জুবায়ের সাহেব স্থানীয় মুদি দোকানি, পাশাপাশি নিজস্ব কৃষি জমি চাষাবাদ করে সংসার পরিচালনা ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ বহন করে থাকেন। তাঁর তিন ছেলে স্কুলগামী এবং বড় মেয়েকে এইচ এস সি পাশ করার পর বিয়ে দিয়েছেন। মোটামুটি সচেতন বিধায় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার বিষয়ে তিনি খুবই আগ্রহী এবং তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও স্কুলে যেয়ে সকল বিষয়ে তিনি খোঁজখবর রাখেন। দ্বিতীয় ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে এবং বাকি দুই ভাইয়ের তুলনায় মেধাবী হওয়ায় সবার চোখে চোখে থাকে ছেলেটি। তবে বিপদ বাঁধে ছেলেটির অসংলগ্ন আচরণে, মাঝে মধ্যে সন্ধ্যার পরে কোথায় যেন মিটিং এর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। হঠাৎ একদিন জানা যায়, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকের অভিযোগে ছেলেটিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এহেন ঘটনা জানার পর ছেলেটির বাবা-মা সহ পুরো এলাকাবাসী স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সার্বিক বিষয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করার পর জানা যায়; ছেলেটি দীর্ঘদিন ধরে গোপন সংগঠনটির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিল এবং পুলিশের নজরদারিতে ছিলো। সর্বশেষ হাতে নাতে প্রমাণের মাধ্যমে ছেলেটিকে গ্রেফতার করে পুলিশ, গ্রেফতারের অব্যবহতি পরের পরিবারের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটছে এবং ঘটবে, তবু আমাদের শিক্ষা হচ্ছে না।
নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সঙ্গে যে পরিবারের ছেলে কিংবা মেয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া যায় সে পরিবারটির সামাজিক অবস্থান একেবারে শূন্যের কোটায় নেমে আসে। একজনের পাপের ভাগ পরিবারের বাকি সদস্যদের বহন করতে হয় সুদীর্ঘকাল। কাজেই, পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কিশোর/কিশোরীদের দায়িত্ব নিতে হবে, বিশেষ করে বন্ধু-বান্ধবীদের বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে, পঠিত সিলেবাসের উপরেও নজর দেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। শিশুর আগ্রহ/অনাগ্রহ, ভাল লাগা, মন্দ লাগা, পছন্দের মাত্রা ইত্যাদি পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার করে শিশুটির জন্য যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা নির্ধারণ করা উচিত। জোর করে, চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে সকলকেই দূরে সরে থাকতে হবে। তাছাড়া, স্কুল/মাদ্রাসায় কি বিষয়ে পড়াশোনা হচ্ছে কিংবা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের কিভাবে তদারিক করা হয় সে বিষয়গুলো মনিটরিং এর আওতায় নিয়ে আসা উচিত বলেই মনে করি। অর্থাৎ একজন কিশোরের মনোজগতের পরিবর্তনের ধারায় উপযুক্ত উপাদানগুলোর উপরে বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করা উচিত।
মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের মধ্যকার পার্থক্য থাকা স্বত্ত্বেও মৌলবাদ আর সন্ত্রাসবাদকে একই পাল্লায় মাপার চেষ্টা করে থাকেন অনেকেই। এর কারণ হিসেবে যথার্থ উক্তি হতে পারে এমন; মৌলবাদে উদ্বুদ্ধরা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে থাকে এবং এর প্রেক্ষিতেই সন্ত্রাসবাদকে আলাদা হিসেবে দেখানোর অভিব্যক্তি তেমন একটা দেখা যায় না। আবার কেউ কেউ মৌলবাদ আর সন্ত্রাসবাদকে একই হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে থাকেন। আলোচনা যাই হোক না কেন; আপনি কারো কাছে সন্ত্রাসবাদ ইস্যু নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবেন কিংবা মৌলবাদী অপশক্তি নিয়ে কথা বলবার চেষ্টা করবেন; দেখবেন অনেকেই মন্তব্য করে বসবে, বাংলাদেশে মৌলবাদের অস্তিত্ব নেই কিংবা বেশ কয়েক বছর ধরে কিন্তু মৌলবাদী অপশক্তিদের কার্যক্রম তেমন একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে; বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে মৌলবাদকে আলোচনার মধ্যে রাখতে হবে কেননা আলোচনা সমালোচনায় থাকলে মৌলবাদের ভয়াবহতা সম্বন্ধে সকলেই অবগত থাকবে পাশাপাশি সরকারও মৌলবাদ প্রতিরোধে সামগ্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার নিমিত্তে কাজ করে যেতে পারে।
