এর আগেও যে বিদেশে যাইনি, তা নয়। তবে ঝাঁকের কৈ হলে কোনও ভাবনা-চিন্তা থাকে না। ঝাঁক যেদিকে যায়, সেদিকে গেলেই হলো। কিন্তু একা একা কোথাও যাবার কথা শুনলে মোটেও স্বস্তি পাই না। আর বিদেশ-বিভুঁইয়ে যাবার কথা হলে অস্থিরতায় পেয়ে বসে। তদুপরি কাঁধে যদি থাকে বিরাট দায়িত্বের বোঝা, পরিস্থিতিটা কী দাঁড়ায়, সেটা নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারেন। এ কারণে আমার একদমই যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না।
নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কোনও কালেই ছিল না। জন্মগতভাবে একটা নেতিবাচক মনোভঙ্গি নিয়ে বেড়ে ওঠেছি। দায়িত্ব পালনের কথা শুনলেই শুরুতেই সটকে পড়ার তালে থাকি। নিজ থেকে দায়িত্ব নিতে চাইও না। আমার পক্ষে যে কোনও কিছু শুরু করাটা একটা মহা বিড়ম্বনা। সেটা ভালোলাগার নারীর চোখের দিকে তাকানো হোক কিংবা কারও সঙ্গে যেচে কথা বলাই হোক, কেন যেন পারি না। তবে অনেক নেতিবাচকতার মধ্যে একটা ইতিবাচক দিক বলা যেতে পারে, কোনোভাবে শুরু করতে পারলে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কার্পণ্য থাকে না। যেভাবেই হোক, কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে অন্তত কসুর করি না।
তখন তো ইস্তাম্বুলের যাত্রী খুব বেশি ছিলেন না। এমন কেউ পরিচিত নেই যে, বুদ্ধি-পরামর্শ পাবো। এক মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ছাড়া কাউকেই চিনি না। তখন তো চিঠিপত্র, টেলিফোন আর ফ্যাক্স ছাড়া যোগাযোগ করার সহজ আর কোনও মাধ্যম ছিল না। যা ছিল, তাও তো খুব সুলভ নয়। যে কারণে বেশ বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। সেখানে যাওয়াটাও সহজ ছিল না। এজন্য কূটনৈতিক রীতিতে চিঠি চালাচালি করতে হয়। তারপরই পাওয়া যায় ছাড়পত্র।
পেলেই তো আর হলো না। ভিসা থেকে শুরু করে নানান জটিলতায় হতোদ্যম হওয়ার উপক্রম হয়। জটিলতা দেখলে আমি সাধারণত এড়িয়ে যাবার ধান্দায় থাকি। সেবার কেন জানি হাল ছাড়িনি। দেশের সম্মান বলে কথা। আমার দুর্দশা দেখে অনেকেই বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে বিমানে উঠার পরও স্বাচ্ছন্দ্য হতে পারি না। দোল খেতে থাকি সংশয়ের আবর্তে। আমার পক্ষে কি এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে? আমি তো আর কূটনৈতিক নই। উপরন্তু কথা-বার্তায় মোটেও সাবলীল নই। স্মার্টও নই। কিন্তু কাজটা তো মনোবল, জনসংযোগ ও কূটনীতির। কথার জাদু দিয়েই স্বার্থ আদায় করতে হবে। কীভাবে সম্ভব?
বাংলাদেশ বিমানে দীর্ঘ যাত্রাটাও মধুর ছিল না। বিনা আপ্যায়নে মিউনিখের বিমানবন্দরের চেয়ারে রাত্রিযাপন করতে হয়। ঘুমে ও জাগরণে কয়েক ঘাটের জল খেয়ে সভ্যতার অন্যতম পাদপীঠ গ্রিসের অ্যাথেন্স বিমানবন্দরে নামার পর নার্ভাসনেস খানিকটা কেটে যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় বোধকরি আশির্বাদ করেন সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটলরা। সেখান থেকে ট্রানজিট যাত্রী হিসেবে ইস্তাম্বুলের বিমানবন্দরে পৌঁছাই।
স্কার্ট পরা স্মার্ট দুই মেয়ে মুখে বিজ্ঞাপনী হাসি ঝুলিয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। মুসলিম দেশে এমনভাবে বরণ করা হবে, ভাবতেই পারিনি। ভাববো কীভাবে? জানাশোনার দৌড়ও তো বেশি ছিল না। প্ল্যাকার্ড দেখে আমার পাশাপাশি এগিয়ে আসেন গ্রিসের প্রতিনিধি এলি স্পরিদিস। কুশলাদি বিনিময়ের পর তাঁর পরিচয় জানতে পেরে তাঁকে দিয়ে মকশো করি কূটনীতির প্রথম ধাপ। বুঝতে পারি, আমার যে কারণে আসা, সেক্ষেত্রে তাঁরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। বিমানবন্দরে একসঙ্গে জুস খেতে খেতে তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে।
