে নয়, সিঙ্গাপুর ও কানাডার ধনীদের তালিকায়ও স্থান পেয়েছে গ্রুপটি। এই গ্রুপের ৫ ভাইসহ মোট ৬জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে দুই ভাইয়ের অবস্থা সংকটাপন্ন। কিন্তু তাদের জন্য হাসপাতালে দেয়া হয়েছে একটাই আইসিইউ বেড। একবারে একজনকেই সেবা দিতে পারবে এই যন্ত্র। অথচ দুজনই মরণাপন্ন। অন্তিম সময়ে ছোট ভাইয়ের মুখ থেকে খুলে নিয়ে বড় ভাইকে দেয়া হয় ভেন্টিলেশন সাপোর্ট। কিন্তু ততক্ষণে তার ফুসফুসের কার্যক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে মারা গেলেন বড় ভাই মোরশেদুল আলম। তড়িঘড়ি করে যন্ত্রটি আবার দেয়া হলো ছোট ভাইয়ের মুখে। মৃত্যুর সঙ্গে এখনও লড়ছেন তিনি। অথচ তাদের মতো দুই তিনজন উদ্যোক্তা চাইলেই দেশের পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পাল্টে দিতে পারতেন। কিন্তু তারা তা করেননি। এদেশের বড়লোকরা কখনও দেশে চিকিৎসা করেন না। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নে তাদের কোনো নজর কখনও ছিল না। বড়লোকরা ভাবেন, তাদের চিকিৎসার জন্য তো বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সুব্যবস্থা আছেই। দরকার শুধু একটি বিমানে চেপে বসা। কিন্তু হায়, তারা কি কখনও ভেবেছিলেন, দুনিয়ায় এমন দিন আসবে, যখন বস্তা বস্তা ডলার ঢাললেও বিমান উড়বে না! মাদ্রাজ,-সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড-লন্ডন-বনের কোনো হাসপাতালের দরজায় পৌঁছানো যাবে না! শুধু এস আলম গ্রুপই নয়, এমন অনেক শিল্প গ্রুপের মালিক আজ আগাম বুকিং মানি দিয়েও হাসপাতালের আইসিইউ এর ব্যবস্থা করতে পারছেন না!
পারবেন কীভাবে, দেশের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সুবিধা থাকলে না পাওয়া পাবে? অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, দাপট দিয়ে আজ করোনা থেকে রেহাই মিলছে না। কিন্তু কেন এমন হল? কার দোষ? কোন ভুলে আজ এমন নির্মম পরিণতি?
আসলে মানুষের অহঙ্কার আর অপরিণামদর্শিতার কারণে আজ পৃথিবীব্যাপী এক করুণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ নিজে এক মহাশক্তিধর প্রাণী। বুদ্ধিবলে এবং বাহুবলে। অন্তত নিজেকে সে তাই ভাবে। এই গ্রহের অন্য প্রাণীদের সে পরোয়া করে না। প্রকৃতিকে কোনও মূল্যই দেয় না মানুষ। সে মনে করে তার হাতেই সবকিছু। এই পৃথিবীর নিয়ন্ত্রক সে। একটা বোতাম টিপে কোটি কোটি মানুষকে মেরে ফেলার ক্ষমতা তার আছে। সব কিছু নিমেষে ধ্বংস করে দেবার বলে সে বলীয়ান। কিন্তু মানুষ করোনা ভাইরাসকে মারতে পারছে না। অসহায়ের মতো প্রতিদিন আমরা তিল তিল করে তার কাছে আত্মসমর্পণ করছি। সাড়ে তিন লক্ষ মানুষকে সে নির্মমভাবে শেষ করে দিয়েছে। আক্রান্ত প্রায় ষাট লক্ষ মানুষ। আরও অসংখ্য মানুষের ভবিষ্যৎ তার হাতে। তার আগ্রাসী আক্রমণের সামনে আমরা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছি। পৃথিবীর বাতাস জুড়ে ছড়াচ্ছে মৃত্যুর গন্ধ। মৃত্যুর এক অদৃশ্য সারিতে যেন আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি!