বাংলাদেশে মৌলবাদের প্রাসঙ্গিকতা নানারূপে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে; অর্থাৎ সমাজ কাঠামোতে এমন সকল অনুষঙ্গ রয়েছে সেখানে মৌলবাদের বীজ বপন হওয়ার অসংখ্য নমুনায়ন রয়েছে। বিজ্ঞ আলোচকরা বিভিন্ন সময়ে স্থানিক পর্যায়ে গবেষণার মাধ্যমে তাঁদের গবেষণাপ্রসূত উদ্ভাবন দেখিয়েছেন এবং মৌলবাদের প্রাসঙ্গিকতাকে আনয়নের চেষ্টা করেছেন। কাজ না করে টাকা কামানোর ধান্দা বর্তমান সমাজে একটি চিরায়ত বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পেয়েছে, এ বিষয়টি মৌলবাদকে নিশ্চিতভাবে প্রলুব্ধ করে থাকে। নতুন কোন কিছুই আমরা তৈরি করতে পারছি না, চলমান বিষয়ের উপরেই আমাদের নির্ভরতা, অন্যের উপর নির্ভর করে চলার পরজীবীতাই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরনির্ভরশীলতা, ফাও খাওয়ার প্রত্যাশা, জবরদখল, লুটেরা মনোবৃত্তি, দালালি, অন্যের বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ করার প্রবৃত্তিই মৌলবাদ চক্রকে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। উল্লেখ করার বিষয় মতো হচ্ছে; মৌলবাদের সঙ্গে সম্পৃক্তরা স্বাভাবিক পরিচালন প্রক্রিয়ায় জীবনধারণ করে না। সুগঠিত কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা থেকেই মূলত মৌলবাদীদের খরচ ও অন্যান্য সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বেশ কিছু জঙ্গীবাদী সংগঠন, ব্যক্তি, বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে মৌলবাদীরা তাদের জীবনাচরণ পরিচালনা করে থাকে।
প্রকৃত রাজনীতিবিদদের সংখ্যা ক্রমশই হ্রাস পেয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশাল এক শূন্যতার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে যে শূন্যতার খেসারত দীর্ঘকাল দিতে হবে বাঙালি জাতিকে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোতেও নামমাত্র রাজনীতির চর্চা হয়ে থাকে, ছাত্র সংসদগুলোতে নির্বাচন হয় না দিনের পর দিন; যে বিষয়গুলো কোনভাবেই সুখকর নয় ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য। রাজনীতিতে অন্ধকার আবছায়া পর্যবসিত হয়ে উঠলে অপরাধের কালিমালেপন সর্বত্রই বিরাজ করে, সুযোগ পেয়ে যায় দেশবিরোধী চক্র যারা দেশকে টেনে পিছনে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। কাজেই রাজনৈতিক অঙ্গন যত বেশি পরিমাণে ইতিবাচক হবে, মানুষ তত বেশি রাজনীতি সচেতন হবে; পরিপ্রেক্ষিতে মৌলবাদীদের আস্ফালন ক্রমশই ম্রিয়মান হয়ে যাবে। প্রকৃত রাজনীতিবিদ বলতে তাদেরকেই বোঝানো হয়, যারা রাজনীতির মাঠে ঘাম, শ্রম দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জনে প্রতিনিয়ত জনকল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন এবং নীতিতে অটল থেকে ধর্তব্য দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করতে সক্ষম হয়েছেন তারাই প্রকৃত রাজনীতিবিদ। রাজনীতিতে উড়ে এসে জুড়ে বসারা কখনো প্রকৃত রাজনীতিবিদের তকমা গায়ে লাগাতে পারে না, কিন্তু এহেন রাজনীতিবিদদের সংখ্যাই বাংলাদেশে বেশি। ছাত্র রাজনীতি থেকে হাতে খড়ি হয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত নানাবিধ ত্যাগ তিতিক্ষার সমন্বয়ে রাজনীতিতে টিকে থেকে দেশের নেতৃত্ব প্রদান-এমন রাজনীতিবিদদের সংখ্যা ক্রমশই কমে আসছে যা অত্যন্ত শোচনীয় শোভনীয় বাংলাদেশের জন্য। জীবনে কখনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের পদ যে কোনভাবে বাগিয়ে নিতে পারলেই উক্ত রাজনৈতিক দলের প্রার্থীতা মনোনীত হওয়ার নজির বর্তমান সমাজে অহরহ দেখা যায়। এহেন বিষয়গুলোকে অবশ্যই দৃষ্টিগোচরে নিয়ে আসা উচিত না হয় রাজনীতির বাইরে থাকা মানুষগুলো রাজনৈতিক মাঠ দখল করে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে থাকে। যার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক সংকট, উন্নয়নের অবনমন, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, মৌলবাদীদের দাপট, দুর্বল পররাষ্ট্রনীতিসহ সার্বিক বিষয়ে ক্ষয়ক্ষতির উদ্ভাবন তৈরি হয়ে থাকে এবং পরিপ্রেক্ষিতে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়ে থাকে।