আমাদের দেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতা ধীরে ধীরে বিকশিত হলেও তখন আন্তর্জাতিক ফোরামে তেমনভাবে সম্পৃত্ততা ছিল না। বিশ্বের ক্রীড়া সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (এআইপিএস)। তার ব্যাপ্তি যেমন, বিশালত্বও তেমনি। আমি বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর এই সংগঠনটির সদস্য হওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মজার ব্যাপার, ১৯২৪ সালে এই সংগঠনটি গড়ে তোলা হলেও এত দিন এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। এ বিষয়ে অবহিত হওয়ার পর সঙ্গত কারণে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিসরে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হই।
বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে আমাকে নিরূপায় হয়ে ইস্তাম্বুলে এআইপিএস-এর ৫৬তম কংগ্রেসে যেতে হয়। তবে বিষয়টি জানাজানি হলে যাওয়ার আগেই শুরু হয়ে যায় রশি টানাটানি। মনে হলো, এত দিনে যেন অন্যদের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি। যা হয় আর কি? স্বভাব অনুসারে বাঙালি তো নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে ওস্তাদ। কংগ্রেসে যাওয়া নিয়ে একটা টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। বুঝতে পারি, অন্য একটি সংগঠন চিঠি পাঠিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে।
সেখানে যাওয়ার পর কায়দা করে চিঠিটি উদ্ধার করতে সক্ষম হই। চিঠিটির বিষয়বস্তু জানতে পেরে আমার জন্য সুবিধা হয়। এআইপিএস-এর সদস্য করা হয় একটি দেশকে। কোনও সংগঠন নয়। তারপরও অন্য একটি সংগঠনের চিঠি পাওয়ার পর বাংলাদেশের সদস্য পদ পাওয়া নিয়ে মহা সংকট তৈরি হয়। এআইপিএস-এর সাধারণ সম্পাদক হাঙ্গেরির ম্যাটি সালমানকিলাসহ একটি গ্রুপ বাংলাদেশের সদস্যপদ দেওয়ার ব্যাপারে রীতিমতো বিরোধিতা করতে থাকেন। আমি বুঝতে পারলাম, পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে। কী করা যায়? কোনও কূল-কিনারা করতে পারছিলাম না। তবে কিছু তো একটা করতেই হবে। সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্ক একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে।
স্বাগতিক দেশের তোগাই বায়াতলি ছিলেন এআইপিএস-এর প্রেসিডেন্ট হওয়ার অন্যতম প্রার্থী। মূলত তার সহযোগিতায় সেখানে যাওয়া। বসফরাসের তীরে ১২ তলার বিলাসবহুল ‘দ্য গ্র্যান্ড তারাবিয়া’ হোটেলে কংগ্রেস আয়োজন করা হয়। যেন পুরো পৃথিবী সম্মিলিত হয়েছে পাঁচ তারকা এই হোটেলে। এত এত দেশের মানুষকে একসঙ্গে দেখা, কম বিস্ময়কর ছিল না। বসফরাসের এক পাশে ইউরোপ। অপর পাড়ে এশিয়া। কী তার সৌন্দর্য, কী তার শোভা, কী তার মাধুর্য।
যাওয়ার পর আয়োজকদের এমন একটা ধারণা দিতে সক্ষম হই, যেন তাদের সম্মান রক্ষার্থেই আমার সেখানে আসা। ব্যস, এরপর আমাকে পায় কে? উল্টো আমার খাতির-যত্ম বেড়ে যায়। আয়োজকদের পুরো সমর্থনই পেয়ে যাই। এমনই অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে যে, মূল উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ আমাকে এমনও বলেন, তোমাকে একজন বেইলি ড্যান্সারের সঙ্গে বিয়ে দেবো। তুমি ইস্তাম্বুলে থেকে যাও। দুষ্টুমি করলেও রীতিমতো জামাই আদর পেতে থাকি। কিন্তু তাতে তো আর আমার লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না।
একশ’-র কাছাকাছি দেশের প্রতিনিধিরা কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন। এরমধ্যে নির্বাহী কমিটির সদস্যরাই নীতি-নির্ধারক। আমি মানচিত্র ধরে ধরে এগিয়ে যেতে থাকি। প্রথমে প্রতিবেশি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলি। তারপর দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়া, আফ্রিকা হয়ে ইউরোপে পৌছে যাই। আমি অবশ্য একটা সুবিধা দারুণভাবে পেয়ে যাই। কংগ্রেসে আমি ছিলাম সবচেয়ে কম বয়সী। যে কারণে অযাচিতভাবেই সবার একটা বাড়তি সহানুভূতি পেয়ে যাই। কিন্তু ম্যাটি তো দেখি মাটি নয়, পাথর দিয়ে গড়া। ভবি কিছুতেই ভুলতে চায় না।