এমন পরিস্থিতি তো আমরাই তৈরি করেছি। অহঙ্কারী লোভী মানুষ, স্বার্থোন্মত্ত মানুষ, শক্তি মদমত্ত মানুষ। সে মনে করে এই পৃথিবী তার একার। এই পৃথিবী সে নিজেই সাজাতে পারে, আবার ধ্বংসও করতে পারে। প্রকৃতি আবার কী? ফুঃ! মানুষ গাছ কাটছে নির্বিচারে! নদীর পথ ঘুরিয়ে দিচ্ছে, পাহাড় ভাঙছে নিজের স্বার্থে, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে জীব বৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক শৃঙ্খল। আমাদের সভ্যতা যত এগিয়েছে, ততই পিছনে ফেলে এসেছি আমরা ব্যভিচারের উচ্ছ্বিষ্ট চিহ্ন।
তারই মূল্য বুঝি আজ আমরা চুকিয়ে চলেছি। প্রকৃতি যেন আজ জেগে উঠেছে প্রতিশোধের বাসনায়! আমরা জানি না কাল কী হবে। কিন্তু আমরা যদি মনে করি, আর কিছুদিনের মধ্যেই করোনা দুর্বল হয়ে যাবে, সে পৃথিবী থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবে, তবে আমরা আবার মূর্খামি করব। এক মূর্খামির মূল্য আমরা দিচ্ছি, কিন্তু তার মূল্য চোকানোর পালা শেষ হয়নি।
বিশ্বের তাবড় ধনী দেশগুলি করোনার কাছে পদানত প্রায়। আমেরিকা, ব্রিটেন, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন। পশ্চিমী দুনিয়া তার অর্থভাণ্ডার উজাড় করেও একে প্রতিহত করতে পারছে না। সুতরাং অর্থ দিয়ে এই মুহূর্তে এই কীটকে মারা যাবে না। এটা প্রমাণিত।
এমন পরিস্থিতে রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা, বিত্তশালীরা কি কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করবেন না?
ধনীরা হয়তো মনে মনে ভাবেন যে, রোগ-ব্যাধিতে শুধু গরিবেরা মরবে এবং তারা অর্থবলে নিজেদের সামলে নেবেন। কিন্তু করোনা সেই চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করছে। অতিভোজনে উদরের পাশাপাশি মগজের রক্তবাহী ধমনিতেও চর্বি জমে যাবার ফলে চিন্তাভাবনার নানারকম সমস্যা হতে পারে অথবা অহংকারে আচ্ছন্ন হতে পারে যুক্তি-বুদ্ধি। তা নাহলে দেখতে পাওয়া যেত যে সবাইকে খারাপ রেখে একা ভালো থাকার চেষ্টায় কিছু স্বল্পমেয়াদী সাফল্য পাওয়া গেলেও অনেক দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা আছে। করোনা স্পষ্ট করে দেখিয়েছে যে সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণে বাকিদের মরতে দিয়ে তার প্রকোপ থেকে শুধু নিজেকে বাঁচাতে গেলে লখীন্দরের লোহার বাসরে নিজেকে যাবজ্জীবন বন্দি করতে হবে। তবু চাঁদ বণিকের লাঠি এড়িয়ে শ্বাস নেবার ছিদ্রটুকু দিয়ে হঠাৎ প্রবেশ করতে পারে কালনাগিনী। এই বিশ্বায়িত বাণিজ্যের যুগে সপ্ত ডিঙা ভাসাতে না পারলে ধনীদের ধনের ভাণ্ডার খালি হয়ে যাবে, আবার ডিঙা ভাসালে মোহরের থলিতে চেপে উজিয়ে আসতে পারে অচেনা জীবাণু। করোনার মতো ভাইরাসেরা ভিআইপি কালচার জানে না, কাউকে পরোয়া করে না। পাশের বস্তিটিকে অসুস্থ রেখে অট্টালিকায় ভালো থাকার দিন সম্পূর্ণ না ফুরোলেও আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে। কখন সন্ধ্যা হয়ে যাবে টেরও পাবেন না। সময় থাকতে ক্ষমতাবানেরা বুঝলে ভালো, না বুঝলেও সময় থেমে থাকবে না।
ভারতে বিখ্যাত ধনীরা কিন্তু বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগের পাশাপাশি অনেক উন্নতমানের হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করেছেন। টাটা-বিরলা-আম্বানীদের হাসপাতালে ধনী-গরিব সবার চিকিৎসা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের ধনীরা বিদেশে টাকা পাচার, সেখানে উত্তর-প্রজন্মের স্থায়ী সুখের নিবাস গড়ে তুলতে ও বিলাস-ব্যসনে নিজেদের জীবন কাটাতে যতটা আগ্রহী, দেশে একটা উন্নত হাসপাতাল তৈরি ক্ষেত্রে ততটাই উদাসীন! তাই আজ কাড়ি কাড়ি টাকা থাকা সত্ত্বেও আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরের অভাবে ধনীদের জীবনও বিপন্ন। এমন এক দুঃসহ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে দেশের বিত্তশালীরা যদি হাসপাতাল তৈরিতে মনোনিবেশ না করেন, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে কিউবার মত শক্তিশালী করার ব্যাপারে উদ্যোগী না হন, তাহলে সেটা হবে নির্মম পরিহাস!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)