ন্যাক্কারজনক নানা ধরনের উদাহরণ রাজনীতির মঞ্চে সৃষ্টি হয়েছে যেখানে দেখা যায়, দলের গঠনতন্ত্র তথা সংগঠনের নীতিমালার থেকে নেতাকেন্দ্রিক রাজনীতি বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে নেতার তোষামোদ করা নিয়ে ব্যস্ত থাকা কর্মীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। শুধু কি নেতার তোষামোদ, নেতার পরিবার-পরিজন, আত্নীয় স্বজনদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্তুতিবাক্য করতে দেখা যায় হরহামেশাই। এমনো দেখা যায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পোষ্টার তৈরির প্রাক্কালে নেতার তোষামোদি করতে যেয়ে দলের প্রতিষ্ঠাতার ছবি দিতে কাপৃণ্য করতে দেখা যায় বিভিন্ন জায়গায়। এহেন বিষয়াদির কারণে মতবিরোধ, অর্ন্তদ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ, রাজনৈতিক বিরোধ সর্বোপরী বিভাজনের সৃষ্টি হয় দলের মধ্যেই। অন্যদিকে, উদ্ভূত সমস্যাকে জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক মুনাফা আদায়ের চেষ্টা করে থাকে মৌলবাদী চক্রগুলো যেখানে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলো মদদ দিয়ে থাকে। রাজনীতিতে জবাবদিহীতার জায়গায় প্রকট রকমের সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে; জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে কালক্রমে; বিষয়গুলো বাংলাদেশের রাজনীতির সংকটের জন্য অনুমেয়। আবার সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়; অনেক জায়গায় প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে, জবাবদিহীতা ও দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে এ ধরনের সংস্কৃতি মারত্নক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে থাকে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, রাজনীতিতে জবাবদিহীতার জায়গা ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছে এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় জনগণের সঙ্গে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অঘোষিত দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়নি রাষ্ট্র, অর্থাৎ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে রাষ্ট্রের জনগণের মুক্তি। কিন্তু আদৌ কি সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়েছে রাষ্ট্রের; রাষ্ট্র কি একটি শোষণহীন, বাঙালি চেতনায় উজ্জীবিত প্রাগ্রসর জাতি, বিভেদহীন মনোভাবসম্পন্ন একটি সমাজ তৈরি করতে পেরেছে? স্বাধীন সার্বভৌম দেশে মানুষের চাওয়া পাওয়া আশা আকাঙ্খার সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক পরিলক্ষিত হওয়ায় নৈরাজ্য পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে থাকে যেখানে নতুন প্রজন্মের কিশোর/কিশোরীরা বিপথগামী হচ্ছে। জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধে এবং একবার অপরাধীর খাতায় নাম উঠে গেলে সেখান থেকে সহজে ফেরত আসাটা কঠিন হয়ে উঠে। এদিকে,পুঁজিবাদি সমাজব্যবস্থার হেতু মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক শক্তি নিহিত রয়েছে। পর্যায়ক্রমে এমন সুগভীর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়ে থাকে যেখানে দেখা যায়; ক্ষমতায় থাকা মানুষেরা আরো ক্ষমতাধর হচ্ছেন এবং ক্ষমতাহীনদের ক্ষমতার মাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস করার পায়তারা করা হয়ে থাকে। অবস্থার প্রেক্ষিতে বলা যায়, চলমান পরিস্থিতি হুট করে স্থগিত হওয়ার কোন আশংকা নেই; বরঞ্চ শোষিতদের সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট হারে বেড়েই চলছে। ফলশ্রুতিতে শোষিত শ্রেণি মুক্তির রথের সন্ধানে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে কেননা সেখানে ক্ষতির তুলনায় লাভের পরিমাণ প্রায় ৩০০%। আলোচিত বিষয়গুলোই মৌলবাদের প্রাসঙ্গিকতাকে বাংলাদেশে সর্বদা জাগরুক করে রাখে, কাজেই এ সংক্রান্তে সকলের সচেতন থাকাটা অত্যন্ত জরুরী।