তারপরও আমি কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাই। কিন্তু মন তো কোথাও বসে না। চোখের সামনে রাজকীয় খানাপিনার পাহাড়। খাওয়ায় স্বাদ পাই না। দামি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো কক্ষে শুয়ে থাকলেও ঘুম আসে না। জানলা দিয়ে দেখা যায় বসফরাসের অপরূপ সৌন্দর্য। মন টানে না। সভ্যতার বিস্ময়কর নিদর্শন দেখতে নিয়ে যাওয়া হয় দূরে দূরে। বিনোদনের কোথাও কোনও কিছুর কমতি ছিল না। হৃদয়ে যেন কিছুই স্পর্শ করে না। বেইলি ড্যান্সের চটকদার মোহনীয়তায় দুলে ওঠে উপস্থিত সবার মন। আমি আনন্দিত হতে পারি না। মুসলিম প্রধান একটি দেশের দৈনিক পত্রিকায় ন্যুড ছবি দেখেও আশ্চর্য হই না। আসলে মনের মধ্যে যদি কাঁটা বিঁধে থাকে, তাহলে কোনো কিছুর স্বাদ পাওয়া যায় না।
যে কারণে কিছুই আমাকে আকৃষ্ট করতে পারছিল না। যে দায়িত্ব নিয়ে এসেছি, সেটা যদি করতে না পারি, তাহলে এসব দিয়ে আমার কী হবে? এত দূর থেকে এসে যদি খালি হাতে ফিরে যাই, ব্যর্থতার গ্লানি জীবন ভ’র বয়ে বেড়াতে হবে। কোনও কিছুতেই আমার কোনও হেলদোল দেখতে না পেয়ে কেউ কেউ আমার মনের অবস্থা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারেন। সুসম্পর্ক গড়ে ওঠা মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের প্রতিনিধিরা আমাকে আশ্বস্ত করে বলেন, চিন্তার কিছু নেই। আমরা তো আছি। তুমি আনন্দ করো। সদস্যপদ অবশ্যই পাবে। আমার ম্লান মুখে মৃদু হাসি দেখা গেলেও ভিতরের উঁচাটন কাটতে চায় না।
আমাকে যে অকারণেই আশ্বাস দেওয়া হয়নি, সেটা একটু একটু বুঝতে পারি। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া দেশগুলোর প্রতিনিধিরা আমার হয়ে কংগ্রেসে রীতিমতো চাপ সৃষ্টি করেন। এআইপিএস-এর প্রেসিডেন্ট ইংল্যান্ডের ফ্র্যাঙ্ক টেইলরও ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। তাতে কিছুটা হলেও আশাবাদী হয়ে ওঠে মন। কংগ্রেসে সাক্ষাৎ হয় ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)-র সভাপতি হুয়ান অ্যান্টোনিও সামারাঞ্চের সঙ্গে। আমার সঙ্গে কথা বলে তিনি যেন খুশি হলেন। বললেন, ক’দিন পরই তো তোমার দেশেই যাচ্ছি।
দিনটি ছিল ১৯৯৩ সালের ৭ মে। কংগ্রেসে সেদিনের অ্যাজেন্ডায় ছিল নতুন সদস্যপদ। আগেই নির্বাহী কমিটির সভায় বিষয়টি নির্ধারিত হয়েছে। এক বুক উদ্বেগ আর একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে কংগ্রেসে যথারীতি যোগ দেই। গম্ভীর প্রকৃতির ম্যাটি সালমানকিলা বিমর্ষ কণ্ঠে নতুন সদস্য দেশগুলোর নামের সঙ্গে যখন বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করেন, তখন পুরো কক্ষ হাততালিতে ফেটে পড়ে।
নিজেকে বিশেষ কেউ মনে হতে থাকে। অনেকেই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। অভিনন্দন জানাতে থাকেন। আমি তো অভিভূত, আপ্লুত। যেন আমি বিশ্ব জয় করেছি। বুঝতে পারলাম, ভালোবাসা বোধহয় বৃথা যায় না। সেক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা না জানালে নিজেকে অকৃতজ্ঞ মনে হবে। খুশির ঠেলায় আমি কিছু বলার জন্য অনুমতি চাই। নতুন সদস্য পাওয়া সাতটি দেশের পক্ষে আমাকে বলার সুযোগ দেওয়া হয়। উচ্ছ্বসিত হয়ে সংক্ষিপ্ত যে বক্তব্য রেখেছিলাম, সেটি ৪/৫টি ভাষায় অনুদিত হয়।
দেশে ফিরে আসার সময় মনে হতে থাকে, সৌন্দর্য ও সভ্যতার এমন আকরখনিতে এলাম, অথচ কিছুই তো সেভাবে দেখা হলো না। মন ভ’রে উপভোগ করা হলো না। একটা অতৃপ্তি তো রয়েই যায়। যদিও ক্ষণিকের সেই আফসোস মুছে যেতে বেশি সময় লাগেনি। আমার মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক একটি ফোরামে সদস্য হয়েছে, আর যাই হোক, এটা আমার জন্য ছিল গৌরবময় একটা ব্যাপার। এআইপিএস-এ বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির রজতজয়ন্তীতে সেই স্মৃতিগুলো বুকের মধ্যে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)