আফসানা ফেরদৌসের ময়না তদন্তের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে তার পরিবার। তার পরিবারের পক্ষে কবি মুজতবা আহমেদ মুরশেদ এক বিবৃতিতে বলেন, আফসানার ময়না তদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি আত্মহত্যা। এই প্রতিবেদনটিকে সঠিক ও নির্ভুল বলে আমরা মনে করিনা। বরং প্রতিবেদনটি যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবমুক্ত নয় সে বিষয়টিও সন্দেহের বাইরে নয়। কারণ আফসানা যদি আত্মহত্যা করতো, তবে নিজ বাসাতেই করতো। নিজ বাসা ছাড়া কেউ আত্মহত্যা করার মতোন মানসিক অবস্থায় পরিকল্পনা করে অন্য বাসায় বা স্থানে গিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে না।
আফসানার পরিবার প্রশ্ন রেখে বলে,‘দাম্পত্য জীবনে টানাপোড়েন থাকতেই পারে, কিন্তু কেনো তাকে হত্যা করতে হবে? আর যদি আফসানা আত্মহত্যাই করে থাকে তবে, তার স্বামী হাবিবুর রহমান রবিন কেনো পলাতক? কেনো সে স্ত্রীর মর্মান্তিক পরিণতিতে শোকার্ত নয়? কেনো সে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুসহ পলাতক? কেনো সে আত্মগোপনে?’
মুজতবা আহমেদ মুরশেদ নিহত আফসানা ফেরদৌসের পরিবারের পক্ষে এক বিবৃতি প্রকাশ করেছেন ফেসবুকে। আফসানার পরিবারের সে বিবৃতিটি হুবহু প্রকাশ করা হলো-
সম্মানিত সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
আফসানার ময়না তদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি আত্মহত্যা। এই প্রতিবেদনটিকে সঠিক ও নির্ভুল বলে আমরা মনে করিনা। বরং প্রতিবেদনটি যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবমুক্ত নয় সে বিষয়টিও সন্দেহের বাইরে নয়। কারণ আফসানা যদি আত্মহত্যা করতো, তবে নিজ বাসাতেই করতো। নিজ বাসা ছাড়া কেউ আত্মহত্যা করবার মতোন মানসিক অবস্থায় পরিকল্পনা করে অন্য বাসায় বা স্থানে গিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে না। আর করলেও সেখানকার পাড়া প্রতিবেশীরা ভিড় করে দেখার জন্যে এবং সকলেই জেনে যাবে ঘটনাটা। পুলিশ এসে লাশ নামায় এবং এটি সকলেরই জানা।
আমরা এখনো মনে করি আফসানাকে হত্যা করা হয়েছে। কারণ আফসানাকে ঘটনার আগেই বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) সন্ধ্যা থেকেই মোবাইলে পায়নি তার প্রতিবেশী, যিনি আফসানাকে নিজ মেয়ের মতো দেখতেন। তিনি ক্রমাগতভাবে পরের দুইদিন শুক্রবার ও শনিবার (১২ ও ১৩ আগস্ট) দিনে রাতে মোবাইলে ফোন দিয়েও কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি। তাহলে প্রশ্ন হলো, আফসানা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার আল হেলাল হাসপাতালে লাশ পৌঁছুনোর আগ পর্যন্ত কোথায় ছিলো? আফসানার মোবাইল (০১৭১৪৮৪৩২৯৪) ফোন কল ট্র্যাকিং করে কি তদন্তকারী পুলিশ সেটি বের করেছে? কেনো করেনি এখনো?
সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এটা নিশ্চিত যে, আফসানাকে কোনো না কোনো একস্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
আফসানার স্বজনরা রবিনের বন্ধু পরিচয়দানকারীর ফোনে পেয়ে মিরপুরের আল হেলাল হাসপাতালে ছুটে গেলে সেখানে জানতে পারে, দুজন যুবক আফসানা নামে একজন মেয়ের লাশ ফেলে পালিয়ে গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে খবর দিলে, পুলিশ লাশ কাফরুল থানায় নিয়ে যায়। সেখানে লাশের ছবি তোলার পর ঢাকা মেডিকেল মর্গে পাঠায়। লাশের ছবি দেখে ও মর্গে আফসানার স্বজনেরা লাশ শনাক্ত করার সময় তার গলার মাঝ বরাবর গভীর দাগ দেখে। দাগের ধরণ দেখে বুঝা যায় রশির মতো কোনো কিছু দিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে আফসানার মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলে যেমন দাগ হয়, আফসানার গলার দাগটি তা থেকে ভিন্ন। আত্মহত্যায় যে দাগ হয়, সেটি হয় গলার উপরের কণ্ঠরোধ করার মতো এবং কিছুটা বাঁকানো। এছাড়া মৃতদেহের স্পাইনাল কর্ডও ভাঙ্গা থাকে। কিন্তু আফসানার লাশে সেরকম কিছুই ছিল না। সুতরাং এটি আত্মহত্যা বলে গ্রহণযোগ্য নয়।
পত্রিকার খবর মারফত ঘটনা এমনও জানা গেছে, পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় দুই বাসিন্দা কালের কণ্ঠকে বলেন, “শুক্রবার (১২ আগস্ট) সন্ধ্যায় এ এলাকার গুল মোহাম্মদ বাচ্চুর বাড়ি বা এর পাশ থেকে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার শোনার কথা তাঁরাও জেনেছেন। এলাকায় এ নিয়ে গুঞ্জন চলছে। স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মী পরিচয় দেওয়া কয়েকজন যুবক একটি মেয়েকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেছে।”
আফসানা যদি আত্মহত্যা করেই থাকে তবে তার পরিবারকে কেনো তেজগাঁ কলেজ ছাত্রলীগ কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিন এর বন্ধু সৌরভ পরিচয় দিয়ে কেনো ফোন করে জানানো হয় (অপরিচিত নং ০১৬২২৪০৬৭১৩) আফসানার লাশের কথা? কেনো তখন জানানো হয়নি আত্মহত্যার কথা? কেনেই বা লাশ দাফনের আগে পরে ফোন করে (অপরিচিত ০১৭৮৬৭৩৭৪৪৪, ০১৭৪৯১৭৩১৪৮) তার পরিবারকে বাড়াবাড়ি না করে প্রস্তাব দেয় সমঝোতা করার জন্যে?
সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা, আপনারা ইতোমধ্যেই জেনেছেন যে, আফসানা ফেরদৌস তেজগাঁ কলেজ ছাত্রলীগ কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিনকে বিয়ে করেছিলো এবং তার সাথে বিগত আড়াই বছর ধরে মিরপুরের মানিকদিতে ভাড়া বাসায় স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে থাকতো। তাদের বিয়ের কাবিননামা বাড়িওয়ালা দেখেছেন এবং পুলিশ ছেঁড়া অবস্থায় সেই কাবিননামা আফসানার বাসা থেকে উদ্ধারও করেছে।
প্রসঙ্গ হচ্ছে, দাম্পত্য জীবনে টানাপড়েন থাকতেই পারে, কিন্তু কেনো তাকে হত্যা করতে হবে? আর যদি আফসানা আত্মহত্যাই করে থাকে তবে, তার স্বামী হাবিবুর রহমান রবিন কেনো পলাতক? কেনো সে স্ত্রীর মর্মান্তিক পরিণতিতে শোকার্ত নয়? কেনো সে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুসহ পলাতক? কেনো সে আত্মগোপনে?
একইসাথে প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন, কেনো এখন পর্যন্ত পুলিশ রবিনকে গ্রেফতার করেনি? কেনো তাকে গ্রেফতার করে আফসানার মৃত্যু রহস্যের কিনারা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি? আমরা মনে করি, এক্ষেত্রে আফসানা এবং তার পরিবারের সদস্যদের সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত অধিকার পদদলিত করা হয়েছে।
আপনারা জানেন, আফসানার বাবা মাস ছয়েক আগে ইন্তেকাল করেছেন। আসছে কুরবানিতে ভাইয়ের সাথে গ্রামের হাটে গরু কেনার পরিকল্পনার কথাও তার ভাইকে সে জানিয়েছিলো। মিরপুরের সাইক ইন্সটিটিউটে স্থাপত্য বিদ্যায় তার লেখাপড়াও শেষের দিকে ছিলো। আগামী বছরেই তার জার্মানিতে যাবার কথাও ছিলো বলে সাইক ইন্সটিটিউট থেকে জানা গেছে। এমন অবস্থায় আফসানা কিছুতেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে না।
সুতরাং সার্বিক পারিপার্শ্বিকতাই বলে দেয় যে এটি অবশ্যই হত্যাকাণ্ড।
আমরা রাষ্ট্রের কাছে, প্রশাসনিক যন্ত্রের কাছে আফসানা হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে চাই। একইসাথে বলতে চাই, একজন মুক্তিযোদ্ধার কন্যা, একজন আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান, বাংলাদেশের একজন মুক্তমনা নাগরিক আফসানা ফেরদৌসের নির্মম হত্যার বিচার অনুষ্ঠিত হবে এ দেশের মাটিতে। এখানেও যেনো ’জজমিয়া’ নাটকের অবতারণা না হয়। খুন হয়ে যাওয়া আফসানাই যেনো প্রশাসন যন্ত্র দ্বারা ’জজ মিয়ায়’ পরিণত না হয়।
আমরা আশা করবো দেশের আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত অভিযুক্ত আসামীকে গ্রেফতার করবেন এবং সে সহ জড়িত সকলকেই বিচারের আওতায় আনবেন। যৌক্তিকভাবে আমরা এও দাবি করছি, আফসানা যদি আত্মহত্যা করেই থাকে বলে প্রমাণিত হয়, তবে তাকে সে পথে ঠেলে দেয়ার প্ররোচনাকারিকেও আইনের আওতায় আনতে হবে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে।
আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং উন্নত আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে সুশাসন কায়েম করতে, কোনো পরিচয়ের আড়ালে কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেয়া যাবে না। আফসানা ফেরদৌস হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে আঁধার দূর করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।