অন্যদিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন বাংলাদেশে মৌলবাদের সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেগম পাড়ার খবরে বেশ মুখরোচক খবর দেখা হয় সংবাদ মাধ্যমে। মনে হয়, সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করা সম্ভব হলে এমন বেগম পাড়ার আরো সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। বেগম পাড়ার যারা বাসিন্দা, তাদের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল তাদেরকেও তদন্তের মাধ্যমে বের করে নিয়ে এসে জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে। সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে প্রায়শই অবৈধ উপায়ে অর্জিত অঢেল ধন সম্পদ অর্জনের নমুনায়ন দেখা যায় কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময় পরে সবাই কেমন যেন সবকিছু ভুলে বসে থাকি। বৈদেশিক ঋণের একটা অংশ নানা কৌশল অবলম্বন করে দুর্বৃত্তরা লুট করে নেয়; এই দুর্বৃত্তরা কালো টাকা সৃষ্টি, অবৈধভাবে অর্থ পাচার, মাদক পাচার ও বাজারজাতকরণ, অবৈধ অস্ত্র আমদানি ও পাচার, ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ শ্রেণিটাই আবার সর্বোচ্চ ঋণখেলাপী, এরাই আবার অবৈধ উপায়ে সরকারের খাস জমি দখল করে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করছে। অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন হলে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, পেশিশক্তি প্রদর্শন, সরকারী ক্রয়ে ভাগ বসানো, দুর্নীতির ব্যাপকতাসহ দেশবিরোধী কর্মকান্ড সংঘটিত হয়ে থাকে দুষ্টুচক্রদের দ্বারা। সুতরাং বলা যায়, অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন মৌলবাদের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে।
রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ১৯৫৪ সালের সংসদে মোট সদস্যদের ৪% ব্যবসায়ীরা ছিলেন, বাকিরা সবাই ছিলেন রাজনীতিবিদ; বর্তমানের সংসদের চিত্র দেখলে দেখা যাবে প্রায় ৯০% ব্যবসায়ী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সাধারণ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে। এই একটি পরিসংখানই বাংলাদেশের রাজনীতির সার্বিক চালচিত্র তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট। এখানে একটা কথা পরিষ্কার করার প্রয়োজন রয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোনদিনই বাংলাদেশের মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তি আনয়ন করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে রাজনীতির ময়দানে রাজনীতিবিদদের বিচরণ করার মাধ্যমেই রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলত ঘটতে পারে। কাজেই, রাজনীতির জায়াগাটাকে এমন একটি সুস্থির জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যেখানে সবকিছুই রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য, উন্নয়নের স্বার্থে বিনির্মাণ করবার প্রয়াসে অগ্রগণ্য হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এতটাই জঘন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মৌলবাদী গোষ্ঠী কতিপয় রাজনীতিবিদদের পেছনে নির্বাচনে টাকা বিনিয়োগ করে থাকে বলে জনশ্রুতি রয়েছে, পরবর্তীতে মৌলবাদীদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের শর্তে। এহেন পরিস্থিতির কারণে সাধারণ মানুষ কতিপয় রাজনীতিবিদদের উপর থেকে আস্থা হারাচ্ছেন, ফলশ্রুতিতে রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছে জনগণ। রাজনীতি নিয়ে মানুষের আগ্রহে ভাটা পড়েছে যেমনিভাবে ঠিক তেমনিভাবে একটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে যারা রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধাচারণ করতেই পছন্দ করে থাকে। ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতিও মৌলবাদের উৎসাহ প্রদানে সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, হঠাৎ করে দলে জায়গা পাওয়া ব্যক্তিরা প্রকৃত নেতাদের কোনঠাসা করার প্রক্রিয়া হিসেবেই মৌলবাদীদের আশ্রয় প্রশ্রয় প্রদান করে নিজের শক্তিমত্তা দেখানোর চেষ্টায় মত্ত থাকে। এ কথাও স্বীকার করতে হবে নির্বাচনী ব্যয় কিন্তু পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে, বেড়েছে কালো টাকার দৌরাত্ন, জনগণের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, ধনী দরিদ্রদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, উৎপাদনশীল খাতের কার্যকারিতাও কমে আসছে, ধর্মের নামে সহিংসতা, ধর্ম ব্যবসায়ীর সংখ্যাও বাড়ছে। মোদ্দা কথা হিসেবে বলা হয়, সাংস্কৃতিক জাগরণের আন্দোলনকে অবনমনের জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যে ধরনের উপাদানগুলো কার্যকরভাবে প্রযোজ্য সেগুলোই মৌলবাদের ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশে মৌলবাদের প্রাসঙ্গিকতার স্বরূপ হিসেবে কাজ করে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)